হঠাৎ
হঠাৎ
তিন্নি কয়েকদিন ধরে ঘুমোতে পারছে না। ঘুমের যে ওর কোনো অসুবিধা আছে তা কিন্তু নয়। বরং উল্টোটাই তিন্নি শুলেই ঘুমিয়ে পড়ে, শুধু তাই না ঘুমিয়ে পড়লে যদি ওকে ডাকাত টেনেও নিয়ে যায়, ও টের পর্যন্ত পায়না। এমন বিখ্যাত ঘুম তিন্নির। আর সেই মানুষটাই নাকি ঘুমহীন।
বিষয়টা কি তা বলতে গেলে তিন্নি বিষয় খুলে বলতে হয়। তিন্নি বছর ঊনত্রিশের মেয়ে। না বিয়ে এখনো করেনি। সরকারি চাকরির চেষ্টা করছে। না পেলে পরের বছর নিজের সব স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে হয়তো ওকে বিয়ের পিরিতে বসতে হবে, তা বুঝে গিয়েছে তিন্নি। ও আপনারা ভাবলেন এইজন্য তিন্নি ঘুমহীন। তা কিন্তু নয়, মেয়েটা যথেষ্ট মনোযোগী। দেখতে খারাপ না। মাষ্টার্স আর বিয়েড সব করা আছে।সে আশা করছে একটা চাকরি ও ঠিক নিতে পারবে। আসলে সে কারো ঘাড়ের ওপর ভর করে জীবন কাটাতে চায়না। তাই এই লড়াই করছে। নইলে বিয়ে করে বরের পয়সা সে চাইলেই ওড়াতে পারতো। কিন্তু নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য সে লড়াই করে যাচ্ছে। সে প্রতিষ্ঠিত হতে চায় আরও একটি কারণে, বড় সন্তান হিসেবে সে বাবা মায়ের দায়িত্ব নিতে চায়। হ্যাঁ তার দুই যমজ ভাই আছে বটে। কিন্তু সে মনে করে তাকে জন্ম দেওয়া থেকে বড় করতে যে কষ্ট ত্যাগ ওর মা-বাবাকে সইতে হয়েছে। ভাইদের জন্য সমান কষ্ট সইতে হয়েছে। তবে কেন সে মেয়ে বলে বড়র কর্তব্য পালন করবে না?
আসলে ওর ভাগ্যটাই মন্দ, কোনো দিনও খারাপ ফল করেনি। কিন্তু অর্থ বিনা চাকরি নেই আর বিগত প্রায় বছর ছয় ধরে স্কুল সার্ভিস কমিশন বন্ধ দেখে ও অকুল পাথারে পড়েছে। বেসরকারি চাকরি করবে অদ্ভুত মহামারী লকডাউন আর করোনার জন্য সেটাও নেই ভাগ্যে। একটা বেসরকারি চাকরি পেয়েছিল। করোনার জন্য সেই চাকরিটাও চলে গিয়েছে। তিন্নির মতো শক্ত মনের মেয়েও মাঝে মাঝে মানসিক অবসাদে চলে যায়। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্যে নিজের জীবনে একটা প্রেমও আসতে দেয়নি সে৷ লেখাপড়া আর নিজের পায়ে দাঁড়ানোই ছিল ওর স্বপ্ন। যখন জীবনের একমাত্র স্বপ্নটা শেষ হয়ে যেতে দেখে। মনে মনে শেষ হয়ে যেতে থাকে সে। তারই মাঝে মাস ছয়েক ধরে চলা গৃহবন্দী আর মাস দুয়েক ধরে চলা সুশান্ত সিংয়ের আত্মহত্যা তিন্নিকেও মনে মনে দূর্বল করে তোলে। এরই মাঝে ফেসবুকে সে নিজের মনের অভিব্যক্তিগুলো পোস্ট করতে থাকে।
যেমন - " আত্মহত্যা কেউ শখে করে না,করে অনেক অনেক বুক ফাঁটা যন্ত্রণায়"-
দেখা যায় সেই লেখাগুলো অনেকের মনের কথা হয়ে উঠেছে। অনেকে তিন্নিকে ব্যক্তিগতভাবে মেসেজ করলেও, তিনি উত্তর দেয়না কাউকে। কিন্তু একদিন একজনের মেসেজে চোখ আঁটকে যায় তিন্নির।
" কথা বলা কি বারণ?"
তখন তিন্নি উত্তর দেয়, বলে " বলুন।"
এমন করেই হালকা টুকটাক কথা হয়। তিন্নি খুব বেশী অনলাইনে থাকে না। আজকের মেসেজের কাল বা পরশু উত্তর দেয়।
এই জন্য অপর পাশের মানুষটা জোর করতে থাকে হোয়াট অ্যাপ মেসেজের নাম্বারের জন্য। তিন্নি তিন চারদিন এড়িয়ে যায়। আসলে ওর হাতে সময় নেই। তার নিজের ফোকাস থেকে সরতে চায়না তিন্নি। কিন্তু মানুষটার কথায় সে মানুষটাকে বন্ধু ভেবে ফেলে।তিন্নির আসলে বন্ধু সংখ্যা খুব কম,তিন্নি কাউকে সহজে বন্ধু ভাবতে পারেনা, আর বন্ধু ভাবলে খুব বিশ্বাস করে ।তাই সে হোয়াট অ্যাপ নাম্বারটা বিশ্বাস করে দিয়েই দেয়। সেখানে মেসেজে কথা হয় টুকটাক।
তিন্নি হোয়াটসঅ্যাপও কম করে।
অপর প্রান্ত থেকে তাই মেসেজ ভেসে আসে - " আপনি কি জন্য নাম্বার দিলেন? "
তিন্নি- " কেন?"
" আপনি তো থাকেন না,কার সাথে কথা বলব?"
তিন্নি খালি ইমোজি পাঠায়৷ আসলে কম কথা বলা ওর স্বভাব।
তবে আগের তুলনায় ইদানিং বেশ অনলাইনে থাকছে,অবশ্য তিন্নি বলে কম শোনে বেশী, হোয়াটসঅ্যাপেও তাই করছে।তবে অন হলেই উত্তর দিচ্ছে। তিন্নির মনে একটাই টার্গেট ওকে দাঁড়াতে হবে নিজের পায়ে। অপর প্রান্তের মানুষটা কাজের খোঁজ আছে বলে তিন্নির অনুমতি নিয়ে তিন্নিকে ফোন করে। তিন্নিও কাজের খোঁজ পেয়ে মন দিয়ে শুনে কি কাজ। কাজটা খারাপ না,ইন্সুইরেন্স এর কাজ। কিন্তু বাবা অনুমতি না দেওয়ায় কাজটা হাতে নিতে পারেনা সে। কিন্তু অপর প্রান্তের মানুষটার সাথে কথা হয়। তিন্নিকে মানসিক অবসাদ থেকে বের হতে বলে। বোঝায় সব ঠিক হয়ে যাবে। তিন্নি জানে ঠিক হওয়ার আর কিছু নেই, তবুও নতুন বন্ধুর কথা শুনে কিছু সময়ের জন্য ওর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় সব ঠিক হয়ে যাবে। তিন্নি বন্ধু ভাবে তাই সুপ্রভাত, শুভ রাত্রি পাঠায়।
হঠাৎ একদিন,প্রাথমিক পরিচয় পর্বের এক সপ্তাহের মধ্যে তিন্নির নতুন বন্ধু তিন্নিকে প্রোপজ করে।তিন্নি আকাশ থেকে পড়ে। তিন্নি সোজাসুজি জানায় সে বন্ধু ভেবেছে তাকে, অন্য চোখে দেখেনি।
মানুষটার ব্যবহার কেমন যেন অন্য রকম হয়ে যায়। তিন্নিকে স্বার্থপর বলে। বলে " আপনি বড্ড স্বার্থপর, তাই নিজের মতো করে ভাবেন। অন্যের ভাবনাকে সম্মান দেন না। "
তিন্নি সেটা শুনে কষ্ট পেলেও খারাপ ভাবে না৷ সত্যি তো সে স্বার্থপর নইলে বাবা-মায়ের ঘাড়ে এতোদিন বসে থাকতনা। বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে পারতো সে।
তারপর কথা বন্ধ হয়ে যায়...
তিন্নি আজও খুঁজে চলছে নিজের ভুলটা।সত্যি কি ও স্বার্থপর? প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দৌড়ে সে পাগল হয়ে গিয়েছে? কে জানে? আজ প্রতিটি ঘরে ঘরে শিক্ষিত বেকারদের অবস্থা এই। না পারছে ওরা মরতে, না বাঁচতে।আর না পারছে সব ধরনের কাজ করতে। জীবনটাকে বোঝা আর দুঃসহ তাদের কাছে। নিজের স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া নিজের মৃত্যুর থেকেও অসহনীয়। কিন্তু বর্তমান শিক্ষিত সমাজ এই অসহনীয় যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বহন করে চলেছে নিজের জীবনের বোঝাকে।
তারা হঠাৎ করে বন্ধু পেয়ে আবার হারিয়ে ফেলে, হারানো যার দোষেই হোক, হারানো ভাগ্য যে আজ শিক্ষিত বেকারদের ভবিতব্যে।