STORYMIRROR

গরম ভাত

গরম ভাত

6 mins
340


দুপুরের রোদে তীব্রতা কমে বিকেলের দিকে পা বাড়াচ্ছে সময় ।

এক তলায় মায়ের ঘরে জানলার পাশে বসে ফোন বান্ধবীর কথা বলছে স্বর্ণালী। একদম রাস্তার পাশে ই জানলা। পিচ রাস্তার উল্টো দিকেই ডাস্টবিন থেকে প্লাস্টিক নিয়ে রাস্তায় ছড়াচ্ছে দুটো কাক ।

একটা দুটো গাড়ি মাঝে মাঝে হর্ন বাজিয়ে ছুটে চলেছে । তবুও বেস শান্ত শিষ্ট পরিবেশ ।

স্বর্ণালী বলল,

- ধুর আজ কতো দিন হলো , বাইরে যাই না কবে যে এই লক ডাউন উঠবে। জাস্ট হাঁপিয়ে উঠেছি ।

ফোনের ওপ্রান্ত থেকে অনু সহমত পোষণ করে বললো,

- হ্যাঁ রে আর বলিস না সত্যি বড্ড দম বন্ধ লাগছে।

- শেষ কবে কে সিনেমা দেখতে গেলাম মনে পরে না । আর আমাদের ফেভারিট পিৎজা হাট ..!! আর থাকতে পারছি না রে ।

- জানিস আমি তো বাড়িতে বসে বসে জাস্ট মোটা হয়ে যাচ্ছি । লক ডাউন উঠলে জিম জয়েন করবো ।

- আমাকেও সাথে ডেকে নিস তবে ,

শান্ত দুপুরে কলকাতার বড় রাস্তার ধারে কোনো এক বাড়ির জানলার পাসে দুই বান্ধবীর ফোনের কথোপকথন বেশ জমে উঠেছে ।

এর মধ্যেই হঠাৎ কথার মাঝেই স্বর্ণালী কে চমকে দিয়েই , জানলার ওপার থেকে একটা বৃদ্ধ কণ্ঠ বলে উঠলো।

- মা দুটো ধুপকাঠি কিনবে ?

স্বর্ণালী চমকে উঠে তাকালো ।

দেখলো একজন বৃদ্ধ মানুষ । মানুষটির জরাজীর্ণ শরীর । বয়েসের ভারেই পিঠ টা কুঁজো হয়ে গেছে । পরনে একটা সাদা পাঞ্জাবি , সেটা আর সাদা নেই রং বদলে সেটা ধূসর হয়েছে বললেই চলে । মুখের চামড়া কুচকে গেছে । গাল দুটো ভেঙে ভেতরে ঢুকেছে । তাতেও খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি । মুখে অনেক কষ্ট আনা হাসি আর চোখ দুটো তে ক্লান্তি মাখানো।

স্বর্ণালী কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে ছিলো ওই বৃদ্ধের দিকে।

ফোনের ওপ্রান্ত থেকে অনু বললো,

- কিরে , হ্যালো কথা বলছিস না কেন?

- আচ্ছা তুই এখন রাখ আমি তোকে পরে ফোন করছি ।

বৃদ্ধ তখনও একটা হাতে ধুপ কাঠির প্যাকেট এগিয়ে রেখে আবার বললো,

- নেবে মা ধুপ কাঠি?

- দাদু ঘরে অনেক ধুপ কাঠি আছে আর নিয়ে কি করবো?

- এক টা নাও মা । সকাল থেকে একটাও ধুপ কাঠি বিক্রি হয় নি।

কথা টা বলতে গিয়ে বৃদ্ধের গলা টা কেঁপে গেলো ।

স্বর্ণালীর বুকের ভেতর টা কেমন যেনো ফাঁকা হয়ে গেলো ।

সে বলল,

- আচ্ছা আপনি সামনের দিক থেকে ঘুরে , বাড়ির গেটের কাছে আসুন।

মা পাশে টুবাই দা দের বাড়ি গিয়েছে , স্বর্ণালী বাড়িতে একা । সে গেট খুলে দিলো। বৃদ্ধ ধুঁকতে ধুঁকতে এসে বসলো গেটের সিঁড়ির উপর ।

বৃদ্ধ কে দেখে কেমন জানি মায়া হলো ওর ।

সে বলল ,

- জল খাবেন দাদু ?

বৃদ্ধ মাথা তুলে হাসি হাসি মুখে বললো,

- দাও মা একটু জল , বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।

জল আর ফ্রিজে রাখা মিষ্টির প্যাকেট থেকে দুটো রসগোল্লা বের করে নিয়ে এলো সে।

বৃদ্ধ বললো,

- এই গুলো কেনো আনলে?

- দুপুর বেলা গৃহস্তের বাড়িতে কাউকে শুধু জল দিতে নেই ।

তৃপ্তি করে মিষ্টি আর জল খেয়ে বৃদ্ধ , তাঁর কাছে কি কি ধূপকাঠি আছে সেটা বলতে থাকলো ।

স্বর্ণালীর সেই দিকে কোনো খেঁয়াল নেই। সে বৃদ্ধর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে । এই মানুষ টিকে দেখে ওর ঠাকুর দার কথা মনে পরে যাচ্ছে।

সে জিজ্ঞেস করলো,

- আপনার বাড়িতে কে কে আছে ?

বৃদ্ধ হেঁসে উত্তর দিলো,

- আমি আর আমার বউ ..।

- ছেলে মেয়ে নেই?.

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে , বৃদ্ধ বললো,

- এক ছেলে ছিলো? গত বছর মারা গেছে .....

বলতে গিয়ে বৃদ্ধের চোখের কোন ভিজে এলো ।

কথা টা শুনে স্বর্ণালীরও কষ্ট হলো।

বৃদ্ধ বললো,

- সে ট্রেনে হকারি করতো । জানো মা ওই ট্রেনেই ছিলো ওর রুজি রুটির পথ। আর ওই ট্রেনে-ই ওর জীবন কেড়ে নিল। ট্রেনের নিচেই কাটা পরে ......

স্বর্ণালী দেখলো বৃদ্ধের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে ।

স্বর্ণালীরও চোখ টা ভিজে এলো ।

সে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলার জন্য বললো,

- জুঁই ফুলের গন্ধের ধুপ কাঠি নেই ?

বৃদ্ধ ব্যাগ থেকে দুটো প্যাকেট বের করে বললো,

- হ্যাঁ সব আছে মা , তোমার কোনটা চাই বলো?

- আচ্ছা দাদু তোমার কাছে যা ধুপ কাঠি আছে সব গুলোর দাম কতো হবে ?

বৃদ্ধ একবার হাসি মাখা ভেজা চোখে স্বর্ণালীর দিকে তাঁকিয়ে বললো,

- সব?

- হ্যাঁ সব!!

একটু হিসেব করে বৃদ্ধ বললো,

- ৮২০ টাকা মা ।

স্বর্ণালী সব ধূপকাঠি গুলো নিয়ে গিয়ে ঠাকুর ঘরে রাখলো ।

তারপর ফিরে এসে বৃদ্ধ কে দুটো ৫০০ টাকার নোট দিলো ।

বৃদ্ধ ফ্যাল ফ্যাল করে তাঁকিয়ে বললো,

- আমার কাছে ভাংটি নেই যে মা । সকাল থেকে একটা ও বিক্রি হয় নি ।

- ঠিক আছে দিতে হবে না আপনি রাখুন ।

- না মা তা হয় না ।

- দাদু বাড়িতে কেউ নেই , আমার কাছেও তো ভাং টি নেই ।

বৃদ্ধ একটু চিন্তায় পড়ে গেলো ।

কিছু একটা ভেবে ,

স্বর্ণালী বলল,

- আপনি কোথায় থাকেন ?

- ওই যে বঙ্কিম নগর রেল লাইনের পাশেই একটা বস্তিতে ।

- আমি প্রায় ওই দিকে যাই । তবে এর পর যখন যাবো আপনার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসবো ।

বৃদ্ধ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে কি ভাবলো তারপর বললো,

- ছেলের পর আমিও ট্রেনে হকারি করতাম । কিন্তু এই কি একটা রোগ এলো আমাদের কাজ কর্ম বন্ধ হলো । ট্রেন চলে না আমরা কোথায় যাবো বলো মা? আমার বউ খুব অসুস্থ । ওষুধ কেনার টাকা অবধি নেই। আর পাড়ায় ঘুরে ঘুরে এই ধূপ কাঠি বিক্রি হয় না। ট্রেনে তাও একটা দুটো কেউ কিনত। আর এখন তো আবার সব পাড়াতে ঢুকতে অবধি দেয় না । কতো কতো দিন না খেয়ে থাকতে হয় আবার কোনোদিন যদি একটু কপাল ভালো থাকে মাঝে মাঝে মুড়ি কিনে খাই । এই তো গত পাঁচ দিন থেকে শুধু জল মুড়ি খাচ্ছি ।

কিন্তু বিবেকে বাঁধে ভিক্ষাও যে করতে পারি না ।

বলতে বলতে বৃদ্ধ কান্নায় ভেঙে পড়ল ।

স্বর্ণালী কি বলবে বুঝতে পারছিল না ।

স্বর্ণালীর হঠাৎ মনে পড়ে গেলো কোনো এক খবরের কাগজে লিখেছিল । এই লক ডাউনে রাজ্যের সকল মানুষ কে ফ্রীতে রেশন দেওয়া হবে ।

সে বলল,

- সেকি সরকার তো ফ্রীতে রেশন দিচ্ছে , আপনারা চাল ডাল পান না ?

বৃদ্ধ একটু হতাশা মাখানো গলায় বলল,

- মাস পাঁচেক আগে কতো গুলো সাহেব এসে বললো, আমরা নাকি এই দেশের নাগরিক না , কি সব কাগজ পত্র নাকি আমাদের নেই ।

কিন্তু আমি বুঝে পেলাম না, এই দেশের নাগরিক যদি না হই, তবে গেলো বার আমরা ভোট দিলাম কি করে ? পড়াশুনা জানি না তো মা , তাই এই সব কিছু বুঝি না । আমাদের কোনো রেশন কার্ড হয় নি তাই রেশন ও পাই না ।

কিছু ক্ষণ চুপ থেকে বৃদ্ধ আবার ছল ছল চোখে বললো,

- আমার বউ কদিন থেকেই একটু গরম ভাত খেতে চেয়েছিল , আজ হয়তো একটু চাল কিনতে পারবো ।

স্বর্ণালী ভেজা চোখে একটু হাসির চেষ্টা করলো ।

বৃদ্ধ বললো,

- ভগবান আছেন , সে সব দেখছেন । ভগবান তোমার মঙ্গল করুক মা ।

বড় রাস্তায় নেমে , বৃদ্ধ তার কুঁজো শরীর টা টেনে নিয়ে চলল সামনের দিকে । স্বর্ণালীর চোখ জলে ঝাপসা হয়ে আসছে । তাঁর মনে একটাই কথা বার বার সেলের মতো বিঁধছে ...

"সত্যি কি ভগবান আছেন ?"

এর মধ্যে মা এসে হাজির হাতে একটা সাদা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ।

হাসি মুখে এগিয়ে এসে বললো,

- এই নে তোর টুবাই দা দুটো পিৎজা অর্ডার করেছিলো একটা তোর জন্য আর একটা ওর জন্য । তোর ফেভারিট চিকেন পিৎজা।

প্যাকেট টা টেবিলে রেখে স্বর্ণালী বসার ঘরের জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো । ফাঁকা রাস্তার দিকে তাঁকিয়ে ওর মন টা ভারী হয়ে আসলো ।

উপরে যাওয়ার সময় মায়ের চোখ পড়ল ঠাকুর ঘরের দিকে। ঠাকুর ঘরের মেঝেতে এতো গুলো ধুপ কাঠির প্যাকেট দেখে মা স্বর্ণালীকে জিজ্ঞেস করলো ....

- এতো ধুপ কাঠি কে দিলো?

বাইরের দিকে তাঁকিয়ে স্বর্ণালী জবাব দিলো ,

- আমি কিনেছি মা !!

- ঘরে আগের থেকেই অনেক গুলো ছিলো আবার এতো গুলো কিনলি কেনো?

স্বর্ণালীর বুক ভেঙে কান্না আসতে চাইছে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল সে । মা কাছে এসে ওর হাত টা ধরে বললো,

- কি রে বল, কেনো কিনলি এতো ধুপ কাঠি?

স্বর্ণালী মাথা তুলতেই ওর মা দেখলো মেয়ের চোখ দুটো জলে ভেসে যাচ্ছে।

ভেজা গলায় স্বর্ণা উত্তর দিল ,

- কেউ একজন গরম ভাত খেতে পারবে তাই কিনেছি মা ....



రచనకు రేటింగ్ ఇవ్వండి
లాగిన్

Similar bengali story from Classics