Ankita Sarkar

Comedy Romance Classics

4.8  

Ankita Sarkar

Comedy Romance Classics

জীবনের জলছবি

জীবনের জলছবি

7 mins
685



অসামান্য প্রতিভাধর ঋষভ বসুকে শুধু নিজের বিদ্যালয়ে নয়, এলাকা ছাড়িয়ে দূর দূরান্তের শিক্ষকেরা এক ডাকে চিনত। আর নিজের বিদ্যালয়ে তো প্রশ্নাতীত জনপ্রিয়তা। ঋষভও নিজের অধ্যবসায়ের জোরে উত্তরোত্তর উন্নতির শিখরে।

 বাবা সৌরভ বসুও এলাকার নামকরা ডাক্তার। সেই সুবাদে বিখ্যাত বিজ্ঞানী সংকেত রায়ের সাথে পরিচয়। পেশেন্ট ও ডাক্তারের সম্পর্ক অবশেষে পারিবারিক বন্ধুত্বে পরিণত। সংকেতবাবুর একমাত্র সুন্দরী কন্যা সুনেত্রাও ঋষভকে চিনত ভালো ছেলে হিসেবে। পারিবারিক সখ্যতায় দু'জনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ ঘটে।

ঋষভের জীবনে সুনেত্রার গভীরতা আরও বৃদ্ধি পায় ডাক্তারি পড়ার সময়। ঋষভ এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণায় খুঁজে পায় পরশমণি।

হঠাৎই স্বপ্নভঙ্গ একটি সামান্য ঘটনায়। ঋষভের বইয়ের ভেতর সুনেত্রা আবিষ্কার ক'রে হলুদ খামের চিঠি! খামের উপর সুন্দর হাতের লেখা....

"আমার প্রিয় মানুষকে - তোমার প্রিয়তমা বান্ধবী"  

ঋষভকে না জানিয়ে খুলে ফেলে খামটি। ঐন্দ্রিলার গভীর ভালোবাসার ছোঁয়ায় দীর্ঘ এক প্রেমপত্র!

হতবাক সুনেত্রা! কে এই ঐন্দ্রিলা? দ্বিধান্বিত মনে সংশয়ের আকাশ ভেঙে পড়ে এতদিনের প্রেমের বন্ধনে। 

এদিকে ঐন্দ্রিলার জন্যে বাড়ির থেকে নিউইয়র্কে বসবাসকারী বিজ্ঞানী সংলাপ সেনের বিবাহ প্রায় পাকা। 

সে ভেবেছিল আজই ঋষভের সাথে এই ব্যাপারে কথা বলবে, আর তারপর দুইজনে মিলে বাড়িতে তাদের সম্পর্কের কথা জানাবে। কিন্তু আর কোন মুখে বাড়িতে জানাবে এসব!! সাথের মানুষটাই যদি ঠিক না থাকে, তবে তো সবই ব্যর্থ । ভগ্নমনোরথ সুনেত্রা বুঝতেও পারেনি, কখন চোখের দু কোল ছাপিয়ে অশ্রু এসে ভিজিয়ে দিয়েছে তার গাল ও গলা।

পিছনে একটা পদশব্দ পেয়েই তাড়াতাড়ি চিঠিটা বইয়ের ভাঁজে ঢুকিয়ে দিয়ে চোখ মুছে মিথ্যে হাসি ঠোঁটে এঁকে সামনে ফিরে দাঁড়াল। ঋষভ তার সামনে এসে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল,

- "চলো, আজকের মত কাজ তো শেষ। তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসব আজ।"

সুনেত্রা আর আপত্তি করল না। লোভীর মত আঁকড়ে ধরতে চাইল তার সঙ্গ। ওর এই পরিবর্তন সম্পূর্ণরূপে চোখ এড়িয়ে গেল ঋষভের। মানুষ এত পাল্টে যায় এক লহমায়!! নাকি, অনেক আগেই শুরু হয়েছিল এই পরিবর্তনের খেলা!! চোখে ভালোবাসার চশমা পরে থাকা সুনেত্রাই টের পায়নি তা।

বাড়িতে ঢুকতেই বাবা সংকেত রায় বললেন,

- "সুনু মা, ওরা যে আর অপেক্ষা করতে চাইছেন না। এবার তো তোর একটা উত্তর দরকার মা।"

