গোড়ায় গলদ
গোড়ায় গলদ
ক'দিন ধরেই রীতা দেখছে ওর বাড়ির দুটো কাজের মেয়ে পাপিয়া আর মমতা একটি বছর দশেকের মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে আসছে। উপরে আসেনা,নিচেই থাকে। পাপিয়াকে জিজ্ঞেস করতে বলল, "ওর নাম সুজাতা,মা রান্নার কাজ করে,বাবা ড্রাইভার,গাড়ি চালায়। সকালেই বাবা-মা বেরিয়ে যায়,বাড়িতে কেউ থাকেনা তাই ও পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়, আমাদের সঙ্গে আসতে চায় তাই নিয়ে আসি"। রীতা একদিন নিচে নেমে দেখে মমতা বাসন মাজছে আর সুজাতা ধুয়ে দিচ্ছে। ওইটুকু মেয়েকে দিয়ে কাজ করাচ্ছে বলে রীতা খুব রাগ করে। মমতা বলে,"বৌদি মা বাড়ি থাকে না তো,ওর খিদে পায়,আমাদের জলখাবার থেকে ওকে খেতে দিই তো তাই নিজেই বাসন ধুয়ে দিতে চায়"। ওইটুকু মেয়েকে দুটো খাবারের জন্য বাসন ধুতে দেখে রীতার খুব মায়া হয়,বলে "ওঠ তোকে বাসন ধুতে হবে না,আমি তোকে এমনিই খেতে দেব"। সেই থেকে ও রীতার কাছে আসা যাওয়া করে। মেয়েটা খেতে খুব ভালোবাসে,আবার কাজ করারও আগ্রহ খুব। টুকটাক ফাইফরমাশ খাটে,রীতার ওর ওপর ক্রমশ বেশ মায়া পড়ে যায়। ছেলেমেয়ে বাইরে পড়াশোনা করে,ওদের ছেড়ে মনটা বেশ ভাল লাগে না,সুজাতা পায়ে পায়ে ঘোরে,জেঠিমা জেঠিমা করে,রীতার বেশ লাগে। এতে ছেলেমেয়ের জন্য মনখারাপটা একটু কম হয়। রীতা ওকে পড়াতে চায়,ও রাজি হয়না, বলে," টিউশনে স্যার পড়িয়ে দিয়েছেন লাগবে না। আর এখন পাশ-ফেল তো নেই তাই এমনিই ক্লাসে উঠে যাব"। সুজাতা তখন ক্লাস সিক্স। রীতা তার স্বামীকে বলে,"কি সাংঘাতিক এই শিক্ষাব্যবস্থা। এতে ছেলেমেয়েরা কি শিখবে? কেউ তো পড়াশোনা করছে না এতে।" ক্লাস নাইনে উঠলে সুজাতা বলে,"আমি আর পড়ব না"। "কেন পড়বি না?" রীতার পাল্টা প্রশ্ন।"পড়বি না তো কি করবি? এখন থেকে সাতবাড়ি কাজ করে বেড়াবি?" " আমি পড়া কিছু বুঝতে পারছি না"। "আমি যে তোকে আমার কাছে পড়তে বলি আর তুই বলিস টিউশনে স্যার সব পড়িয়ে দিয়েছেন। আজ থেকে দুবেলা আমার কাছে পড়বি,আমাকে পড়া দিবি"। রীতা বই নিয়ে আসতে বলে ওকে,প্রথমদিকে রাজি হয় না, এরপর বকাবকি করলে বই নিয়ে আসে,বসে বসে পড়ে রীতার কাছে। ওকে ইংরেজি পড়াতে গিয়ে দেখে ক্লাস নাইনের মেয়ে আর্টিকেল কাকে বলে জানে না। রীতা ওকে পড়ায় ঠিক যেমন নিজের ছেলেমেয়েকে পড়াত। পড়াতে ও ভালোবাসে,আর তাছাড়া একটা গরিবের মেয়ের যদি কিছু উপকার হয়। ক্লাস ফাইভ থেকে এইট,এই চারবছর এরা পড়াশোনার কিছু শেখেনি বললেই চলে। এই পাশফেল শিক্ষাব্যবস্থায় এদের ভবিষ্যৎ একেবারে শেষ,বেশিরভাগই ক্লাস নাইনে গিয়ে পড়া ছেড়ে দেয় আর বেরিয়ে পরে কাজে। কিন্তু সুজাতাকে রীতা ভালোবেসে ফেলেছে,ওকে ও তৈরি করবেই ঠিক করেছে,এটা নিজের কাছেই ওর একটা চ্যালেঞ্জ। পড়াতে গিয়ে দেখে মেয়েটি বেশ বুদ্ধিমতী,চট করে ধরে নিতে পারে,কেবল এই শিক্ষাব্যবস্থার শিকার হয়ে ওর ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে বসেছিল,ভাগ্যি রীতার কাছে এসে পড়েছিল ও।
আগে স্কুল অ্যাবসেন্ট হত সুজাতা প্রায়ই,এখন জেঠিমার শাসনে রোজ স্কুলে যায়। রীতা ওকে নতুন স্কুলড্রেস,স্কুলব্যাগ,নতুন নতুন বই সব কিনে দিয়েছে। রীতার কাছ থেকেই স্কুলে যায় আবার স্কুল থেকে ফিরে বাকি সময় রীতার কাছেই থাকে। আজকাল স্কুলে যাবার কত আগ্রহ হয়েছে সুজাতার,পড়া বুঝতে পারে যে। ফিরে জেঠিমার কাছে স্কুলের গল্প না বলতে পারলে ওর শান্তি হয় না। খাতাভরা অঙ্ক এতদিন দেখিয়েছে ও জেঠিমাকে কিন্তু লসাগু,গসাগুও করতে শেখেনি। এসব দেখে রীতা অবাক হয়ে যায়। সুজাতা বলে,"খাতায় স্যার করিয়ে দিয়েছেন,মুখস্থ করে নেব"। রীতা হাঁ,বলে কি মেয়ে! বলে,"আর যদি সংখ্যাগুলো পাল্টে দেয় কি করবি?" এতদিনে ও বুঝতে পারে অঙ্কটা শেখার জিনিস,মুখস্থর নয়,ওটা শিখতে হবে। তাই জেঠিমার কাছে রোজ অঙ্ক শেখে ও আর শিখতে পেরে বেশ ভালও লাগে। ছুটির দিনে শুধু অঙ্কটাই করে। এছাড়া জেঠিমা মুখে মুখে বাংলা,ইংরেজি,ইতিহাস,ভূগোল সব পড়ায় ওকে। পড়ায় বেশ আগ্রহ হয়েছে ওর এতদিনে।
ক্লাস টেন হল সুজাতার। টিভি চ্যানেলে মাধ্যমিকে কি ধরনের প্রশ্ন আসতে পারে এমন প্রোগ্রাম হয়,রীতা বসে বসে দেখে সেসব,সেইমতো সুজাতাকে তৈরি করে। এছাড়া নিজেও ভেবে চিন্তে বইতে দাগ দিয়ে দেয়, কারণ এই চার বছর পাশ-ফেল না থাকায় কিছুই প্রায় পড়ে নি,শেখেও নি,অনেক পিছিয়ে আছে ও,সব পড়তে গেলে পারবে না,তাই সিলেবাস একটু ছোট করে দিলে সুবিধা হবে। পড়ায় সুজাতার বেশ মন হয়েছে। ওর পড়ার আওয়াজে বাড়িটা গমগম করে,রীতার খুব ভাল লাগে। সুজাতাকে পড়াতে দেখে মমতার আক্ষেপ,"আমাদের যদি কেউ এরকম করে পড়াত,একটু লেখাপড়া শিখতে পারতাম,অক্ষরই তো চেনা হল না এজীবনে"। বোর্ডের পরীক্ষা দিতে যাবার আগে জেঠিমাকে প্রণাম করে যায় সুজাতা। বাংলা পরীক্ষা দিয়ে লাফাতে লাফাতে এসে বলে, "ও জেঠিমা,তুমি যা যা বলেছ তাই এসেছে,রচনাটাও"। ইতিহাস,ভূগোল পরীক্ষা দিয়ে এসে জেঠিমাকে বলে," যা যা দাগ দিয়ে দিয়েছো জেঠিমা,তাই এসেছে "। এরপর পরীক্ষায় ৫৬% নম্বর পেয়ে পাস করল সুজাতা কেবল অঙ্কে ৩৪। "তবু এইটুকুও যে ওকে শেখাতে পেরেছি", ভাবে রীতা। এরপর ওকে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি করে বইপত্তর কিনে দিয়ে পড়ায় রীতা। এবার ও আর্টস নিয়ে পড়ে আর পড়াটা এখন ওর বেশ নেশা হয়ে গেছে। একটা পাশ করার পরে আশপাশের লোকদের কাছে ওর কদরও বেড়েছে। এবারেও ৫৩% নম্বর পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলে রীতা ওকে কলেজে ভর্তি করে দেয়। ভাবে গ্রাজুয়েশনটা হলে কোথাও একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে,কত চেনাজানা তো আছে ওদের, মেয়েটার সারাজীবনের একটা হিল্লে হয়ে যায় তবে। আর তাছাড়া অনেক কান্ড করে রীতা ওর স্বামীকে দিয়ে ওর একটা সিডিউলড কাস্টের সার্টিফিকেট বার করিয়েছে,এছাড়া একটা নার্সিংহোমে বলেও রেখেছিলেন তার স্বামী ওকে কাজে নেবার জন্য।
হলে হবে কি,এত কাণ্ড করে টেনেটুনে কলেজ অবধি নিয়ে যাবার পর প্রথম বর্ষ পড়ার পর কন্যাশ্রী বাবদ ২৫হাজার টাকা পেয়ে সুজাতা আর পড়তে চায় না। রীতা জানতে পারেনি,কিছুদিন যাবৎ ও একটি ছেলের প্রেমে পড়েছিল,তাকে বিয়ে করার জন্য তখন অস্থির। সুজাতার গ্র্যাজুয়েশন আর হল না,সে এখন এক ছেলের মা। রীতা অবসরে বসে ভাবে,মনে দুঃখ হয় তার,"এত করে সুজাতাকে তৈরি করলাম,সে পড়াশোনাটাই করল না ভাল করে!" তার আর কিই বা করার ছিল,ওর যে গোড়ায় গলদ। ছোট থেকে পড়াশোনায় দুর্বল হয়ে ক্লাসে উঠেছে ঠিকই উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে,কিন্তু উচ্চশিক্ষার ভিতটাই তৈরি হয়নি ওর। রীতা অনেক বুঝিয়েছিল বিয়ের পর পড়াশুনোটা চালিয়ে যেতে,সুজাতা অকপটে স্বীকার করে যে ওর দ্বারা আর হবে না।