শিপ্রা চক্রবর্তী

Tragedy Classics Others

4  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Tragedy Classics Others

কাপুরুষ

কাপুরুষ

7 mins
307


সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে অস্ত যাওয়ার পথে পা..... বাড়িয়েছে। পুরো আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। গঙ্গাবক্ষে আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। একটু দূরে.... এখনও ধোঁয়া উঠছে। কারন চিতাটা সবে সবে নিভতে শুরু করেছে। আজ মনে হয় সত্যি করে মায়া, এই জগতের মায়া ত‍্যাগ করে স্বর্গের পথে পা.... বাড়িয়েছে। সত্যি মেয়েটা খুব কষ্ট পেয়েছে!!!! এই কদিনেই এই গ্রাম, গ্রামের লোকজনের প্রতি বিশেষ করে, মায়ার প্রতি একটা কেমন টান পড়ে গেছিল আমার । সত্যি, সেদিন যদি আমি কিছু একটা করতে পারতাম!!!! তাহলে হয়তো মায়াকে এইভাবে চলে যেতে হতনা!!! হঠাৎ একজনের গলার আওয়াজে আমি ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে এলাম।

----------কি হলো দাদাবাবু স্টেশনে যাবেন না???? ট্রেনের সময় হয়ে গেছে তো..????

-----------আমি বললাম হ‍্যাঁ.... রামু কাকা, এইতো যাব। এই গঙ্গার ধারটা আমার খুব ভালো লাগে তাই যাওয়ার আগে শেষ বারের মতো একটু সময় কাটাতে এলাম।

--------------রামুকাকা করুন সুরে বলে উঠল, আচ্ছা দাদাবাবু তুমি..... আর কখনও... আমাদের গ্রামে আসবেনা????

-----------আমি বললাম না..... গো....। আর হয়তো আসা হবেনা!!!!! তোমরা সবাই ভালো থেকো।

এই বলে বেড়িয়ে পড়লাম স্টেশনের উদ্দেশ্যে। লাল মাটির পথ দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। আগে এই রকম গ্রাম, গ্রামের রাস্তা, সবই আমার কাছে বিরক্তিকর ছিল কিন্তু কখন কি.... ভাবে নিজেকে এই সবের সাথে জড়িয়ে ফেলেছি কি... জানি???? হয়তো মায়াই আমাকে এই সবের সাথে জড়িয়ে দিয়েছে। আজ আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ,,,, নিজেকে অপরাধি মনে হচ্ছে,,, শুধুমাত্র নিজের অপমান, আর স্বার্থের কথা না.... ভেবে আমি সেইদিন যদি মায়াকে ফিরিয়ে না.... দিতাম, তাহলে হয়তো আজ এই রকম পরিস্থিতি হতনা!!!! স্টেশনে পৌছানোর কিছুক্ষনের মধ্যে ট্রেন আসল, আমি ট্রেনে উঠে পড়লাম। ট্রেনে সেইরকম ভীড় নেই, ফাঁকাই বলা চলে। কারন এটাই এখানকার শেষ ট্রেন, এরপর আর কোন ট্রেন নেই। সারাদিনে মোট চারটে ট্রেন চলে এই বকুলপুর গ্রামে।

আমি জানলার ধারে গিয়ে বসলাম। জানলার কাঁচটা খুলে দিয়ে হাওয়াটা ভালো করে উপভোগ করতে লাগলাম। সারাদিনের ক্লান্তির জন্য চোখটা লেগে এসেছিল, হঠাৎ করে চোখের সামনে মায়ার চঞ্চল, প্রানবন্ত, হাসি মুখটা ফুটে উঠল। সাথে সাথে আমার ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। চারিদিকে তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। ট্রেন আপন গতিতে তার গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছে। আমি জানলার দিকে মুখটা বার করে আলো আঁধারি পরিবেশ দেখতে দেখতে আজ থেকে এক বছর দুমাস আগে পাড়ি দিলাম।