কত আশান্বিত মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে বাবা। কি করে তাকে আঘাত করবে!! বুকে পাথর চেপে সুনেত্রা বলল,

- "তোমার সিদ্ধান্তের উপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। তুমি যা করবে, তাতেই আমার ভালো হবে।"

খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ডাক্তারের মুখ। তিনি তক্ষুণি উঠে গেলেন টেলিফোনের কাছে। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে সুনেত্রা ধীর পায়ে নিজের ঘরে চলে গেল। বড় ক্লান্ত আজ সে। বুকের মধ্যে শুধু বিরাজ করছে এক মরুভূমি শূণ্যতা।

পরদিন ইচ্ছে করেই বাড়িতে রয়ে গেল। সম্প্রতি সংলাপ নিউইয়র্ক থেকে ফিরেছে। দুই বাড়ির অনুমতিতেই আজ দুজনে একান্তে নিজেদের চিনে নিতে চায়। কলকাতার এক নামী ক্যাফেতেই সেই সাক্ষাৎ স্থির হয়েছে। মা প্রমীলাদেবী তাই আজ আর তাকে বেরোতে দেননি।

নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ির গাড়িতে সেই ক্যাফেতে পৌঁছোল সুনেত্রা। আজ তার কলেজে অনুপস্থিত থাকার কারণ জানতে একবার ফোন করেছিল ঋষভ। কিন্তু সুনেত্রার সংক্ষিপ্ত উত্তরেই নিজেকে সন্তুষ্ট রেখেছে। একবারও জানতে চায়নি, সুনেত্রার কি কাজ আছে!! অভিমানে চোখ জলে ভরে উঠল ওর। কবে এত দূরে সরে গেল ঋষভ!!

ক্যাফেতে পৌঁছে দেখল, তার আগেই সংলাপ এসে বসে রয়েছে তার জন্য। প্রচন্ড ব্যক্তিত্বময় সেই পুরুষ। নিজেকে কেমন ম্লান মনে হতে লাগল সুনেত্রার। অফ হোয়াইট শার্টের সাথে কালো স্যুট টাই পরিহিত মানুষটির সামনে নিজেকে কিছুতেই মেলে ধরতে পারছে না ও। সেও বোধকরি, রিমলেস চশমার আড়ালে থাকা চোখ দিয়ে মেপে নিচ্ছিল তার অস্বস্তিটুকু।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার সে নিজেই প্রথম কথা বলা শুরু করল। সুনেত্রা তার যথাযথ উত্তর দিতে থাকল। কিন্তু নিজে কোনো প্রশ্ন করছে না। বুঝতে পারছে, তাকে এই পরিস্থিতিতে সহজ করার জন্য কি প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে মানুষটা!! একসময় সংলাপ জিজ্ঞেস করল,

- "তুমি কি সামহাউ এই বিয়েতে রাজি নও?? অন্য কাওকে পছন্দ করো??"

এই একটা প্রশ্নে আমূল কেঁপে উঠল ও। চোখদুটো জ্বালা করে উঠল। কিন্তু তবু সজোরে ঘাড় নাড়িয়ে নেতিবাচক উত্তর দিল। তবু সেই মানুষটার সন্দেহ গেল না। আবার জিজ্ঞেস করল,

- "তবে তোমার ব্যবহার এমন যান্ত্রিক মনে হচ্ছে কেন?? আমি তো শুনেছিলাম তুমি খুব প্রাণোচ্ছল মেয়ে।"

- "বিয়ের পর সবাইকে ছেড়ে, পরিচিত সবকিছু ছেড়ে নতুন একটা দেশে গিয়ে নতুন করে ভীত তৈরী করতে হবে। তাই আর কি!!"

- "ওহ আই সী। এই জন্য তুমি মন খারাপ করছ?? ডোন্ট ওরি। আমি আছি তো।"

শেষ কথাটা বলার সময় নিজের ডানহাতের মুঠিতে তুলে নিল সুনেত্রার হাতখানি। সুনেত্রা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে।

রাত্রে বাড়ি ফিরেই ঋষভকে সমস্ত কথা হোয়াটস এপে বলল। সাথে সংলাপের একটা ছবিও দিল। জবাবে ঋষভ শুধু একখানি "কনগ্র‍্যাটস" ও দুটো হাসির ইমোজি দিয়ে কাজ সারল। হতবাক সুনেত্রার চোখ দিয়ে আবারো জল গড়িয়ে পড়ল। এ ছেলে কি কিছুই বোঝে না!!

