শিপ্রা চক্রবর্তী

Classics Others

3  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Classics Others

জীবনদান

জীবনদান

5 mins
379



কুলাটি গ্রামের একে বারে শেষ প্রান্তে খড়ের ছাউনি দেওয়া বারান্দা সমেত একটা ছোট্ট ঘর রাধা বেনের। সারা কুলাটি গ্রামের মানুষ তাকে একঘরে করেছে দুটি কারনে..... একটা কারন তার স্বামী বছর কুড়ি আগে কুষ্ঠ রোগে মারা যান, আর দ্বিতীয় সে নাকি অপয়া!!!! তার ছায়া মাড়ালে সংসারের ক্ষতি হয়!

মুড়ি ,চাল, বাদাম, ছোলা এইসব ভাজা, বিক্রি করে কোন রকমে দিন চলে রাধা বেনের।কেউ ওর সাথে কথা বলাতো.... দূর! ছায়া পর্যন্ত এড়িয়ে যায়!!! বৈশাখ মাসের শেষের দিক টানা এক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি হয়ে চলেছে, অসময়ে যেন বর্ষা নেমে এসেছে প্রকৃতির বুকে, গ্রামের সমস্ত নদী, নালা, খাল, বিল জলে টইটম্বুর হয়ে গেছে, বৃষ্টির কারনে এই কটাদিন রাধার আর মুড়ি এবং চাল কোনকিছুই ভেজে ওঠা হয়নি!!তাই.... হাটে যাওয়ারও কোন কারন নেই!!! রাধা ঘরের টিনের বাক্স তে থাকা টাকা কটা গুনে একবার ঘরের শতছিদ্র হয়ে যাওয়া চালের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবল, এইবার বর্ষা আসার আগেই ঘরের চালটা ঠিক করে নিতে হবে, না.... হলে খোলা আকাশের নীচে থাকাও যা..... এই ঘরে থাকাও তাই হবে!!!! একটা লম্বা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে রাধা পড়নের অর্ধ ভেজা, ছেড়া শাড়িটা ঠিক করে গায়ে জড়িয়ে, নিজেকে কোন রকমের বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচিয়ে বারান্দার এক কোনে বসে বৃষ্টি পড়া দেখতে লাগল আর ওর জীবনের অতীতের স্মৃতির পাতা হাতড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল।

*****************************************

রাধা ছোট থেকেই বড় অভাগী! বাবা-মা কারোর ভালোবাসাই পায়নি!!!! কারন রাধাকে জন্ম দিতে গিয়ে রাধার মা... প্রান হারায়, বাবা আবার বিয়ে করে, কিন্তু সৎমা ভালোবাসা দিয়ে সুখের জীবন তৈরী করার পরিবর্তে রাধার জীবনকে দূর্বিষহ করে তুলেছিল!!!! তখন রাধার বয়স খুব কম, এই বছর তেরো-চৌদ্দর মেয়ে,আর রাধার স্বামীর ঘনশ‍্যামের বয়স প্রায় তিরিশ-বত্রিশের কাছাকাছি!!! ঘনশ‍্যামের ঘর,বাড়ি, চাল, চুলো, পরিবার, পরিজন বলে কিছুই ছিল না!!! রাধার সৎ মা.... রাধাকে যেমন ভাবে হোক ঘার থেকে নামাতে চেয়েছিলেন, তাই ঘনশ‍্যামের সাথে বিয়ে দেওয়া নিয়ে বিশেষ কোনো বাদ প্রতিবাদ হয়নি। আর রাধার বাবা সংসারের ব‍্যাপারে বড়ই উদাসীন ছিলেন। সেই ছোট বয়সে স্বামীর হাত ধরে এই কুলাটি গ্রামে আসে রাধা, শ্বশুরবাড়ি বলতে টালির চাল দেওয়া একটা ঘর আর একফালি উঠান, আর উঠানের ঠিক মাঝখানে একটা বড় বকুল ফুল গাছ। এই বাড়িতে এই গাছটা ছিল রাধার খুব প্রিয়। কারন মনের সমস্ত কথা রাধা একমাত্র এই গাছটাকে খুলে বলত এবং নিজেকে হালকা করত। প্রতিদিন স্বমীর লাথি, ঝাটা,গাল,মন্দ খেয়ে খেয়ে কেমন একটা গা... সওয়া হয়ে গিয়েছিল রাধার। রাধা ছোট থেকেই অত‍্যাচার সহ‍্য করতে জানে তাই.... কোনদিন চিৎকার, চেঁচামেচি এবং প্রতিবাদ করতোনা সবকিছু নীরবে মুখ বুজে সহ‍্য করে নিত, এটাই যেন ওর ধরন হয়ে গিয়ে ছিল।

কিন্তু রাধা যখন জানতে পারল সে মা... হতে চলেছে তখন সেই... শান্ত, সিষ্ট,ভীতু,সব অত‍্যাচার মুখবুজে সহ‍্য করা মেয়েটা হঠাৎ করেই প্রতিবাদি এবং সাহসী হয়ে উঠেছিল!! রাধার জীবনে শুরু হয়ে ছিল নতুন সংগ্রাম। রাধা নিজের সন্তানকে নিয়ে দুচোখে অনেক স্বপ্ন সাজালো, আর সংসারের অভাব মেটানোর জন‍্য কাজে লেগে পড়ল, রাধা মুড়ি, চাল, বাদাম, ছোলা এই সব ভাজত, আর ঘনশ‍্যাম বাড়ি থেকে কাজে বেড়িয়ে গেলে হাটে বিক্রি করতে যেত। তাছাড়া রাধা কাগজের ঠোঙ্গা বানানোর কাজও করত। রাধা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে.... করেই হোক ওর সন্তান কে..... লেখা পড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করবে।

কিন্তু ভাগ‍‍্যের নিষ্ঠুর পরিহাস ঠিকমত পুষ্টিকর খাবার, এবং যত্নের অভাবে রাধা এক অসুস্থ সন্তানের জন্ম দিল। ততদিনে রাধার স্বামীও কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। অনেক কষ্ট করে নিজেদের যেটুকু ধন-সম্পদ ছিল সর্বস্ব উজার করে দিয়েও রাধা তার সন্তান কে ফেরাতে পারেনি যমের দূয়ার থেকে!!!! রাধার এই চরম বিপদের দিনে কেউ রাধার পাশে দাঁড়ায় নি... অথচ গ্রামের চারিদিকে খবর ছড়িয়ে পড়েছিল রাধা নাকি অপয়া!!!! জন্মের পর মা..... কে খেয়েছে এখন নিজের সন্তান..... ওর ছায়া মাড়ানোও পাপ!!!! সন্তান হারানোর শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই.... রাধার স্বামী এই জগতের মায়া ত‍্যাগ করলেন। পুরো নিঃস্ব ও রিক্ত হয়ে পথে বসে গেল রাধা!!!!! গ্রামের লোক রাধা কে..... একঘরে করে দিল, অনেক কাকুতি মিনতি করার পর গ্রামের সীমানার শেষ প্রান্তে থাকার জন‍্য অনুমতি পেল রাধা।


*****************************************

হঠাৎ একটা শোরগোল এবং কান্নার আওয়াজে রাধার চিন্তা ভগ্ন হল, এবং নিজের চোখের কোনে আসা জলটাকে সযত্নে মুছে, কোন কথা না....ভেবেই বৃষ্টির মধ‍্যে ভিজতে ভিজতে ছুটে রাধা গ্রামের রাস্তায় বেড়িয়ে গেল। গিয়ে দেখল গ্রামের সজল ঘোষের বউ ফুলি, তার বছর তেরোর ছেলেকে বুকে নিয়ে কাঁদছে। এই পুরো কুলাটি গ্রামে একমাত্র এই সজল ঘোষের বউ ফুলি এবং তার ছেলে নয়ন ওর সাথে কথা বলে। রাধা নয়নকে খুব ভালোবাসে। তার সন্তান কে.... নিয়ে দেখা স্বপ্নের সন্ধান করে নয়নের মধ‍্যে।

----------রাধা ফুলির কাঁধে হাত দিয়ে বলল কি..... হয়েছেরে!!! কাঁদছিস কেন.....???

-----------ফুলি হাফুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বলল, রাধা দিদি আমার ছেলেটাকে সাপে কেটেছে, শহরে নিয়ে যেতে হবে!!!! কিন্তু কি.... করে নিয়ে যাব!!!! নয়নের বাবা গিয়ে ছিল গ্রামের মোড়লের বাড়ি টাকা ধার করতে, কিন্তু কেউ ধার দেয়নি!!!! ছেলেটাকে মনে হয় আর বাঁচাতে পাড়বোনা!!!!

------------এই কথাটা শুনে রাধার বুকটা কেঁপে উঠল, এবং চোখের সামনে ওর সন্তান হারানোর স্মৃতি ফুটে উঠল। রাধা বলল, তাড়াতাড়ি একটা গরুর গাড়ির ব‍্যাবস্থা কর, হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে!!! টাকার চিন্তা করিস না.....। এই বলে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। ঘরে ঢুকে টিনের বাক্স থেকে টাকা কটা নিয়ে পড়নের ছেড়া শাড়িটা ভালো করে কোমড়ে গুজে ঘরের ভাঙ্গা দরজাটা টেনে দিয়ে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রনাম ঠুকে বেড়িয়ে পড়ল রাধা। ফুলির হাতে টাকাটা দিয়ে বলল এই নে..... চিন্তা করিস না..... নয়ন ভালো হয়ে যাবে, চল তাড়াতাড়ি এখন!!!!

****************************************

সেদিনের পর পার হয়ে গেছে এক সপ্তাহ, নয়ন এখন সুস্থ, রাধা রোজ একবার করে এসে নয়নকে দেখে যায়।

ফুলি রাধার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, রাধা দিদি... আমরা সময় মতো তোমার ধার ঠিক শোধ.... দিয়ে দেব।

রাধা বলেছিল থাক আমি না.... হয় ও.... টুকু আমার ছেলের জন‍্য করলাম, কিরে করতে দিবিনা!!!!! নাকি.... আমার ছোঁয়া জিনিসে তোর ছেলের ক্ষতি হবে!

ফুলি রাধাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, তুমি অপয়া কেন হতে যাবে!!! তুমি আমাদের জীবনে ভগবান!!! আর মায়ের ছোঁয়ায় সন্তানের কোনদিনও ক্ষতি হয়না।

রাধা হেসে বলেছিল টাকা গেছে, আবার আসবে, ভালোবাসা হলো জীবনের আসল সম্পদ, যেটা মৃত্যুর পরও সবার হৃদয়ে বেঁচে থাকবে।

ফুলি অন্তরে গভীর শ্রদ্ধা থেকে রাধার পা.... ছুঁয়ে প্রনাম করেছিল। সত‍্যি সারা গ্রামের সমস্ত মানুষ এবং তাদের পরিবার যখন ওর পাশে দাঁড়ায়নি!!!! তখন এই সারা গ্রামের একঘরে হয়ে যাওয়া মানুষটা ওর পাশে দাঁড়িয়েছে এবং ঢাল হয়ে বিপদ থেকে আগলে রেখেছে, সত‍্যি ভালোবাসা অমূল্য সম্পদ! যাকে কোন কিছুর বিনিময়ে পাওয়া সম্ভব নয়!!! কারন ভালোবাসা অর্জন করে নিতে হয়!!





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics