একটু ভুলে
একটু ভুলে


হোয়াটস-অ্যাপ বন্ধ করে মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে কলেজে যাওয়ার গতিটা বাড়াল সৌভিক। সাড়ে ছটায় ক্লাস শুরু। রোজের তুলনায় আজ বাড়ি থেকে বেরতে একটু দেরী করে ফেলেছে ও। কলেজে পৌঁছে দেখল ক্লাসে প্রোফেসর ঢুকে গেছেন। অনুমতি নিয়ে ক্লাসে ঢুকেই ৩৬০ ডিগ্রী মাথা ঘুড়িয়ে সারা ক্লাস দেখে নিলো সৌভিক। উপাসনা ক্লাসে নেই। একটু অবাকই হল ও। এতক্ষণে তো ঢুকে যাওয়ার কথা। আর এই অবাক হওয়াটা উদ্বেগে পরিণত হল যখন ক্লাস শেষ হওয়ার পর ও উপাসনার কোনও পাত্তা পাওয়া গেল না, তখন। পেছন দিক দিয়ে এসে সৌভিকের পিঠ চাপড়াল রাহুল। সৌভিক একটু চমকে উঠল।
রাহুল - কিরে উপাসনার উপাসনা করছিস? চিন্তা করিস না, চলে আসবে। রাত জেগে তো শুধু তোর স্বপ্ন দেখছে। ঠিকমত ঘুম হচ্ছে না। তাই হয়তো ভোরে উঠতে পারেনি।
সৌভিক – বাজে বকিস না তো। বাড়ি থেকে বেরিয়ে অটোতে ওঠার আগে পর্যন্ত আমার সাথে হোয়াটস-অ্যাপে চ্যাট করেছে। বিশ্বাস না হয়, মোবাইল দিচ্ছি, দেখে নে।
রাহুল – না, না। তার দরকার নেই। কি দেখতে কি দেখে ফেলবো। আসলে তুই যে এতো তাড়াতাড়ি এতোটা এগিয়ে গেছিস, ওর প্রতিটা মুহূর্তের আপডেট রাখছিস বুঝতে পারিনি।
সৌভিক – মোটেই আমি ওর প্রতি মুহূর্তের আপডেট রাখি না। সেদিন ওর জন্মদিনে ওর বাড়ি গিয়ে খেয়ে এলাম। কোনও গিফট দেওয়া হয় নি। তাই আজ ভেবেছি যে ওকে নিউ-মার্কেটে নিয়ে গিয়ে একটা চুড়িদারের পিস কিনে দেব। এই জন্যই ও আজ আসছে কিনা জানতে চ্যাট করেছিলাম।
রাহুল – সে তো আমরা কেক নিয়েই গিয়েছিলাম। তোকে আবার আলাদা করে গিফট দিতে হবে কেন? খোলসা করে বল না, পূজোয় ওকে কিছু দিতে চাইছিস। এতো ভণিতা করার কি আছে?
সৌভিক – এই ফালতু কথা ছাড় তো। এখন কিন্তু সত্যি চিন্তা হচ্ছে। দাঁরা, একটা ফোন করে দেখি। ….. ধুর, ফোনটাও সুইচ অফ।
রাহুল – ফোন হয়তো চার্জ শেষ হয়ে সুইচ অফ হয়ে গেছে। দাঁড়া মহিলা মহলে জিজ্ঞাসা করে দেখি, ওরা ওকে ওয়াশ রুম, কমন রুমে দেখেছে কিনা।
একদল মেয়ে জটলা পাকিয়ে আড্ডা মারছে। বিষয় মূলত পূজোর কেনাকাটা। রাহুল ওদের আড্ডার ছন্দপতন করে উপাসনার কথা জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু না, ওরা কেউই আজ উপাসনাকে দেখেনি। সৌভিকও রাহুলের পেছন পেছন এই মহিলা জটলার সামনে হাজির হয়েছে। এমন সময় কলেজের জি.এস বিশ্বজিত সরকার ক্লাসে ঢুকল। “উপাসনা পাল তোদের ক্লাসমেট তো?” “হ্যাঁ, আমাদের সাথেই পড়ে। কেন, কি হয়েছে ওর বিশুদা?” বিশ্বজিত সরকারের কথা শেষ হতে না হতেই পাল্টা প্রশ্ন করে দিশারী। দিশারী উপাসনার স্কুলের বন্ধু। তাই স্বাভাবিক ভাবেই দুই পরিবারের মধ্যে যথেষ্ট হদ্যতা আছে।
বিশ্বজিত সরকার – তোরা কেউ ওর বাড়ি চিনিস?
দিশারী – হ্যাঁ, আমরা অনেকেই চিনি। কিন্তু কেন?
রাহুল – গত সপ্তাহেই তো ওর জন্মদিনে ওর বাড়ি গিয়েছিলাম আমরা।
বিশ্বজিত- থানা থেকে ফোন করেছিল। উপাসনার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।ওর ব্যাগের আই-কার্ড দেখে কলেজে ফোন করে ওর বাড়ির ফোন নাম্বার নিয়েছে পুলিশ। আমাদের এখন আর.জি.কর হসপিটাল যেতে হবে। তবে সবার যাবার দরকার নেই। কয়েকজন ওর বাড়ি চলে যা।
বিশুদার কথা শুনে সারা ক্লাসটা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। দিশারীর চোখ ছল ছল করছে। সৌভিকের মুখে কোনও কথা নেই। খবরটা শুনে পাথর হয়ে গেছে ও। দিশারী, সৌভিক, বিশুদা, আর ইউনিয়নের কয়েকটা ছেলে হাসপাতালে ছুটল। রাহুল, আরও কয়েকজন মিলে রওনা হল উপাসনার বাড়ির উদ্দেশ্যে।হাসপাতালে পৌঁছে উপাসনাকে খুঁজে বার করতে বেশী সময় লাগলো না ওদের। স্ট্রেচারে শুইয়ে সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে উপাসনাকে। স্ট্রেচার থেকে সবুজ কুর্তি পরা উপাসনার নিথর হাতটা বেরিয়ে আসতে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল দিশারী। সৌভিক, বিশুদারা তখন পুলিশের থেকে পুরো ঘটনাটা বিষদ ভাবে শুনছে।
ভোর সওয়া ছ’টা নাগাদ বারাসাত-হাওড়া রুটের একটি বাস উল্টো-ডাঙার দিক থেকে এসে খান্নার দিকে মুখ করে গৌরী-বাড়ি মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে ছিল। রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিট এবং অরবিন্দ সরণির ওই মোড়ে মানিকতলার দিক থেকে এগিয়ে আসছিল বেলে-ঘাটা আইডি-আরজিকর রুটের একটি অটো। সিগন্যাল সবুজ হলে বাসটি এগিয়ে যায় নিজের গন্তব্যের দিকে। আর অটোটি ওই মোড়ে এসে লাল সিগন্যাল দেখেও না দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড গতিতে বাসটির পিছনের দরজায় সোজা ধাক্কা মারে। এর ফলে বাঁ দিকে কাত হয়ে উল্টে যায় অটোটি। আর অটোর সামনে চালকের পাশেই বসেছিল উপাসনা। অজয় সরকার, ইতি সরকার এবং শিব সোঁয়াই নামের তিন যাত্রী ছিলেন অটোর পিছনের আসনে। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় উপাসনা। শিবকে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কপালে, নাকে এবং পায়ে গুরুতর আঘাত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে ইতি। অজয়ের বাঁ হাত ভেঙে গিয়েছে। পাঁজরে এবং মস্তিষ্কে আঘাত নিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে অটো-চালককে।
সৌভিক, বিশুদের সাথে অধীর আগ্রহে ঘটনা শুনছিল সাংবাদিক সপ্তর্ষি মল্লিক। সেই সঙ্গে কথাগুলো মোবাইলে রেকর্ডিং-ও করছিল সপ্তর্ষি। লাল-বাজারে ভাল কানেকশন আছে সপ্তর্ষির। তাই কোনও ঘটনা ঘটলেই খবর পেয়ে যায় ও। সবটা শোনার পর সৌভিকদের কাছে উপাসনার বাড়ির অ্যাড্রেস নিলো সপ্তর্ষি। এবারে ওকে উপাসনার বাড়ির দিকে ছুটতে হবে। ওদিকের খবরটা না নিলে নিউজটা কমপ্লিট হবে না। উপাসনার বাবা ও কাকা হাসপাতালে এসে গেছে। এখন ওদের উপাসনার দেহকে ময়না তদন্ত করাতে হবে। পাড়ার মেয়ের এমন মৃত্যুর খবরে গোটা এলাকা যেন ভেঙে পড়েছে উপাসনাদের ছোট একতলা বাড়িতে।বাইরে ভিড় করে রয়েছেন প্রতিবেশী,বন্ধু,ও কৌতূহলী জনতা।কেউ কেউ আবার অ্যাকসিডেন্টে ভাঙা অটো, নিহত উপাসনার ছবি তুলে হোয়াটস-অ্যাপে শেয়ার করছে। আর এক একজনের মোবাইলে একদল লোক হুমড়ি হয়ে পরে সেগুলো দেখছে। ছোটো ছোটো দল তৈরি করে একে অপরের সাথে নিজেদের অটো চরার কোনও তিক্ত অভিজ্ঞতা শেয়ার করছে। কেউ কেউ অটো ওয়ালাদের মনের সুখে গাল দিচ্ছে। সপ্তর্ষি জনতার ভীর ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকল। একমাত্র মেয়ে উপাসনার ঘরে সদ্য সন্তানহারা মা সোমা পাল কাঁদতে কাঁদতে প্রায় অচৈতন্য। সপ্তর্ষি, উপাসনার মার পাশে বসে থাকা এক ভদ্রমহিলাকে সোমা পালের মুখটা একটু তুলে ধরতে রিকোয়েস্ট করলো। ভদ্রমহিলা সোমাকে একটু তুলে ধরতেই সোমা ভদ্রমহিলার ঘারে মাথা এলিয়ে দিল। সপ্তর্ষি এবার ঘরের সুইচবোর্ডের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোককে ঘরের সব আলো জালিয়ে দিতে অনুরোধ করলো। সোমা পালের আর টেবিলে থাকা উপাসনার ছবিটার মোবাইলে কটা ছবি তুলে ওখান থেকে বেরিয়ে পড়লো সপ্তর্ষি। এখন তাড়াতাড়ি করে খবরটা লিখে জমা দিতে পারলেই ওর কাজ শেষ। বহুদিন পর ফ্রন্ট পেজের খবর পেয়েছে ও। তাই মনটা ওর আজ বেজায় খুশি।
ওই দিন সন্ধ্যায় একটি বেসরকারি নিউজ চ্যানেলে “আমাকে আমার মতো চলতে দাও” শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানে অটোদের দৌরাত্ম নিয়ে একটা আলোচনা সভা বসল। এই সভায় উপস্থিত রইল অটো ইউনিয়নের নেতা, পুলিশ সুপার, বিশিষ্ট আইনজীবী। এছাড়াও এই সংবাদ চ্যানেলের বিভিন্ন প্রতিনিধিরা সাধারণ মানুষের থেকে জেনে নিচ্ছে রোজকার জীবনে অটো চালকদের প্রতি তাদের ক্ষোভ অভিযোগ। কেউ জানালো আট-নজন যাত্রী তুলে অটো চালানোর কথা। কেউ বা অভিযোগ জানাল সিগনাল না মেনে বেপরোয়া ওভার-টেক করে গাড়ি চালানোর বিরুদ্ধে। কারো বা অভিযোগ লং রুটে যাত্রী না তুলে কাটা বা ছোটো রুটে যাত্রী তোলার বিরুদ্ধে। কেউ বা জানালো যে সুযোগ বুঝলেই অটো ড্রাইভাররা অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করে।কিন্তু এই সব অভিযোগকে ছাড়িয়ে গেল একজন দুঃসাহসিক সাধারণ মানুষের বক্তব্য। তিনি যা বললেন তা হল “ দেখুন এইসব আলোচনা সভা করে কিছু লাভ নেই। সরকার কোনোদিনই অটো ইউনিয়নের বিরুদ্ধে কোনও স্টেপ নেবে না। কারণ ভোটে পেশীশক্তি থেকে সভা-জমায়েত সবেতেই বড় ভরসা অটো ইউনিয়ন।তাছাড়া প্রতি অটো ইউনিয়নই প্রতি দিন চালকদের থেকে চাঁদা তোলে। অঙ্কটা দু’ থেকে পাঁচ টাকা। এ ভাবে মাসে কয়েক লক্ষ টাকা আদায় হয়। শুধু শহর ও শহরতলির অটো ইউনিয়নগুলি থেকেই দলের আয় কয়েক কোটি টাকা।” উনি আরও অনেক কিছু বলতে চাইছিলেন, কিন্তু সঞ্চালক ওনাকে থামিয়ে এই সকল প্রশ্ন সরাসরি অটো ইউনিয়নের নেতার দিকে ঠেলে দিলেন।কিন্তু সেই নেতা পুরো দোষটাই পুলিশের ঘারে চাপিয়ে দিলেন।“দেখুন এইসব দেখার দায়িত্ব পুলিশের। আমাদের নয়।আইন না-মানার অভিযোগে পুলিশ কোনও অটো চালককে ধরলে আমরা তাঁকে ছাড়াতে যাই না। কিন্তু কে কোন রুটে গাড়ি চালাচ্ছে, তা দেখা আমাদের কাজ নয়।” তার কথা থামিয়ে পুলিশ সুপার বললেন যে ‘‘আমরা চেষ্টা করি। কিন্তু ওপর থেকে অনুমতি মেলেনা। তাই আমরাও হাত গুটিয়ে বসে থাকি।আমরা তো পুল কারের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছিলাম। ফলও মিলেছিল হাতেনাতে। কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই তা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি।’’ এইভাবে নিজেদের দোষ নিয়ে রুমাল-চোর খেলা চলতে লাগলো। আর উত্তেজনার পারদ বাড়তে লাগলো। সময় শেষ হলে সঞ্চালক উভয়পক্ষের কথা থামিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ এই অনুষ্ঠানের জন্য বেশ খুশী। টি.আর.পি বেশ হাই এই অনুষ্ঠানের।
এরপর দিন দশেক কেটে গেল। খবরের কাগজে এলো অন্য খবর। টিভি নিউজ চ্যানেলে চলল অন্য বিষয় নিয়ে আলোচনা।কলেজে উপাসনাকে নিয়ে আর খুব একটা আলোচনা হয় না। কলেজ শেষে সৌভিক ঠিক করল যে উপাসনার বাবা-মার সাথে দেখা করতে যাবে।অটোতে উঠে ড্রাইভারের পাসের সিটটায় বসেছে ও। অটো চলছে। লাল সিগনাল দেখেও অটো চলছে।সবুজ আলো দেখে গতি বাড়ানো বাস-গাড়ি-লরির সামনে দিয়েই বিপজ্জনক ভাবে গাড়ি ভর্তি রাস্তাটি পেরিয়ে গেল অটোটি।একচুলের জন্য ঘটল না কোনও দুর্ঘটনা।কোনোমতে প্রাণ হাতে নির্দিষ্ট স্টপেজে নামলো সৌভিক। খালি হাতে যাওয়া ঠিক হবে না। একটা ফলের দোকানে গিয়ে ফল কিনল সৌভিক। দাম চুকিয়ে ফলের ঠোঙাটা হাতে নিতেই চমকে উঠলো ও। ঠোঙাটায় উপাসনার ছবি। খবরের হেড লাইনটা স্পষ্ট। “বেপরোয়া অটোয় উঠে বেঘোরে মৃত্যু অষ্টাদশীর” ঠোঙাটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সৌভিক। আর ভাবতে লাগল “এতো তাড়াতাড়ি ঠোঙা হয়ে গেল খবরটা।”