গগনচুম্বী
গগনচুম্বী


সেদিনও বলাকা টিফিন নিয়ে গেল না এইরকম প্রায় তিন দিন হল ও টিফিন ভুলে গেল। আজও রুপাদি ওকে টিফিন খাইয়ে ছাড়লো। সত্যি এটা ঠিক হচ্ছে না। বুঝতে পারছে কিন্তু কি করবে আসার সময় এত তাড়াহুড়ো যে কিছুতেই মনে থাকেনা টিফিন টা নেওয়ার জন্য। মায়ের বকুনি খায় কিন্তু কি করবে । আজ অফিসে এসে কাজে মন বসলো না। কেনো কে জানে ক'দিন ধরে মনটা খুব খারাপ। অকারণে এইরকম মন খারাপ ওর হয়।
"কিরে বলাকা কাজ করবি না ? "পাশ থেকে রুদ্রা বলে উঠলো
"হ্যা কাজ তো করতেই হবে অফিসে যখন এসেছি"
"শোন বলাকা আজ না সিনেমা যাবো যাবি আমার সাথে ?"
"নারে আজএকটু তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে।"
রুদ্রা চলে যেতেই বলাকা রুপার কাছে গিয়ে বসলো।
"রুপাদি আজ একটু এক্সেল টা শিখিয়ে দাও না গো"
বলাকার গলায় অনুরোধের সুর
"আচ্ছা একটু বস আমি দিচ্ছি"
রূপা কিছুক্ষণ নিজের কাজ সেরে এক্সেল টা খুলল। বলাকা অনেকদিন ধরে রূপাকে বলছিল যে কম্পিউটার টা খুব একটা ভালো করে শেখা হয়ে ওঠেনি ওর।
কিন্তু রূপা শেখাবে কখন ওর যা কাজের চাপ। তাও এত কাজের মধ্যেও রুপা চেষ্টা করে বলাকা কে কম্পিউটার টা শিখিয়ে দিতে।
বলাকার পরিবার বলতে শুধু মা আর দশ বছরের ছোট ভাই। রুপা যদি ওকে সাহায্য না করত আজ যে ওর কি হতো তা ভগবানই জানে। এই চাকরিটাও হয়তো ওর পাওয়া হয়ে উঠত না।। রুপার সাথে ওর আলাপ একটা বন্ধুর বাড়িতে। ও যখন শুনেছিল রুপা একটা প্রাইভেট ফার্মে ম্যানেজারের চাকরি করে তখন ওকে অনুরোধ করেছিলো যদি একটা চাকরি কোন ভাবেও পেতে পারে। রুপা কথা রেখেছিল। ওকে কোন ইন্টারভিউ দিতে হয়নি। প্রথম দিন এসে দেখা করার পরের দিনই চাকরিতে জয়েন করে। অফিসের পরিবেশ টা ভালোই লাগে। শুধু অফিসের বস মোহন বাবুকে ওর একটুও ভালো লাগে না। কেমন যেন একটু গায়ে পড়া। রূপাদি কিন্তু সব জানে। বলাকা কে বলেই রেখেছে মোহন বাবুর সাথে খুব একটা কথা বলার দরকার নেই। কিন্তু মালিক বলে কথা সে ডাকলে রুপাকে তো যেতে হবেই।
সেদিন সকাল থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। বলাকা ভাবলো অফিস যাবে না। কিন্তু রুপার ফোনে ওকে যেতেই হলো। অফিস গিয়ে বুঝলো রুপা সেদিন একটা কাজে আসানসোল যাবে। তাই বলাকা অনুপস্থিত হলে ওর অসুবিধা হতো। রুপা জানে যদি কোনদিন বলাকা কে ডাকে বলাকা না করতে পারবে না। তাই এত বৃষ্টির মধ্যে ও ওকে অফিস যেতেই হলো। অবশ্য রূপা চায় বলাকাকে ঠিকমতো তৈরি করে দিতে যাতে রূপার অনুপস্থিতিতে বলাকা কাজ চালিয়ে নিতে পারে। সেটা বলাকা বেশ ভালোভাবেই জানে। মোহন বাবু সেদিন রুপার সাথে আসানসোল গিয়েছিলেন। রুদ্রা অফিসে আসেনি । কাজের চাপ বেশী ছিল সেদিন। বলাকার বাড়ি যেতে বেশ রাত হল। বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ডিনার করতে যাবে সেই সময় রূপার ফোন এলো
"বলাকা কাল অফিসে কয়েকজন ক্লায়েন্ট আসবে, তুই কনফারেন্স রুমে বসিয়ে সৌভিক কে ডেকে দিস, আমি হয়ত দেরি করে ঢুকবো"
"ঠিক আছে তোমার কোন চিন্তা নেই, সৌভিক কে নিয়ে আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব" বলাকার গলায় আত্মবিশ্বাসের সুর।
এরপর কিছুক্ষণ দুজনের কিছু অফিশএর কথা বার্তা হয়।
পরেরদিন বলাকা খুব তাড়াতাড়ি অফিসে বের হয়। কনফারেন্সটা ঠিকঠাক করার জন্য একটু উত্তেজনা ছিল। রূপা সেদিন ফিরতে না পারলেও বেশ কয়েক বার ফোন করে খবর নিয়েছে।
সেদিন সৌভিকের থেকে বলাকা রূপার সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছে। যতটা সহজ মনে হয় মানুষটা কে ততটা সহজ সে নয়। সৌভিক রুপার বেশ কয়েক বছর আগেই অফিসে জয়েন করেছিল। রুপার আগে ম্যানেজারের পদটা ওই সামলাতো। রুপা এই অফিসে জয়েন করার পরেই বুঝতে পেরেছিল উন্নতি করার জন্য মোহন বাবুই তার সিঁড়ি। মোহন বাবুর মহিলাদের প্রতি দুর্বলতা রুপাকে সুযোগ করে দিয়েছিল। এই জায়গায় সৌভিক পিছিয়ে পড়ে আর রূপা তরতর করে ওপরে উঠে যায়। সৌভিকের সেই কষ্টটা সেদিন বলাকা বেশ উপলব্ধি করেছিল । মোহন বাবু বিবাহিত এবং দুই সন্তানের পিতা। রুপাও খুব ভালো করে সেটা জানে। কিন্তু গগনচুম্বী আশা তার , সে একদিন অনেক বড়লোক হবে। মোহন বাবু অফিসের থেকে পরিবারকে অনেকটাই দূরে রাখে। রুপার স্বপ্ন তারও জানা কিন্তু যৌবনের মায়াজালে সেও বাঁধা পড়ে আছে।
এবারে রুপা বাইরে থেকে ফিরে বলাকার বেশ কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করে। আসলে বলাকা কে রুপা ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট এর মত রাখতে চায়। বলাকার সরল সাদাসিধে মুখ দেখে ও ভেবেই নিয়েছিল ও যেমন চাইছে এই মেয়ে তার যোগ্য। হয়তো ওর ভাবনার মধ্যে বেশ কিছুটা ভুল ছিল। বলাকার মধ্যে উন্নতি করার স্পৃহা টা রুপার থেকে অনেক অনেক বেশী ছিল। কিন্তু নিজের ইজ্জত বিক্রি করে ও উন্নতি চায় নি। মোহন বাবুকে ওর প্রথম থেকেই ভালো লাগেনি। তবে এখন বেশ ভালো করেই বুঝতে পারে প্রথম জয়েন করার পর রুপা কেন ওকে মোহন বাবুর বেশি কাছে আসতে বারণ করেছিল। আসলে রুপা চায় নি বলাকা কোনদিন তার জায়গাটা নিক।
বলাকা বরাবরই একটু চুপচাপ থাকতে ভালবাসে। বাড়িতে অফিসের কথা খুব একটা বলে না, কিন্তু সেদিন অফিস থেকে ফিরে মাকে বলল,
"আচ্ছা মা, তুমি তো কোনদিন আমাকে অফিসের কথা জানতে চাও না, আমি সারাদিন কি করি তোমার কি জানতে ইচ্ছে করে না কখনো?"
মেয়ের মুখে এইরকম কথা শুনে মায়ের একটু আশ্চর্য লাগলো। তাও বলল
"কেন ইচ্ছে করবে না , আর আমি জানি তুই কোন খারাপ কাজ কোনদিন করবি না
তাই আর নতুন করে তোকে জিজ্ঞেস করার দরকার কি"
সেদিন বলাকার মনের মধ্যে যে ঝড়টা উঠেছে তার দাপটে সারাটা রাত ঘুমোতে পারল না। এই এক কামরার ছোট্ট ভাড়া ঘরটা ছেড়ে ওর খুব ইচ্ছে একটা দু কামরার ফ্ল্যাট কেনে। কিন্তু ওর যা মাইনে তাতে এখনো অনেক বছর অপেক্ষা করতে হবে নতুন ফ্ল্যাট কেনার জন্য। ও ভালো করেই জানে রুপাদির বিশাল বড় সুন্দর ফ্ল্যাট আর নতুন কেনা গাড়িটা মোহন বাবুরি দান। রুপা না বললেও ও সৌভিকের থেকে অনেক আগেই শুনেছে।
পরদিন অফিস ঢুকতেই রুদ্রা বলাকা কে বলল
"বলাকা দি আজ তোমাকে মোহন বাবু একবার চেম্বারে যেতে বলেছেন"
"কারণ কিছু বলেছেন"?
রুদ্রা মুচকি হেসে সৌভিকের দিকে তাকায়।
"উনি কি কখনো কারণ আমাদের বলবে ওটা শুধু তোমাকেই বলবে"
রুদ্রা ঠাট্টা করে বললো।
বলাকা কিছুটা হাতের কাজ সেরে মোহন বাবুর ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে বলল
"আমি আসতে পারি স্যার?"
সেদিন বলাকা ডানকুনি তে একটা সাইটে ভিজিট করতে গিয়েছিল।
বলাকা কে মোহন বাবু ইশারায় ঘরে আসতে বলে কারো সাথে ফোনে কথা বলতে থাকে। কথা বলা শেষ হলে বলাকা কে বলে
"বলাকা পরশুদিন পাটনাতে একটা ক্লায়েন্ট মিটিং আছে, তুমি তৈরি থেকো আমার সাথে হয়তো যেতে হতে পারে"
বলাকা বুঝতে পারে না এটা আদেশ করছে না অনুরোধ?
"আমি এখনই কথা দিতে পারছি না তবে না যেতে পারলে কালকেই জানিয়ে দেবো"
বলাকার কথাটা একটু গম্ভীর ভাবে বলা হয়ে যায় সেটা ও নিজেই বেশ বুঝতে পারে। আসলে মোহন বাবু ওর মত না নিয়ে পাটনায় যাবার কথাটা বললে ওর মাথার ঠিক থাকে না। তাও বুঝতে পারে এভাবে ওর বলাটা বোধ হয় ঠিক হয়নি। চাকরিটা করা ওর খুব দরকার। তবে অন্যায়ের সাথে আপোষ করে কিছু করাটা ওর ধাতে সয় না। বলাকা জানে মোহন বাবু কেন ওকে নিয়ে পাটনায় যাবে বলছে, সৌভিক কে নিয়ে যেতে কোন প্রবলেম নেই তাও মোহন বাবু কোনদিন সৌভিক কে নিয়ে কোন মিটিংয়ে যাননি। রুপা এই সুযোগটা র সদ্ব্যবহার করেছে। ইচ্ছে করলে বলাকা ও এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু ওর মনটা ঠিক সায় দিচ্ছে না।
বলাকা বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে সৌভিক ওকে দিয়ে রুপার ওপর প্রতিশোধ নিতে চাইছে। সৌভিকের কেরিয়ারের অনেক ক্ষতি করেছে রুপা। তাই সৌভিক মোহন বাবুর অফারটা নিয়ে নেওয়ার জন্য বলাকা কে খুব জোরাজুরি করতে লাগলো। মাঝে মাঝে বলাকা ও ভাবছে যদি রূপাদির মত নতুন ফ্ল্যাট নতুন গাড়ি আর বড় অঙ্কের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স হয়ে যায় তাহলে ওর জীবনটা সেটেল হয়ে যাবে। থাকার চিন্তা থাকবে না, খাওয়ার চিন্তা ও থাকবে না আবার পয়সার অভাবও থাকবে না । ও তো এরকমই জীবনের স্বপ্ন দেখেছিল কিন্তু ওর মাইনের পয়সায় এটা কখনোই সম্ভব নয়।
বলাকা জানে মা ওকে খুব ভরসা করে। সেদিন অফিস থেকে ফিরে মায়ের কাছে গিয়ে বসলো
"মা আমি যদি কোন খারাপ কাজ করি তোমাদের ভালোর জন্য তুমি কি সেটা অন্য ভাবে নেবে?"
মা এবার খুব দৃঢ় গলায় বলল
"তুই যদি কোন খারাপ কাজ করিস তাতে আমাদের কখনোই ভালো হবে না এটা জেনে রাখিস"
"তোমাদের একটা নতুন ঘর ,যাতায়াত করার গাড়ি আর কিছু টাকা যদি দিতে পারি তবে আমি নিজে আনন্দ পাব, তুমিও একটু আরমে জীবন যাপন করতে পারবে"
এবার মায়ের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি
"আর ঠাকুমার মতো পাকা পাকা কথা বলতে হবে না ,যা হাত মুখ ধুয়ে আয় খাবার বাড়ছি"
বলাকা আর কোন কথা না বলে রাতের খাবার খেয়ে শুতে চলে গেল। রাতে দুচোখ এক করতে পারল না। মোবাইলটা নিয়ে দেখল রুপার দুটো ম্যাসেজ। লিখেছে
"মদন বাবুর সাথে পাটনা চলে যা, এই সুযোগটা হাতছাড়া করিস না"
পরের মেসেজ এ লিখেছে
"আমার গেম ওভার এবার তোর খেলার পালা"
বলাকা বুঝতে পারল ও যে সব জানে মোহন বাবু আর রুপার সম্পর্কের কথা সেটা রুপা জেনে গেছে। এখন মোহন বাবু হয়তো রুপাকে আর তেমন আমল দিচ্ছে না । আবার এটাও হতে পারে রুপা জীবনে যা যা প্রয়োজন ছিল তা সবই মোহনবাবুর সাহায্যে করে নিয়েছে তাই হয়তো এখন আর রুপার মোহন বাবুকে খুব বেশি দরকার নেই। তবে সারাটা রাত জেগে ও চিন্তা করে ঠিক করল পাটনা যাবে। ভালো থেকে কোন লাভ নেই ।শুধু অভাব ছাড়া আর কিছুই পাবে না। রুপার মত জীবন ই ও চায়। যেখানে কোনো অভাব নেই। শুধু ভোগ করো আর আনন্দ করো। এখন কে দেখছে রুপাদি কি করে এসব করেছে। এইসব নানা চিন্তা করতে করতেই ভোরের দিকে ওর দু চোখ টা ঘুমে বুজে এলো।
পরদিন অফিসে ঢুকতেই সৌভিক এগিয়ে এলো
"আজ মোহন বাবু টিকিট বানিয়ে রাখতে বলেছেন, একটা আইডেন্টিটি প্রুফ রাখতে হবে"
সৌভিকের কথাটা শুনেও না শোনার ভান করে বলাকা নিজের সিটে গিয়ে বসে পরে।
সৌভিক সেখানে গিয়েও হাজির হয়। কিন্তু বলা কার মুখ চোখ দেখে আবার নিজের সিটে ফিরে আসে। সৌভিক বেশ বুঝতে পারে বলাকা নিজের সাথে নিজের যুদ্ধে খুবই ভেঙে পড়েছে। সত্যিই বলাকা আর নিজের সাথে যুদ্ধ করতে পারছিল না। খুব ইচ্ছে করছিল নিজেকে জিতিয়ে দিতে কিন্তু অভাবটা মাঝে মাঝে বলে উঠছিল
"আমাকে যদি ঘর থেকে তাড়াতে চাস, তাহলে মোহন বাবুর ঘরে গিয়ে ঢোক, ওনার সব কথা মেনে নে, তাতেই তোর উন্নতি"
কাকে জিতাবে ও মাঝে মাঝে বুঝতে পারছিল না। মায়ের ওই কথাটা বারবার ওর মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। কোনো খারাপ কাজ করে কারো ভালো করা যায় না।
বলাকা এবার ঠিক করে নিল ,যদি উন্নতি করতে হয় নিজের যোগ্যতা দিয়ে করবে,
অন্যায় কে সঙ্গে নিয়ে নয়। সোজা মোহন বাবু কে জানিয়ে দিলো বলাকা পাটনা যেতে পারবে না। যদি কোন কাজে যেতে হয় তাহলে মোহন বাবুর সাথে এক ঘরে থাকতে পারবেনা। মোহন বাবু বলাকার থেকে এতগুলো কথা আশা করে নি। বলাকা ও বুঝতে পারছিল তার চাকরি আর বেশি দিন নেই। কিন্তু কেমন যেন একটা আত্মতুষ্টি উপলব্ধি করছিল। যার কাছে নতুন ফ্ল্যাট, গাড়ি, টাকা সব তুচ্ছ মনে হচ্ছিল।