হ্যাপি টেডিবিয়ার ডে
হ্যাপি টেডিবিয়ার ডে


"তুমি বিয়ে কর।"
আচমকা কথাগুলো কানে আসতেই চমকে উঠল দীপ। তাকিয়ে দেখল জানালার ধারে বসে থাকা এক বিধ্বস্ত মূর্তিকে। দুদিন আগেও যে মূর্তির সৌন্দর্যে বারেবারে মুগ্ধ হত দীপ, অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য মনটা আনচান করত আজ সেই মূর্তির চোখের নীচে রাত্রি জাগরণের চিহ্ন স্পষ্ট। ঘন কালো চোখ দুটোয় টলটল করছে জল। ডাক্তার বলেছিলেন যত দিন যাবে ওর মানসিক অবস্থা নাকি আরও খারাপ হয়ে, সত্যিই হচ্ছে তো তাই। ওর সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলরকে কি আজ আরেকবার ফোন করবে দীপ!
এখন সব কিছু বুঝেও না বোঝার ভান করল দীপ, "সে উপায় কি আর আছে! জীবনে কিছু সুযোগ একবারই আসে, আমার সে সুযোগ পাঁচ বছর আগেই গেছে।" এই বলে মুখে মেকি হতাশা সূচক শব্দ করল দীপ। আশা ছিল মেয়েটা একটু অন্তঃত হাসবে, কিন্তু নাহ… শ্রীতমা আগের মত ভাবলেশহীন গলাতেই বলল, "ডিভোর্স দিয়ে দেব। তুমি আবার মুক্ত হয়ে যাবে।"
"এসব তুমি কি বলছো শ্রী!" প্রতিবাদ করল দীপ। শ্রীতমা আগের মতোই উত্তর দিল, "আমার কারণে তুমি কেন সন্তানসুখ থেকে শুধু শুধু বঞ্চিত হবে দীপ?"
"আমাদের জীবন বা বিয়ের একমাত্র লক্ষ্য কি সন্তান? তোমাকে যখন বিয়ে করি তখন আমি শুধু তোমাকেই বিয়ে করেছিলাম, কোনো সন্তান উৎপাদনের মেশিনকে নয়। তাই প্লিজ এসব কথা আর বলবে না।"
একটা দীর্ঘশ্বাস এল শ্রীতমা।
শ্রীতমা আর দীপের ছিল ভালোবাসার বিয়ে। তাই দীপের বাড়ির লোক খুব একটা পছন্দ করত না শ্রীতমাকে। তারপর যখন ৫ বছর বিয়ের পরও ওদের সন্তান হল না তখন থেকে তো মানসিক যন্ত্রণা আরও বেড়ে গেলো। তবুও অনেক চিকিৎসার পর অবশেষে গর্ভবতী হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল শ্রীতমা। কিন্তু এত সবের পরেও ছোট্ট একটা ভুল আর সবকিছু শেষ। শ্রীতমার বহুদিনের শখ ছিল একটা ওর সমান উঁচু টেডি বিয়ার কেনার, তার গায়ের রং হবে টুকটুকে হলুদ। দীপের ইচ্ছে ছিল এই টেডি ডে'র দিন সে শ্রীতমাকে ওর পছন্দের টেডি বিয়ারটা উপহার দেবে। সেই মতো একদিন ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার পথে দীপ শ্রীতমাকে গাড়ির কাছে দাঁড় করিয়ে দোকানটায় ঢুকেছিল, ভেবেছিল বেরিয়ে এসে সারপ্রাইজটা দেবে। কিন্তু যখন মানুষ সমান উঁচু টেডি বিয়ারটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল দীপ, তখন চমকে গিয়েছিল নিজেই। ভালোবাসার সেই দুপুরের রাস্তার মাঝে সেদিন দীপ আবিষ্কার করেছিল নিজের ভালোবাসার রক্তাক্ত দেহটা। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছিল ওপাশের ফুটপাথের ধারে নাকি একটা ছেলে ছোটছোটো বাচ্চাদের পোস্টার বিক্রি করছিল। হয়তো শ্রীতমা ঐদিকেই যাচ্ছিল, কিন্তু ভারী শরীর নিয়ে দ্রুত রাস্তা পেরোতে না পারার ফলে ঘটে যায় দুর্ঘটনাটা। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ওদের জীবনটাই পাল্টে যায়। শ্রীতমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা বলে শুধু ওদের সন্তানই শেষ হয়ে যায়নি, শ্রীতমার শরীরের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো এমন ভাবে জখম হয়েছে যে ও আর কোনোদিনও মা হতে পারবে না।
দেখতে দেখতে সেই দিনের পর আরও একটা বছর কেটে গেল। আজ আবার টেডি বিয়ার ডে। রাস্তাঘাটে সবাই তাদের ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে ভালোবাসার সপ্তাহ যাপনে ব্যস্ত। শুধু দীপের জীবনটাই আজ অন্যরকম। সেদিনের কেনা সেই মানুষ সমান টেডি বিয়ারটা আজ অবহেলায়, অযত্নে পড়ে আছে ঘরের এক কোণে। প্রথম প্রথম শ্রীতমা ওটাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদত, তারপর কি হল কে জানে এখন ওটাকে আর সহ্যই করতে পারেনা সে। দীপ অনেকবার ভেবেছে ওটাকে ফেলে দেবে কিন্তু ফেলা আর হয়ে ওঠেনি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল দীপ। ডাক্তাররা বলেছিল কাউন্সেলিং করতে করতে শ্রীতমা ঠিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তে, কিন্তু কোথায় কি! আগের চেয়ে অবস্থা অনেকটা ভালো হলেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারল না আজও। কোনোদিনও হতে পারবে কিনা কে জানে! এদিকে দীপ স্পষ্ট বুঝতে পারে মা বাবার ইচ্ছে শ্রীতমাকে ছেড়ে দীপ অন্য কাউকে বিয়ে করুক। এমনিতেই শ্রী কে ওরা পছন্দ করতেন না। এখন তো আবার নতুন একটা কারণ এসে জুড়েছে। সবসময় বলতে থাকেন, "তাহলে কি নাতি নাতনির মুখ দেখা আমাদের ভাগ্যে নেই?" "তাহলে কি আমাদের বংশটা শেষ হয়ে যাবে এভাবে?" "তুই কিছু করবিনা বাবু? তোর কাছে তোর বউই সব? আমাদের কষ্টের কোনো মূল্য নেই?"
শ্রীতমাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা দীপ ভাবতেও পারেনা। কিন্তু তাও
দীপের মাঝেমাঝে বড় অসহায় লাগে নিজেকে। কি করবে কিচ্ছু বুঝতে পারেনা সে।
"দাদুভাই… দাদুভাই…"
সিঁড়ির কাছ থেকে কাঁপা কাঁপা গলাটা ভেসে আসতেই চমকে উঠল দীপ। ঠাম্মা…! শ্রীয়ের কপালে একটা চুমু এঁকে দিয়েই ছুটল দীপ। দেখলো বেশ সেজেগুজে লাঠি হাতে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছে ঠাম্মা। দীপকে দেখেই ধমকে উঠলেন তিনি, "আমি না বললে কোনদিকে হুঁশ থাকে না না? এতো গড়িমসি করলে চলে!"
"সরি সরি ঠাম্মা। চলো, আমি রেডি।"
ঠাকুমা নাতিকে এতো সাজগোজ করে বেরোতে দেখে অবাক গলায় দীপের মা জানতে চাইলেন, "কোথায় যাচ্ছ তোমরা? এই ক'দিন আগেও তো কোথায় যেন গিয়েছিলে।"
"সেটা আজ আমরা ফিরলেই জানতে পারবে বৌমা। "
এই বলে ঠাম্মা গুমগুম করে বেরিয়ে গেলেন গেটের দিকে। দীপের মা হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রয়ে গেল ঘরে।
★★★★★
"ওরা কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করতে পারলে না?"
"জিজ্ঞেস কি করিনি ভেবেছো? তোমার মা আমাকে জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলে তো।"
"উফফ এতক্ষণ হয়ে গেল, কোথায় যে রইল ওরা!"
বিকাশ বাবু আর নিভা দেবীর কথার মাঝেই গেটের সামনে গাড়ি থামার শব্দ হল।
"ওই এলো বোধহয়।"
একটু পরেই দীপ এসে ঢুকল ঘরে। বিকাশ বাবু ছেলেকে দেখামাত্রই হুঙ্কার ছাড়লেন, "কোথায় গিয়েছিলি! বাড়িতে বলে যাওয়ার প্রয়োজনবোধ করিস না?"
"আর মাই বা কোথায় গেলেন?"
"তোমরা শান্ত হও। ঠাম্মি আসছে।"
বলতে বলতেই ঠাম্মি পর্দা সরিয়ে ঢুকল এই ঘরে। তাঁকে দেখেই চমকে উঠলেন বিকাশ বাবু আর নিভা দেবী। বৃদ্ধার কোলে একটি বছর ছয়েকের শিশু ঘুমিয়ে আছে তোয়ালের মধ্যে।
"এ কে?"
"কোথায় পেলে এতটুকু বাচ্চা?"
"আরও কেউ এসেছে নাকি?" প্রশ্নটা করতে করতে পর্দার ওপ্রান্তে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন বিকাশ বাবু। কিন্তু তাকে আটকে দিয়ে তাঁর মা বলে উঠলেন, "দেখার প্রয়োজন নেই। কেউ নেই বাইরে।"
"তাহলে এই বাচ্চাটা…"
"এই বাচ্চাটা আজ থেকে আমার দাদুভাই আর নাত বউয়ের সন্তান।"
"কি!"
"তুমি কি পাগল হয়ে গেলে মা? কার বাচ্চা এটা?"
"বললাম তো তোমাদের ছেলের সন্তান।"
"তোমরা তারমানে কোথাকার কোন অনাথ আশ্রম থেকে তুলে এনেছো এটাকে?"
"ভদ্র ভাবে কথা বলো বাবু। আজ থেকে এ তোমার নাতনি।"
"বললেই হল মা? আপনি নিজে নিজে এতো বড় সিদ্ধান্ত কি করে নিলেন? আমাদের একবারও জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধ করলেন না?"
"কি জিজ্ঞেস করবো তোমাদের বৌমা? তোমরা শুধু মা-বাবাই হয়েছ সন্তানের মন বুঝতে চেষ্টা করোনি কোনদিনও, আর শ্বশুর-শাশুড়ির শুধু নামে হলেই হয় না, একটা পরের বাড়ির মেয়ে এসে শ্বশুর শ্বাশুড়ীকে মা-বাবা কেন বলে জানো ?কারণ সে বিশ্বাস করে যে শ্বশুর শ্বাশুড়িও এই দ্বিতীয় বাড়িতে তার মা-বাবা হয়ে উঠবে। কিন্তু তোমরা পারোনি তা করতে। আজ একবছর ধরে দেখেছো সেই মেয়েটার অবস্থা? সন্তানহারা মায়ের যন্ত্রণা বোঝার চেষ্টা করেছো কোনদিন? নাহ, বোঝার চেষ্টা তো করোইনি উপরন্তু নিয়মিত ভাবে তাকে মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে গেছো আরো যতটা বেশি করে পারো ততটা। তার মানসিক অবস্থা এমনিতেই ভালো নয়, তোমাদের ছেলেও সবকিছু নিয়ে বিধ্বস্ত। সেখানে তোমরা দুজনকে সান্তনা দেওয়ার বদলে শুধু মানসিক চাপ দিয়ে গেছো। সমস্যা সমাধানের চেষ্টা তো করোইনি, উল্টে সমস্যাকে আরো কি করে জটিল করা যায় তার ব্যবস্থা করেছে বারবার। কিন্তু তোমরা যা পারো আমি তো তা করতে পারিনা। আমি তো তোমাদের মা, তাই তোমরা কিছু ভুল করলে সেটা শুধরাবার দায়িত্বটাও আমার। সেই জন্য তোমরা যা পারোনি আমাকে সেটাই করতে হয়েছে। আমি দায়িত্ব নিয়েছি আমার দাদু ভাই আর তার বউয়ের জীবনটা নতুন করে সাজাবার। তাই বলে দিচ্ছি আজ থেকে এই বাচ্চা হবে আমার দাদু ভাইয়ের মেয়ে।"
"কি বলছ কি মা? তুমি বলে দিলেই হলো নাকি কোথাকার কার রক্ত কে জানে সে আমার সংসারকে কলুষিত করবে না তার কি মানে আছে?"
" ও তাই বুঝি তাহলে তো বলতে হয় তোমাকে ওই পরিবারে আনা আমার মস্ত বড় ভুল হয়ে গিয়েছিল। তুমি তো জানোই বাবু যে আমি তোমার নিজের মা নই। আমি তোমার পিসি, তোমার মা বাবা যখন মারা গেল আমি তখন তোমাকে আমার কাছে এনেছিলাম। আমার ভয় ছিল যে তোমার পিসেমশাই বা তাঁর পরিবার কিভাবে তোমাকে একসেপ্ট করবেন। কিন্তু জানো ওরা কোন আপত্তি করেননি। ওরা বলেনি যে তুমি তাদের রক্তকে কলুষিত করবে।"
"মা…"
"তাই বলছি সবসময় চেষ্টা করবে সন্তানকে সঠিক ভাবে মানুষ করার। চেষ্টা করলে আমার বিশ্বাস সব সন্তানই মানুষ হবে, আর না পারলে সবাই খারাপ। আর একটা কথা তোমাদের বলে দিচ্ছি শোনো আমার দাদু ভাই বা তার বউকে তোমরা যদি সন্তানকে নিয়ে আর কোনো রকম মানসিক যন্ত্রণা দাও তাহলে আমি বলছি ওরা আজ থেকে তোমাদের এই বাড়িতে থাকবে না, ওরা নিজেদের মতো করে ওদের সংসার সাজাবে। এবার তোমরাই ভেবে দেখো কি করবে তোমরা?"
মায়ের এহেন ঘোষণায় চমকে গেলেন বিকাশ বাবু আর নিভা দেবী। বৃদ্ধা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বললেন, "দাদুভাই যাও তোমার মেয়েকে নিয়ে যাও নাত বউ এর কাছে।" এই বলে সদ্য আনা ছোট্ট শিশুটিকে তুলে দিলেন দীপের হাতে। আর তখনই কোথাও থেকে একটা ডুকরে কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। সবাই চমকে উঠে তাকিয়ে দেখলেন কখন যেন শ্রীতমা এসে দাঁড়িয়েছে সিঁড়িতে। হয়তো শুনেছে সবটাই। ঠাম্মা তাকে বললেন, "আয় এদিকে আয়। মেয়ের মুখ দেখবি না?"
শ্রীতমা হয়তো এই ডাকটাই অপেক্ষাতে ছিল। এক ছুটে এসে দীপের হাত থেকে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল। ওইটুকু বাচ্চাও কি বুঝলো কে জানে, এতক্ষণ ছটফট করছিল কিন্তু শ্রীতমার কোলে যাওয়া মাত্রই ছটফটানি থেমে গেল তার। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শ্রীতমার মুখের দিকে। শ্রীতমা ওকে বুকে জড়িয়ে ওর মাথায় চুমু দিতেই খিলখিল করে হেসে উঠল বাচ্চাটা।
"আমি… আমি তোর মা...আমি তোর মা…" বিড়বিড় করল শ্রীতমা। দীপ এগিয়ে গিয়ে ওদের আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল, "গত বছর এই টেডি বিয়ার ডে'র দিনে আমাদের সবকিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, আজ আবার একটা অন্যরকম টেডি উপহার দিলাম তোমায়। পছন্দ হয়েছে?"
"হুঁ। খুব..."
"ঠাম্মি আমাদের এলোমেলো হয়ে যাওয়া জীবনটা আবার নতুন করে সাজানোর চেষ্টা করছে এতো, আমরাও চলো আবার ভালো থাকার চেষ্টা করি।"
দীপের মুখের দিকে খানিক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল শ্রীতমা। তারপর বাচ্চাটাকে দীপের কোলে দিয়ে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল ঠাম্মিকে, "আজ তুমি ছিলে বলে আমি মা হওয়ার সুযোগ পেলাম ঠাম্মি।"
"আর আমি বাবা।" এই বলে দীপ আর ওদের মেয়েও এসে জড়িয়ে ধরল ঠাম্মিকে।
আর অন্যদিকে ঘরের কোণে পড়ে থাকা প্রকান্ড টেডিবিয়ারটা আজ মুচকি হাসল নিজের মনে।