জীবন
জীবন
অহনার নিজেকে আজ খুব অসহায় লাগছে, তার মনে হচ্ছে যেন পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। এতদিন আত্মীয় স্বজন, পাড়া-পড়শীর কথায় কান দেয়না তাদের কথা এড়িয়ে চলেছে । কিন্তু যখন বাবা তাকে এই কথা গুলো বলল, কথা গুলো তার মনে এসে আঘাত করল। বাবাও যে তাকে এসব কথা বলতে পারে বা ভাবতে পারে, এটা সে কল্পনা করে নি। এতদিন সে ভেবে এসেছে, এক মাত্র বাবা ই তাকে সাপট করে। তাই কথা গুলো আজ একে বারে অন্তরে গিয়ে লেগেছে। তার জীবনে ও এমন দিন আসবে, সে ভাবে নি।
অহনা গ্রাম বাংলার এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়ে। অহনারা দুই বোন, এক ভাই, অহনা ছোট ।দিদির উচ্চ মাধ্যমিক এর আগেই বিয়ে হয়ে যায়। দাদাও উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে পড়া ছেড়ে দেয়। অহনা কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকের পর থেমে থাকতে চায় না, আর ও পড়তে চায়। বাড়ীর লোক বা আত্মীয় রা চায় না, সে পড়াশোনা করুক, সবাই চায় দিদির মতো বিয়ে দিতে। তারা বলে - পড়াশোনা করে কি হবে, সেই তো শোশুড় বাড়ী গিয়ে খুন্তি পাস করতে হবে।
অহনা কার ও কথায় আমোল দেয় না, যত কষ্ট হোক, সে পড়বেই। বাবা ও চায় না পড়াতে, কারন কলেজে খরচা অনেক, সে চালতে পারবে না। হয়তো দিদি দাদা এই আর্থিক কারনে পড়াশোনা এগোতে পারল না। সেই সময় নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের তিন জনের পড়ার খরচ চালানো খুবই কষ্টের। অহনা টিউশানি করে নিজের পড়ার খরচা চালিয়েছে, বাবা শুধু ভর্তির জন্য টাকা দিয়েছে। বাকী বই- পত্র, কলেজে যাওয়ার গাড়ী ভারা, নিজের হাত খরচের টাকা সব নিজে চালিয়েছে। তাই পড়াশোনায় কোনো বাধা আসেনি। অহনাকে পড়াশোনা পাসাপাসি বাড়ীর কাজ ও করতে হয়েছে। শুধু রান্না করা না, চাষবাস, গরু দেখা শোনা সব। ছোট বেলা থেকেই চাষে কাজের সাহায্য করে এসেছে, জমিতে ফসল লাগানো থেকে ফসল তোলা পর্যন্ত সবই করতে হয়েছে।
এই ভাবে সে কলেজ শেষ করলো । আবার ওঠে বিয়ের কথা, আত্মীয় স্বজন উঠে পরে লাগে , তারা চায় বিয়ে দিয়ে দিতে। আর একটা কারন তাদের ছেলে মেয়েরা তো মাধ্যমিক ও পাস করে নি, তারা চায় না সে বেশি পড়ু।তারা বলে -অনেক তো পড়া হল, এবার বিয়ে টা কর, বেশি পড়লে তোর যোগ্যতায়, আবার ছেলে পাওয়া যাবে না। পাড়ার লোক বলে - বুড়ি তো হয়েগেলি, এবার তো বিয়ে কর। তোর বয়স ই মেয়ে দের ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেল, আর তুই এখন ও বিয়ে করলি না ।বিয়ে টা করলে একদিন তো খেতে পাব। দুই একটা দেখে শোনার ইন্টারভিউ দিয়েছে, কিন্তু পছন্দ হয়নি, হয় ছেলে বাড়ীর, নয় তাদের বাড়ীর পচ্ছন্দ হয় না
অহনা MA পড়তে চায়, সে 56% নিয়ে অনার্স পাস করেছে। MA টা করলে বিভিন্ন পরীক্ষায় বসতে পারবে। এখন আর প্রতি বছর SSC বা Primary পরীক্ষা হয় না। রেগুলারে ভর্তির ইচ্ছে ছিল কিন্তু ওই সময় থেকে পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি, রেগুলারে জায়গা পেল না, তাই ডিসটেনস এ ভর্তি হল। কয়েক টা কম্পেটেটিভ পরীক্ষা দিয়েছে কিন্তু কিছুই হল না। মাঝে মাঝে হতাস হয়ে যায়। এই ভাবে MA টা কমপ্লিট করে।
MA এর পর সে Bed করতে চায়। এখন আবার Bed না করলে SSC তে বসতে পারবে না। এমনি ই SSC হয় না, আবার যদি Bed না করে ,তাহলে আর বসতেই পারবে না। তাই বাবা কে অনেক বুঝিয়েছে, যদি টাকা গুলো জোগাড় করে bed করতে পারে। বাবা কিছুতেই চায় না এত গুলো টাকা নষ্ট করতে, তাও আবার বিয়ের জন্য জমানো টাকা। আত্মীয়, বন্ধুদের কেউ কেউ বলেছেন টাকা গুলো নষ্ট না করে বিয়ে দিয়ে দিতে, তাদের মধ্যে দুএক জন বলেছে ও যখন এতো করে চাইছে পড়িয়ে রাখ। চাকুরি করে তোমার টাকা ফিরে দেবে। শেষ মেষ বিয়ের জমানো টাকা দিয়ে Bed টা ও করে ফেলে।
এবার আবার সেই সমস্যা বিয়ে।পড়ার জন্য এতদিন কিছুটা চুপ ছিল। পরীক্ষা শেষ হতেই এক কথা, আর কত পড়বি ,তোর থেকে ছোট বোন গুলোর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, ভাই গুলো বিয়ে করে নিচ্ছে, আর তুই এখনও বিয়ে করলি না। কয়েক টা ছেলে দেখতেও এসেছে, তারা শুধু খেয়ে দেয়ে চলে যায় । ছেলের বাড়ীর পচ্ছন্দ হলে, ওদের হয় না, আর ওদের পচ্ছন্দ হলে, ছেলে বাড়ী থেকে খবর পাঠায় না।
অহনার আর ভালো লাগেনা। সেই উচ্চ মাধ্যমিকের পর থেকে যখন ই বলেছে তখনই বসতে হয়েছে। না বললে অন্য সমস্যা, নিশ্চয়ই কেউ আছে, তাহলে বসবে না কেন। জীবনে একটা প্রেমও করল না, এখন মনে হচ্ছে প্রেম করলে হয়তো এই সমস্যায় পড়তে হতো না। সব সময় প্রেম থেকে দূরে থেকেছে, বাবার সন্মানের কথা ভেবে। তার সমন্ধে বাবা কানে কোন কথা গেলে যদি পড়া বন্ধ করে দেয়, এই ভয়ে সে ওই পথে যায় নি। এতে ভগবান ও কিছুটা সাথ দিয়েছে, হয়তো কপালে প্রেম নেই, তাই কাউকে মনে লাগল না।
এখন জীবনে বড় সমস্যা,কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারে না, যে সে কি করছে। এখন আর আগের মতো নিয়মিত কোন পরীক্ষাই হয় না। একে বারে গ্রামে থাকে তাই কাজের সুযোগ তেমন নেই। শুধু টিউশানি পড়ায় তা ও বাচ্চাদের। বড়রা মেয়ে টিচারের কাছে ভালো পড়তে আসে না, যদি চাকুরি পেয়ে যায় তাহলে ছাত্র ছাত্রী অভাব হবে না। এখন কারো সাথে দেখা হলে একটা ই প্রশ্ন, - তাহলে এখন কি করছিস ???? এর উত্তর অহনার জানা নেই। বাড়ি থেকে পড়াশোনা এর কোনো মুল্য নেই। ছোট থেকেই গল্পের বই এর প্রতি নেশা, তাই লাইব্রেরী থেকে বই নিয়ে পড়ে। এই নিয়েও অনেক বলে , গল্পের বই পড়ে কি হবে, সারা জীবন তো পড়েই গেলি কিছু কি করতে পেরেছিস। কার ও উত্তরে যদি বলি, SSC প্রস্তুতি নিচ্ছি।তার উত্তরে বলে, SSC সে তো আর হয় না আর কবে হবে ঠিক নেই। বিষয় কি? বাংলা। কিছু টা মুখ বাঁকিয়ে, বাংলা, ওতে কোনো ভবিষ্যত আছে নাকি । তাই এখন আত্মীয়, পাড়া-পড়শী এড়িয়ে চলে, অনুষ্ঠান বাড়ীতেও সেই এক প্রশ্ন --- কি করছিস ??
জীবনের যেন কোনো মুল্য নেই, সে যে এত যুদ্ধ করে পড়াশোনা করেছে, এটা যেন কিছুই না। অহনা আজ সবার কাছে মূল্যহীনা। যদি চাকুরি পেত তাহলে সমাজের চোখে সম্মানীয় হয়ে যেত। এখন সমাজে পড়াশোনার কোনো মূল্য নেই, চাকুরির কাচ্ছে। শিক্ষিত বেকারের কোন জায়গা নেই সমাজে। তারা সমাজের হেলাফেলা মানুষ।মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনের সব থেকে ভালো সময়টা জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অথচ হেসে খেলে আনন্দে কাটিয়ে দিতে পাচ্ছে না। জীবন যেন স্রোতহীন নদীর মতো গড়িয়ে চলছে।
জীবন টাকে এই ভাবেই মেনে নিয়েছিল, কিন্তু বাবার এই কথা গুলো খুব খারাপ লাগছে। এইযে তার বিয়ে হচ্ছে না বা কাজ ও পাচ্ছে না তার জন্য অহনা দায়ী। সে আজ শুনল, সে নাকি অপয়া ,তার জন্য ভালো সমোন্ধ এসে ও ফিরে যায় । এতদিন সবাই সামনে পিছনে অনেক কথা বলেছে,সে সব কথায় কান দেয়না।কিন্তু বাবা মার মুখে এমন কথা শুনবে আসা করে নি।
হয়তো সবাই চাপে আজ বলতে বাধ্য হয়েছে। এই কথা গুলো ভুলতে অনেক সময় লাগবে ,তবে দাগ রয়ে যাবে। এই কথটা সে সব সময় মানে " যাকে তুমি ভুলতে পারবো না তাকে ক্ষমা করে দাও, আর যাকে তুমি ক্ষমা করতে পারবেনা তাকে ভুলে যাও"
সে বুঝতে পারেনা তার ভুলটা কোথায়। জীবনের সাথে সংগ্রাম করে পড়াশোনা করে, সাবলম্বী হয়ে, স্বাধীন ভাবে বাঁচতে চেয়েছে। নিজের মত জীবন গড়তে চেয়েছে, এটা কি তার অপরাধ। তাহলে জীবন টা কেন এমন হল। এর উত্তর অহনার জানা নেই,উত্তরের অপেক্ষায় দিন গুনছে।