না হয়, প্রথাগত ভাবে দুজন দুজনকে ভালোবাসার কথা বলেনি, কিন্তু এই যে এতদিন একসাথে গল্প করা, ঘুরতে যাওয়া, একে অপরের খোঁজ নেওয়া এগুলো কি কোনো প্রভাব ফেলেনি ঋষভের উপর!! এতদিন ভুল বুঝে এল সুনেত্রা!! এত ভালোবাসা সব অপাত্রে দান করল!!

ক্রমে সুনেত্রা আর সংলাপের বিয়ের দিন এগিয়ে আসতে লাগল। সংলাপের সাথে ওর আলাপ পরিচয় বাড়তে লাগল। কিন্তু কিছুতেই মন থেকে মুছতে পারল না ঋষভকে। বারবার মনে পড়ে যেত, বাগবাজার ঘাটে হাতে হাত রেখে বসে সূর্যাস্ত দেখা, ভিক্টোরিয়ার মাঠে বসে ভবিষ্যত পরিকল্পনা করার কথা।

ঋষভ বলত, "আমি ডাক্তারি পাশ করে কিছুতেই বিদেশ যাব না। এখানেই নিজেদের নার্সিং হোমে কম খরচে অত্যাধুনিক চিকিতসার ব্যবস্থা করব। তুমিও জয়েন করে নিও না!!"

সুনেত্রাও হেসে সম্মতি জানিয়েছে। ওর তো আপত্তি করার কোনো কারণই নেই। ঋষভের কাছাকাছি দিনের অনেকটা সময় থাকতে পারবে ভেবেই খুশিতে ওর মন নেচে উঠেছিল। সুনেত্রা জিজ্ঞেস করেছিল,

-"যেখানে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পেলে সকলে লুফে নেয়, সেখানে তুমি নিজের জীবনটা এখানেই কাটাবে বলে ঠিক করেছ!! এটা কি শুধুই দেশের প্রতি ভালোবাসা!! নাকি!!"

দুষ্টুমি ভরা সুনেত্রার চোখের দিকে তাকিয়ে সে বলেছিল, "আছে তো। আরো একটা কারণ আছে। দূরে গেলে তোমায় খুব মিস করব।"

একমুঠো লাল আবির যেন কেউ ছড়িয়ে দিয়েছিল সুনেত্রার গালে। সে সব কি শুধুই কথার কথা ছিল?? একাকী বসে কি ঋষভকে এসব স্মৃতি একবারও তাড়া করে না!! কি স্বাভাবিক ঠান্ডা ব্যবহার ওর সুনেত্রার সাথে। যেন কিছুই হয়নি। কাকু-কাকিমাও প্রায়দিনই বাড়িতে আসছেন বিয়ের ব্যাপারে আলোচনায়। সংলাপের বাবা মাও উপস্থিত থাকেন সেখানে।

সুনেত্রার সবকিছু কেমন অসহ্য মনে হয়। ছুটে পালিয়ে আসে সেখান থেকে নিজের ঘরে। 

মন থেকে সংলাপকে তো এখনও মেনে নিতে পারেনি ও। তাই তো বারবার ওর ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাব কোনো না কোনোভাবে নাকচ করে দিয়েছে সুনেত্রা।

ক্রমে বিয়ের দিন এগিয়ে এল। বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের ভিড় বাড়ল। বনেদি বাড়ি আলোর মালায় সেজে উঠল। যন্ত্রচালিত পুতুলের মত সকলের সব নিয়ম মেনে চলতে লাগল সুনেত্রা। চারপাশের খুশির আমেজ ওর মনকে ছুঁতেও পারছে না। তাই তো লক্ষ্য করেনি, পরিবারসম সংকেত রায় ও তার স্ত্রী বাড়িতে অনুপস্থিত।

দুপুরবেলা বিখ্যাত পার্লার থেকে লোক এল তাকে সাজাতে। চোখের জলে ধুয়ে যাচ্ছে মেকাপ। বিরক্ত মেয়েটা তো বলেই ফেলল,

- "আজ আর কেঁদো না গো। কিছু কালকের জন্যেও তুলে রেখো। নয়ত আজ মেকাপ করতে করতেই লগ্ন পেরিয়ে যাবে।"

সুনেত্রা কিছু বলল না। কাকে আর বলবে ওর মনের কথা!! যার জন্য এই অবস্থা সে তো কোনোদিন জানতেও চাইল না।

সুনেত্রার বৃদ্ধা দিদা নাতনীর থুতনি ধরে তার মুখ তুলে ধরে বললেন,

- "ওলো, সুনি তোকে তো পুরো রাজরানী লাগছে। নাতজামাই না আবার ভিরমি খেয়ে যায়।"

মা দাঁত দিয়ে কড়ে আঙুলের নখ কেটে ছলছল চক্ষে বললেন,

-"নজর না লাগে।"

এইসময় সমবেত কন্ঠে নীচ থেকে চিৎকার এল, "বর এসেছে, বর এসেছে।"

মা তাড়াতাড়ি চলে গেলেন জামাই বরণ করতে। দিদাও গেলেন নাতজামাইয়ের সাথে একটু রঙ্গ রসিকতা করতে। ঘর ফাঁকা হলে, দাঁতে দাঁত চেপে সুনেত্রা চোখের জলকে আটকে নিল। মনে মনে বলল, "সব শেষ।" সুনেত্রাই ভুল ছিল। ঋষভ বরাবর ঐন্দ্রিলাকেই ভালোবেসে এসেছে। আর ওর প্রতি ছিল নিখাদ বন্ধুত্ব।

তুতো দাদা-ভাইদের কাঁধে চেপে পানপাতায় মুখ ঢেকে পিঁড়িতে করে ছাদনাতলায় পৌঁছোল। চারপাশ থেকে সমবেত কন্ঠে সবাই "এক, দুই" করে গুণছে। সাতপাক হতেই পিঁড়ি স্থির হল। পানপাতা সরিয়ে সামনে যাকে দেখল, তা তার কল্পনার অতীত।

বরবেশে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঋষভ। একপাশে হাসি মুখে ঐন্দ্রিলা আর অন্য পাশে সংলাপ। এ কি স্বপ্ন নাকি বাস্তব!!

লাল গোলাপ দিয়ে সাজানো ফুলশয্যার খাটে বসে অপেক্ষা করছে সুনেত্রা। দুটো দিন এক তুড়িতে কেটে গেল। ঋষভের সাথে আলাদা করে কথা বলারও সুযোগ পায়নি ও। সবকিছু জানার জন্য মনটা ওর ছটফট করছে। স্ত্রী আচার শেষ করে বৌদি স্থানীয়রা বিদায় নিয়েছে অনেকক্ষণ আগেই।

কারা যেন ঠেলে ঋষভকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে দিল। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বিছানার উপর বসল ও। সুনেত্রার ঘোমটা সরাতে যেতেই হাত চেপে ধরে সে বলল,

-"আগে আমায় বলো, এসবের মানে কি?? তোমরা সবাই সবকিছু জানতে কিন্তু কেউ আমায় কিচ্ছু বলেনি??"

-"আহা এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন?? সেসব জানার জন্য তো গোটা জীবন পড়ে রয়েছে।"

- "না, এক্ষুণি বলো।"

- "আচ্ছা, এই দুইদিনে সংলাপের পরিবার আর আমাদের ঘনিষ্ঠতা দেখে এটা তো বুঝেছ যে ওরা আমাদের আত্মীয়!! এবার বলি, সংলাপ আর আমি মাসতুতো ভাই। তুমি যখন প্রথম ওর ছবি পাঠালে তখন ও আমার পাশেই বসে ছিল। ছবি আর মেসেজ দেখে আমার সন্দেহ হল। আমি তোমার ছবি ওকে দেখালাম। তারপর আর কি!! সব কথা খুলে বললাম। বাড়িতে জানল, আপত্তির কোনো জায়গাই নেই। শুধু বলেছিলাম, তুমি যেন ঘুণাক্ষরেও কিছু টের না পাও। ব্যস, তারপর আর কি!! আজ তো আমাদের ফুলশয্যা। তাই.....।"

সুনেত্রার দিকে এগিয়ে যেতে চায় ঋষভ। লজ্জা রাঙা মুখে ব্যর্থ হাতে ওকে ঠেলে সরাতে চাইল ঋষভ। কিন্তু ততক্ষণে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy