হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ
হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ
ভাবতেও গর্ববোধ হয় আজকের প্রখ্যাত লেখিকা সুমিতা বসু আমার ছোটবেলার বন্ধু সুমিতা। স্কুলে পড়ার সময় দেখতাম স্কুল ম্যাগাজিনে লেখা দিত, সেসব ছাপাও হতো। কিন্তু ও যে এত নাম করে ফেলেছে তা জানতে পারিনি কখনও। মাঝে বেশ কিছুদিন যোগাযোগ ছিল না আমাদের,পরে এক বন্ধু মিনা স্কুলের সব বন্ধুদের নিয়ে একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ করায় এখন আমাদের সবার সঙ্গে সবার বেশ সুন্দর একটা বন্ধন তৈরি হয়েছে। আমরা বেশ আড্ডা দিই গ্রুপে। বন্ধুরা সব দেশে বিদেশে,কত দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিন্তু এই একটা জায়গায় আমরা সবাই মিলতে পারি। অনেক ভালোবাসা মিনাকে সবাইকে এক জায়গায় নিয়ে আসার জন্য। গ্রুপে আড্ডা দিলেও সুমিতা ওর লেখিকার পরিচয়টা আমাদের কাছে চেপে রেখেছিল। রত্না কিভাবে জানতে পেরে একদিন ওকে চেপে ধরলে ও ধরা পড়ে যায়। বলে,"তোদের কাছে আমি শুধুই বন্ধু,লেখিকার পরিচয়ের দরকারটা কি?" আমি বলি,"সে তো ঠিকই, তবে আমাদের গর্ব করার সুযোগটা তো তুই দিবি?" কদিন সুমিতাকে নিয়ে চলল। রত্না বলল, "তোর এই লেখালেখির ইচ্ছেটা,অনুপ্রেরণাটা তুই কোথায় পেলি রে সুমি? আমাদের তো মনেও আসেনি কখনও আর পারিও না লিখতে। একইসঙ্গে তো লেখাপড়া শিখলাম আর দেখ তুই হয়ে গেলি লেখিকা আর আমরা?" মিনা ধরল সুমিতাকে, "বল সুমি,তোর লেখিকা হওয়ার জার্নিটা,খুব শুনতে ইচ্ছা করছে।"
সুমিতা বলে,"আমায় তোরা পাগল করে দিবি দেখছি।কি লেখিকা লেখিকা করছিস খালি বলতো?" আমিও বলি,"বল না সুমি প্লিজ"। অগত্যা রাজী হল সুমিতা,আমাদের সুমি। বলল, "অত লিখতে পারছিনা, অডিও ভার্সনে বলছি তোরা শোন।" ও বলতে শুরু করে, "তোরা তো জানিস আমি স্কুল ম্যাগাজিনে লিখতাম। সেটাও লেখার আগে খুব ছোট্ট থেকেই নানারকম বই পড়ার নেশা ধরে গিয়েছিল আমার। বাবা নানারকম বই এনে দিতেন, 'দাদুর দস্তানা', 'ঠাকুরমার ঝুলি', 'আরব্য রজনী', 'শুকতারা', 'সোভিয়েত দেশের রূপকথা' এরকম নানান বই। শুকতারায় হাঁদাভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট পড়ার জন্য দিদির সঙ্গে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। যবে থেকে বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগ পড়তে শিখেছি,তবে থেকেই এসব পড়তে শুরু করেছি। পড়তে পড়তে পড়াটা নেশা হয়ে গেছে তখন থেকেই। মাকেও দেখতাম অবসর পেলেই বই হাতে। এরই মধ্যে কবে একদিন হঠাৎ করে খাতায় একটা ছড়া লিখে ফেললাম, আর এই লিখে ফেলাটায় আমি নিজেই খুব খুশি হয়ে গেলাম। সেদিন এই নিজের প্রথম লেখার প্রেমে পড়ে গেলাম আমি। বলা যায়,এই লিখে ফেলাটাই আমার লেখালেখির অনুপ্রেরণা। তখন থেকেই লিখি,কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে। কাউকে দেখাই না বা বলি না যদি জানতে পেরে কেউ হাসাহাসি করে। এরপর স্কুল ম্যাগাজিনে লেখা দিয়ে নিজের নামটা ছাপার অক্ষরে দেখে ভীষণ আনন্দ হল। ততদিনে রাক্ষস, খোক্ষস, ভূত-পেত্নী, লালকমল-নীলকমল সব হজম। তোদের মনে আছে পুনোদার বইয়ের দোকান? পুনোদাকে? স্কুলের গেটের বাইরে দোকান ছিল পুনোদার,এখনও আছে। পুনোদা এখন বুড়ো হয়ে গেছে। ক্লাস ফাইভ থেকেই স্কুলে ঢোকার আগে পুনোদার দোকান থেকে নতুন একটা করে বই চেয়ে নিয়ে ঢুকতাম, ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে পড়ে ফেলতাম আবার ছুটির পর দোকানে বই ফেরত দিয়ে আসতাম। এই যে পুনোদা আমায় ভরসা করে নতুন বই হাতে দিত,এও তো আমার অনুপ্রেরণা। এছাড়া স্কুল লাইব্রেরি থেকে সপ্তাহে একটা করে বই দিত সেতো গোগ্রাসে গিলে তোদের বইগুলোও পড়ে ফেলতাম। একসপ্তার মধ্যে তা তিন-চারটে এক্সট্রা বই তো পড়া হতোই নিজেরটা ছাড়া। আর এই নেশার মত এত বই পড়ার পর দেখলাম অবসরে ছড়া,কবিতা ছাড়াও গল্পও বেশ লিখতে পারছি। প্রতিবছর স্কুলের টিচাররা ম্যাগাজিনের লেখা চাইতেন, দিতাম লেখা। প্রতিবছর লেখা ছাপা হতে লাগলো। এরপর ক্লাস এইটে পড়ি যখন অরবিন্দ জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে মায়াদি আমায় অরবিন্দ সম্বন্ধে লিখতে বললেন। তখন নেট ছিল না, স্কুল লাইব্রেরীতেও অরবিন্দের উপর তেমন কোনো বই ছিল না, বাবা কলকাতা থেকে বই কিনে এনে দিলেন, সেটা পড়ে লিখে ফেললাম। আর এই যে আমায় লিখতে বলা অর্থাৎ আমার লেখার ওপর ভরসা করাটাও আমায় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। আর প্রথম গল্পের বই বাবাই কিনে দিয়ে নেশাটা ধরিয়েছিলেন।
তোরা সবাই জানিস না হয়ত,কারণ সবাই তো লেখালেখি করতিস না যে ক্লাস ইলেভেনে বয়েজ স্কুল থেকে গল্প লেখার একটা ইন্টারস্কুল কম্পিটিশন ডাকা হয়েছিল। মায়াদি আবার আমায় লেখা দিতে বলেন আর লেখা দিয়ে আমি ফার্স্ট হই ঐ কম্পিটিশনে। লীলা মজুমদারের একটি বইও পুরস্কার পাই তাতে। ওই স্কুলের হেডমাস্টার মশাই বলেছিলেন, "যারা লেখালেখি করে পুরস্কৃত হলে,তাদের মধ্যে লেখক হবার গুনাগুণ আছে বলেই পুরস্কার পেলে। তারা কখনও লেখা ছেড়ো না,দিনে ১৫মিনিট হলেও কিছু লিখবে। কথাটা মনে বেশ দাগ কেটেছিল,সেটা আমি আজও ভুলিনি,তবে মেনে চলতেও পারিনি। তখন বেশ বোকা ছিলাম। ওই স্কুল থেকে আমার নাম জোগাড় করে বিভিন্ন ছোট পত্রিকায় লেখার জন্য আহ্বান করা হতো, তখন গা করিনি,না হলে অনেক আগেই লেখিকা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেতাম হয়তো। এরপর কলেজ ম্যাগাজিনে লিখতাম। উচ্চশিক্ষা করতে গিয়ে সব বন্ধ হয়ে যায়,তারপর বিয়ে,ছেলে,মেয়ে, সংসার নিয়ে নাজেহাল,লিখব কি? কিন্তু ভেতরের লেখক সত্ত্বাটা মরেনি দেখলাম। ছেলেটা একটু বড় হতেই ঝক্কিটা যেই কমল দেখলাম ভিতরে আবার কবিতা আসছে। লিখতে শুরু করলাম খাতায় আর অবশ্যই চুপিচুপি। কখনও রাতে বিছানায় শুয়ে আছি পূর্ণিমার চাঁদের জোছনায় বিছানা ভেসে যাচ্ছে,এক অপূর্ব মায়াময় পরিবেশ, দুটো লাইন মাথায় চলে এল। উঠে পড়লাম, যেই দুটো লাইন লিখে ফেললাম আরো দুটো লাইন চলে এল মাথায়। পরে আবার তা বাড়িয়ে নিতাম। তাহলে প্রকৃতি ও আমার অনুপ্রেরণা এছাড়া আমার মেয়ে একবার আমার কবিতার খাতা দেখে ফেলে,তখন একটু বড় হয়েছে ও। আমায় আদর করে বলে, "লিখে রাখো মা ডায়েরিতে,আমি বড় হয়ে তোমার বই বার করব।" এ যে কত আনন্দের,কত বড় অনুপ্রেরণা কি আর বলি। অনুপ্রেরণা আমি কতভাবে পেয়েছি,দুঃখেও পেয়েছি। ছেলেমেয়ে বাড়ি ছেড়ে পড়তে গেলো সারাদিন একা,কত আর কাজ থাকতে পারে? সেলাই করি,টিভি দেখি,ঘর গোছাই, হাতের কাজ করি, মনের খোরাক পাইনা। এরমধ্যে তোরা তো জানিস আমার প্রিয় দিদিটা কত অল্প বয়সে মারা গেল। আমরা পিঠেপিঠি হওয়ায় কত বন্ধুত্ব ছিল আমাদের মধ্যে,তোদের অনেকের সঙ্গেও তো দিদির বন্ধুত্ব ছিল, তখন সারাদিন চোখের জল পড়ে চোখ লাল হয়ে ফুলে থাকত সর্বদা। আমার মেয়ে আমার ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলে দিল এসব নিয়ে মন ভালো থাকবে বলে। বিশেষ কিছু করতাম না তখন ফেসবুকে। এর মধ্যে আমার এক পরিচিত, আমার ফ্রেন্ডলিস্টে রয়েছে,সে একটা কবিতা লিখে পোস্ট করে ফেসবুকের একটা গ্রুপে। আমার তখন এইসব গ্রুপ সম্বন্ধে ধারণা ছিল না ততো। ওর কবিতায় আমি কমেন্ট দিই একটা কবিতা লিখে। ওর খুব পছন্দ হওয়ায় ও তখন আমায় চেপে ধরে লেখার জন্য। ও জানতো না আমি লিখি,কিন্তু লুকিয়ে। বললাম ওকে,ভীষণ জোর করলো লেখা পোস্ট করতে। ওর জোরাজুরিতেই আমি প্রকাশ্যে এলাম। তাহলে ও ও তো আমার অনুপ্রেরণা।
শুরু হলো আমার লেখালেখির জার্নি। বুকের ভেতরের অসহনীয় কষ্টটা আস্তে আস্তে সহ্যের মধ্যে এলো। যেগুলো আনম্যানেজেবল ছিল সেগুলো ম্যানেজ করতে পারলাম এই ফেসবুকের দৌলতে,যদিও ভেতরটা সবসময় কাঁদত,বড্ড দিদিকে পেতে ইচ্ছে করত,কিন্তু তা তো হবার নয়। তখন দিদিকে নিয়ে কবিতা লিখি,গল্প লিখি, সব দিদিময় জগত আমার। নিজেকে সামলাই, নানারকম লেখালেখি শুরু করি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা ছাপা হলে খুব আনন্দ হয়,এই ছাপা অক্ষরে নিজের নাম দেখাটাও একটা বিরাট অনুপ্রেরণা। এই অনুপ্রেরণাই আমার নিজের বই বার করতে সাহস জোগালো। বেশ কয়েকটা বই বেরোলো আমার। গল্প, কবিতা,প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী,ভুতের গল্প, কল্পবিজ্ঞান সব রকমের লেখার চেষ্টা করি,পারি না মোটে রম্য লিখতে। মনের মধ্যে কষ্ট পুষি বলেই হয়তো রম্য ঠিক আসে না। যাই হোক, এভাবেই আমার পথ চলা, আর লেখালেখি করে আমি আমার ননদ, ননদাই, এক ভাইয়ের বউ, এদের কাছে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে শুরু করি, আর এরা আমায় বরাবরই প্রচুর উৎসাহ দিয়ে এসেছে। আমার ননদাই তো বারবার বলেন, "কখনও কোনও পরিস্থিতিতে ছেড়ো না তুমি লেখালেখিটা, এগিয়ে যাও"। কি যে ভালো লাগে,আরো লেখার ইচ্ছেটা জাগে তখন। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা বেরোলে মনে হয়েছে আরো ভালো লিখতে হবে,নিজের সঙ্গে নিজের চ্যালেঞ্জ। এছাড়া গল্প লিখে যখন প্রথম টাকা পেলাম মনে হলো লেখালেখির প্রতি আমার দায়বদ্ধতাটা আরো বেড়ে গেল। মনে হতে লাগলো যেন আরো আরো ভালো লিখতে পারি। সারাদিন যেটুকু সময় পাই লেখা আর পড়া এই নিয়েই থাকি,এতে মানসিকভাবে আমি অনেক ভালো আছি। আর আছেন মা,আমার বই বেরোলে মা যে কি খুশি হন! মনে হয় আরো লিখে মাকে আরো খুশি দিই। তাই এই লেখিকা হয়ে চলার পথে কত কিছুই আমায় অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে, তোরা চেপে ধরলি আজ তাই সব খুলে বললাম, নে তোদের শান্তি হয়েছে তো?"
রত্না,মিনা,আমি আরো সবাই সুমিতার লেখিকা হবার জার্নিটা জানলাম, বললাম, "আসলে তোর ভিতরে লেখিকা সত্ত্বা আছে বলেই তুই এসবগুলোয় অনুপ্রেরণা পেয়েছিস। আমরা এই সমস্ত পেলেও পারতাম না। কলমের আঁচড়ে গল্প-কবিতা ফুটিয়ে তোলা আমাদের কম্মো নয়।"
সুমিতা বলল, "বেশ নে,সব শুনেছিস, আর এ নিয়ে কোনো কথা নয়, এখানে আমরা সবাই বন্ধু, মজা করবো, গল্প করবো, আড্ডা দেবো,চান্স পেলে মিট করব ব্যস।"