*****************************************

আমি কুশ চৌধুরী। উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। আমি ছোট থেকেই শহরে মানুষ হয়েছি। আমি বাংলায় অর্নাস নিয়ে মাস্টার ডিগ্রি পাস করি। আমার বরাবরের ইচ্ছা ছিল স্কুল মাষ্টার হওয়ার, সেইমতো পরীক্ষা দিতে থাকি। আগের বার আমি চাকরিটা পাই কিন্তু সমস্যা হয়ে ওঠে জায়গাটা নিয়ে। একে তো.... শহর থেকে দূরে তার ওপর একদম অজগ্রাম। বাড়ির সবাই আসতে বারন করেছিল কিন্তু আমার ইচ্ছা পূরনের জন‍্য আমি চাকরিটা নিয়ে চলেই আসি এই বকুলপুর গ্রামে।

যেদিন প্রথম আমি বকুলপুর গ্রামে পা..... দিই সেই দিন আমার প্রথম দেখা হয়েছিল মায়ার সাথে। স্টেশন থেকে বেড়োতেই চোখে পড়ে একজন চঞ্চল, প্রানবন্ত মেয়ে ছাগলের বাচ্ছা কোলে করে গুন... গুন... করতে করতে হেঁটে চলেছে লাল মাটির পথ ধরে। অপরূপ সেই দৃশ্য।

রবিঠাকুরের কথায়............


"কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি.....,

তারেই বলি...., কালো বলে তারে...

গায়ের লোক....., মেঘলা দিনে

দেখে... ছিলেম.... মাঠে, কালো...

মেয়ের কালো.... হরিণ চোখ.....।"


আমি কিছুটা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে চেয়ে ছিলাম ওর দিকে। হঠাৎ আমার ধ‍্যান ভাঙ্গল একটা হাসিতে। চেয়ে দেখলাম মেয়েটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হাসছে আর বলছে, দাদাবাবু কোথায় যাবেন?

-----------আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম রামানন্দ বাবুর বাড়ি যাব???

----------মেয়েটি বলল ও.... মাষ্টারমশাই এর বাড়ি, আচ্ছা আপনি বুঝি শহর থেকে এসেছেন???

---------আমি বললাম হ‍্যাঁ.....। এই গ্রামের স্কুলের নতুন মাষ্টার আমি।

-------------মেয়েটি এক মুখ হাসি নিয়ে বলল, আমি মায়া, চলুন আপনাকে মাষ্টারমশাই এর বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।

মেয়েটিকে অনুসরণ করতে করতে গ্রামের রাস্তা দিয়ে অনেকটা পথ হাঁটার পর আমরা একটা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

-----------মেয়েটি বলল নতুন মাষ্টার, এটাই মাষ্টারমশাই এর বাড়ি।

আমি মেয়েটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম। রামানন্দ বাবু আমাকে একটা ঘর খুলে দিলেন আর বললেন দাঁড়ান একজনকে পাঠিয়ে দিচ্ছি সব পরিষ্কার করে দেবে। আসলে বহুবছর আগে একজন এসেছিলেন তিনি চলে যাওয়ার পর আর কেউ আসেনি। তবে থেকে আমি একাই স্কুলটা চালাই। তা বাবা তোমার তো বয়স বেস অল্প, তা তুমি এখানে থাকতে পারবেতো?

--------------আমি বললাম হ‍্যাঁ..... পারব। রামানন্দ বাবু চলে যাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যে রামুকাকা এসে সমস্ত কিছু পরিষ্কার করে আমার খাবার ব‍্যাবস্থা করে দিলেন।

-----------পরেরদিন স্কুলে গিয়ে দেখলাম খুব অল্প সংখ্যক ছাত্র, ছাত্রি। আমি কিছুটা অবাক হয়ে রামানন্দ বাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম আচ্ছা এতো অল্প ছাত্র, ছাত্রি কেন??,?

----------রামানন্দ বাবু বললেন সবাই পেটের তাগিদে কাজ করতে ব‍্যস্ত। স্কুলে আসার কারোর সময় নেই।

-----------আমি কিছুনা... বলে ক্লাস নেওয়ার জন্য এগোতে থাকলাম। তবে একটা দৃশ্য দেখে আমার দৃষ্টি আটকে গেল। সেই মেয়েটা এখানে বাচ্ছাদের পড়াচ্ছে। আমি আস্তে আস্তে ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখে বাচ্ছারা একটু ভয় পেল।

-------------মেয়েটি সাথে সাথে বলল, ভয় পাওয়ার কিছু নেই উনি আমাদের নতুন মাষ্টার।

-----------আমি বললাম আপনি এখানে পড়ান?

----------পিছন থেকে রামানন্দ বাবু বললেন, না.... না..... মায়া এই বার উচ্চমাধ‍্যমিক দেবে। খুব ভালো মেয়ে মেধাবী ছাত্রি। স্কুলে মাষ্টারের সংখ্যা কম তাই ও.... বাচ্ছাদের একটু পড়িয়ে দেয়। এতে আমার সাহায্য হয় একটু এই যা...!!!

------------আমি বললাম আচ্ছা। আর মনে মনে ভাবলাম, সত্যি মেয়েটার নাম স্বার্থক। সত্যি ওর চোখ দুটো যেন মায়ায় ভরা।

*****************************************

এইভাবে বেশ কিছুমাস পার হয়ে গেল। আমার সাথে মায়ার একটা নাম না জানা বন্ধন তৈরী হয়েছে। প্রত‍্যেকদিন স্কুলের পর মায়া আমার কাছে আসে পড়া বুঝিয়ে নেওয়ার জন‍্য। মাঝে মধ্যে ওদের গ্রামটাকেও ঘুরিয়ে দেখায়। আস্তে আস্তে এই জায়গাটাকে আমি ভালোবাসতে শুরু করে দিয়েছি। মায়ার সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পেরেছি, ছোট বেলায় ওর মা মারা যায় তার পর ওর বাবা আবার বিয়ে করে। কিন্তু মায়ার সৎ মা মায়ার জীবনকে দূর্বিষহ করে তুলেছে। মেয়েটা এত কষ্ট সহ‍্য করেও সবসময় কি সুন্দর হাসি খুশি থাকে। মায়ার প্রতি আমার কেমন যেন একটা মায়া পড়ে গেছে।

এরমধ্যে আরও কিছুমাস পার হয়ে গেছে। সেইদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় মায়া আমাকে গঙ্গার ধারে নিয়ে যায়। গঙ্গার পাড়ে বসে আমরা দুজন দুচোখ ভরে সূর্য অস্তের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখছিলাম তখন হঠাৎ করে কেউ একজন মায়ার চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে এবং মাড়তে মাড়তে রাস্তা দিয়ে নিয়ে চলল মায়াকে । আমি আটকানোর চেষ্টা করলে একটি লোক আমাকে বলল, আপনি বাইরের লোক আমাদের ব‍্যাপারে নাক গলাবেননা। পরে আমি জানতে পাড়লাম ওনারা মায়ার বাবা আর সৎমা।

এই ঘটনার পর থেকে প্রায় এক সপ্তাহ মায়া স্কুল আসেনি। আমি লোক লাগিয়ে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু লাভ হয়নি কিছু!!!! তাই একদিন সাহস করে আমি মায়াদের বাড়ি গেলাম। কিন্তু গিয়ে যা..... শুনলাম তাতে আমি ভীষণ অবাক হলাম!!! মায়ার নাকি বিয়ে!!!! আমি ওনাদের অনেক বোঝালাম যে..... মায়ার এখন বিয়ে দেওয়া ঠিক হবেনা!!!! আর তাছাড়া মায়া পড়াশোনায় ভীষণ ভালো সামনে ওর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।

----------সাথে সাথে মায়ার সৎমা আমাকে বললেন বুঝতে পাড়ছি মায়ার কি....... রকম ভ‍বিষ‍্যৎ। তুমিই মেয়েটার মাথাটা চিবিয়ে খাচ্ছ। তোমার এর পিছনে কি..... মতলব আছে আমি জানি?????

----------মায়ার বাবা বলল, এই শহরের ছোকড়া তুমি আমাদের ব‍্যাপারে নাক গলিওনা তাহলে ভালো হবেনা কিন্তু। এক্ষুনি আমার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাও।

সেইদিন ঐ ভাবে অপমানিত হওয়ার পর আমি আর মায়াদের বাড়ি যায় নি.... ঠিকই কিন্তু মায়ার চিন্তা মন থেকে দূর করতে পারিনি। তাই আমার চেনা গুপ্তচর কে রেখে ছিলাম মায়ার খবরা খবর দেওয়ার জন‍্য। তবে মায়ার বিয়ের দুদিন আগে রাত্রে বেলায় আমি ঘরে শুয়ে আছি হঠাৎ দরজায় আওয়াজ হয়। আমি প্রথমে শুনেও খুলিনা, তারপর আবার আওয়াজ হয় তখন আমি দরজা খুলে দেখি মায়া।

------------মায়া হন্তদন্ত হয়ে ঘরের ভীতরে ঢুকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল নতুন মাষ্টার তুমি আমাকে বাঁচাতে পাড়োনা????

----------আমি বললাম কি.... বলছ মায়া???? আমি কি.... ভাবে তোমাকে বাঁচাব???

----------মায়া বলল কেন নতুন মাষ্টার আমাকে নিয়ে শহরে চলো তাহলেই তো... হবে!!!!

----------আমি বললাম না.... মায়া সেটা হয় না....!!! তুমি এখন বাড়ি যাও। তোমাকে এইখানে কেউ দেখে নিলে আবার আমাকে সবাই খারাপ ভাববে, আর তোমার কপালে মার জুটবে।

------------মায়া আমার পা..... জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, এই বিয়ে হলে আমি বাঁচবনা নতুন মাষ্টার। ওরা আমাকে ঠিক মেরে ফেলবে!!!! তুমি আমাকে বাঁচাও। আমার ভীষণ ভয় করছে নতুন মাষ্টার। ওরা একদম ভালো মানুষ নয়। মাষ্টারমশাই বাবাকে বলতে গেছিল ওদের বিষয়ে।

-------------আমি বললাম তোমার বাবা শুনে কি.... বলেছে????

-------------মায়া বলল, বাবা বলেছে আমার মেয়ে আমি বুঝে নেব!!!! আপনাদের অত ভাবতে হবেনা।

--------------আমি বললাম তাহলে তুমি কি..... করে বলছো আমাকে তোমাকে নিয়ে শহরে চলে যেতে,,, এর মানে বোঝো????

-------------মায়া কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল আমি কিছু বুঝতে চাইনা, তুমি শুধু আমাকে এই বিয়ে থেকে বাঁচাও নতুন মাষ্টার। আমি সারা জীবন তোমার চরণ দাসী হয়ে থেকে যাব।

কিন্তু সেইদিন আমি সমস্ত মান অপমান ভুলে আমার স্বার্থের গন্ডি থেকে বেড়িয়ে এসে মায়ার হাতটা ধরতে পারিনি ওকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।

তারপর নির্দিষ্ট সময় মত মায়ার বিয়ে হয়ে যায়। একমাস যেতে না.... যেতেই মায়ার অত‍্যাচারিত, রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার হয় মায়ার শ্বশুরবাড়ি থেকে। মায়ার কথা গুলো অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। সত্যি ওরা ওকে মেরে ফেলে!!! পুলিশ কেস হয়নি!!! কারন মায়ার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মায়ার বাবা, মাকে প্রচুর পয়সা দিয়ে কিনে নিয়ে ছিল। তবে মায়ার শেষ ইচ্ছাটা ওরা রেখেছে। বকুলপুর গ্রামে গঙ্গার তীরে মায়ার দাহ হয়েছে।

হঠাৎ আমার ভাবনার অবসান ঘটল ট্রেন তার গন্তব্যে এসে থামল। আমিও বকুলপুরের সমস্ত স্মৃতি, মায়ার স্মৃতি নিয়ে আবার শহরের বুকে পা..... দিলাম। আমি আবার নতুন করে জীবন শুরু করবো হয়তো!!!! কিন্তু মায়ার স্মৃতি সবসময় আমার মনের একটা কোনে রয়ে যাবে। এবং আমাকে যন্ত্রণা দিতে থাকবে, কারন সেইদিন যদি আমি মায়াকে ফিরিয়ে না.... দিতাম!!! ওর কথা মত ওকে নিয়ে শহরে চলে আসতাম তাহলে হয়তো আজকের এই দিনটা অন্য রকম হত!!!! এই কষ্ট আমাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। এর থেকে হয়তো আমার মুক্তি নেই!!!! শুধু মনে মনে এইটুকু চাইব,... মায়া তুমি যেখানেই থেকো ভালো থেকো!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy