জরিমানা
জরিমানা
আমি একা মানুষ । পরিযায়ী শ্রমিক বলতে পারেন। গত চোদ্দ টা বছর বিদেশে চাকরি করেছি। দুই বছর অন্তর অন্তর বাড়িতে যেতাম, এক মাসের জন্য। তাও নানা কাজে থাকা হতো না বাড়িতে ঠিক মতো। আসলে আমার চাহিদা একটু বেশি। ছোট বেলায় একসময় আমরা খুব গরিব ছিলাম। তাই লোভ সামলাতে না কথা প্রবাদ প্রবচন মতো মুখস্থ করে রেখেছিলাম। আজ থেকে ঠিক চোদ্দ বছর আগে আমার ছোট ভাই ছোট ছেলের মুখ সেই কথা শুনতে হলো আমাকে " আমি চকলেট খাই না , খেলে দাঁতে পোকা হয়।"
কথাটা আমরা বলতাম । অবিকল আবার আমাদের মতো ও ওর মা রূপার দিকে তাকিয়ে বললো " ও মা, মা গো।বাবা তো বললো ওনি আমার জেঠাই । তাহলে আমি ওনার দেওয়া চকলেট খাই আমার চকলেট খেতে খুব ভালো লাগে।"
বাচ্চাটাকে জরিয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলাম। তারপর জোর করে নিয়ে এসেছিলাম আমি ওদের আমাদের বাড়িতে। তারপর আমি ঠিক করলাম যে ভাবেই হোক বড়লোক হতে হবে । কারণ আমার ভাই ভীষন ভালো ছবি আঁকাতো। কিন্তু গরীবের ঘরে ছবি আঁকাটা বিলাসীতা। ছেড়ে দিলো। আমার ভাইয়ের ছেলের স্বপ্ন বড় হয়ে ডাক্তার হয়ে দেশের সেবা করবে। আজকাল মেধা থাকালেই হয় না। পড়াশোনাতো বানিজ্যিক হয়ে গেছে। তাই অনেক টাকার দরকার ছিলো। তাই এই চৌদ্দ বছর আমি আমার স্বাদ আল্লাদ ভুলে পরিবারের জন্য বিদেশে পরে আছি।
আজ প্রথম জন্মদিন পালন করা হবে সেইদিনের ছোট্ট একালব্যের । ও ওর স্বপ্ন পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েছে।ওর সফলতা অভিনন্দন জানাতে আজ একটা উৎসব পালন করছি আমরা ফ্যামেলি রিইউনিয়ন যাকে বলে।
সবাই খুশি। আমি খুশি এতোদিন পর তৃণা কথা দিয়েছে ও আসবে ফিরে বাড়িতে। ওর সাথে ঝগড়া করে রূপা এ বাড়ি ছেড়েছিলো। সেই রাগে আমিও ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বেড় করে দিয়েছিলাম। তারপর চলে গেলাম মুম্বাই চাকুরী নিয়ে। পরে ভাইকে ফিরিয়ে আনলাম বাড়িতে। প্রতিবার দেশে ফিরে ওর সাথে দেখা করছি। বারবার বলছি বাড়িতে এসো কিন্তু ও বড় অভিমানী ফিরে এ বাড়িতে কোন দিন আর।
সবাই কেক কাটার জন্য ব্যাস্ত । আমি বললাম দাঁড়াও এক জন আসবে। তারপর কেক কাটা হবে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে দুই ঘণ্টা পেরিয়ে যেতে সাবাই জিগ্গেস করলো কে আসবে। আমি বললাম " তৃণা"
সবাই চুপচাপ হয়ে গেলো। এ ওর দিকে তাঁকালো। কে জানো বলে উঠলো " বুবাই তুই পাগল হয়ে গেছিস নাকি তুই যে বছর মুম্বাই গেলি। সেই বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি তো ও সুসাইট করছে। ও আসবে কি করে।"
আমি বললাম " ও তো কাল আমার সাথে ছিলো এই দেখো মোবাইলে ও সেল্ফি তুলেছে।"
মোবাইল ফোন আমি একা দাঁড়িয়ে। আমি চুপচাপ ঘরে ঢুকলাম। দরজা বন্ধ করে দিলাম। মনে মনে বললাম "২৪ ফেব্রুয়ারি সেতো আমাদের বিয়ের দিন"
ঘরে বিছানায় শুয়ে থাকা তৃনা উঠে বসলো , বললো " মনে আছে তাহলে তোমার , আমাদের বিয়ের দিনটা কবে ভুলে যাও নি।"
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম " কেন করলে তুমি এমন কাজ? আমার তো চাকুরী খুঁজতে বেশি দেরি হয় নি।"
ও বললো" জীবনের প্রতি উদাসীনতার জরিমানা এটা।"
আমি ভীষন ভাবে কাঁদলাম। বাইরে থেকে সবাই দরজা খুলতে বললো। আমি উত্তর দিলাম না। দরজাও খুললাম না। হঠাৎই আর কোন শব্দ পেলাম না কোন, ঘরের আলো কে যেনো বন্ধ করে দিলো। ঘরময় তখন শীতল একটা অন্ধকার।