Debdutta Banerjee

Crime

2.5  

Debdutta Banerjee

Crime

একের ভেতর দুই

একের ভেতর দুই

5 mins
1.6K


মানু যে খবরটা শুনে এমন রিআ্যক্ট করবে কখনো ভাবিনি। তুহিনকে ও অপছন্দ করত আমার মনে হত। কিন্তু তাই বলে এভাবে .... 

তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে লেকের ধারে একটা বেঞ্চে বসলাম। জলের বোতলটা বার করে দিলাম ওকে। কান গাল লাল হয়ে আছে। রাগলে মানুর ফর্সা চামড়া ফেটে রক্ত দেখা যায়। 


আমি বাঁ হাতের অনামিকায় তুহিনের দেওয়া হীরার আংটিটা দেখছিলাম এক মনে। তুহিন এক বছর আমাদের অফিসে জয়েন করেছে। ভালো ছেলে। আমার প্রতি বন্ধুত্বর বেশি কি একটা টান ওর ছিল, গতকাল এই আংটিটা দিয়ে আমায় প্রপোজ করেছে ও। 

মানু আমার ছোট বেলার বান্ধবী, কলকাতায় পাশাপাশি বাড়ি। জামশেদপুর এসে একটা ফ্ল্যাটেই থাকি দু জনে। ও টাটা স্টিলে রয়েছে। আমি ব্যাঙ্কে চাকরি করি। দু বছর একসাথে রয়েছি আমরা।


মাঝ রাতে একটা অস্বস্তি নিয়ে ঘুমটা ভাঙতেই দেখি মানু আমার পাশে বসে আমায় অবাক হয়ে দেখছে। ওর ঘোলাটে দৃষ্টিতে চমকে উঠে বসতেই ও আমার দু হাত ধরে ফেলল। তারপর আমায় জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল ঝরঝর করে। ছোটবেলার বন্ধু তো, আমি অন্য কারো হয়ে যাচ্ছি মানতে কষ্ট হচ্ছে হয়তো! কিন্তু হঠাৎ শরীর জুড়ে এক অন্যরকম অনুভূতির ঢেউ উঠল। ওর স্পর্শ গুলো ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিল আদরে। কিন্তু আমার গা-টা কেমন ঘিনঘিনিয়ে উঠল। এক ধাক্কায় ওকে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, ওর চোখের দৃষ্টি কেমন ঘোলাটে। 


-''আমি তোকে অনেক ভালোবাসি, তুহিনের থেকে বেশি আদর দেবো । আমায় একটু বিশ্বাস কর।'' ওর গলার স্বরে প্রবল আকুতি।

বললাম -'' কি যা তা বলছিস!! তুহিনকে ভালোবাসি আমি।''

-''আমিও তোকে ভালোবাসি রাই। কিন্তু তুই তো সব জানিস। তুই তো ....''

-''সে তো আমিও.... কিন্তু তুহিন আমার ফিঁয়াসে, আমরা একসাথে নতুন জীবন শুরু করবো। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে এবার।''

-''কেন ? আমার সাথে কি তুই খারাপ আছিস ? এখন তো আইন স্বীকৃতি দিয়েছে আমাদের ....''

-''মানু !! কি যা তা বলছিস?'' আমি চিৎকার করে উঠি।


ও যে এমন মানসিক রুগী আগে টের পাই নি!! ও বড্ড গায়ে পড়া ছোট থেকেই। কথায় কথায় জড়িয়ে ধরা, চুমু খাওয়া এসব একটু বাড়াবাড়ি মনে হলেও এর বেশি কিছুই ভাবিনি। ও আরও কত কি বলছিল আমায়। আমি পাশের ঘ‍রে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। ঘড়িতে রাত তিনটে। খুব তুহিনের কথা মনে পড়ছিল।


পরদিন সকালে উঠে দেখলাম মানু বেরিয়ে গেছে, ওর মর্নিং শিফট চলছে। সাড়ে দশটায় ব্যাঙ্কে পৌঁছে ফোনটা পেয়েছিলাম। তারপর... সব কেমন কেঁপে উঠেছিল। তুহিন আর নেই, ভোর বেলায় ও খুন হয়েছে ওর ফ্ল্যাটে। সাকচিতে ওর ফ্ল্যাটে ও একাই থাকত। পেছন থেকে গলায় তার জাতীয় কিছু পেঁচিয়ে আততায়ী ওকে শ্বাসরোধ করে খুন করেছে। তবে অত ভোরে যে ওর বাড়ি গেছিল সে অবশ্যই ওর পরিচিত। 


আমার হাত পা কাঁপছিল। মনিষ ছিল কলেজে আমার খুব কাছের বন্ধু। মানু ওকে পছন্দ করত না। পাঁচতলার ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছিল মনিষ। 

পরাগদা আমাদের বাড়ি খুব আসত। আমি পাশ করার পর পরাগদার বাড়ি থেকে গত বছর বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল, তার কয়েকদিনের ভেতর লোকাল ট্রেন থেকে পড়ে পরাগদা মারা যায়। এ দুটোকে দুর্ঘটনা বলে এতদিন ভুলে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুহিন !! এ যে খুন!

কিন্তু থানায় বারবার জেরাতেও বলতে পারিনি আমার সন্দেহের কথা। মানুকে আমি কম ভালবাসি না। প্রমাণ ছাড়া শুধুই সন্দেহের বশে ওর নাম নিতে পারিনি। তাছাড়া তুহিনদের পারিবারিক শত্রু ছিল । ওর বাবার ব‍্যবসার ও একমাত্র উত্তরাধিকারী। আর একটা মেয়ে এ'কাজ করতে পারে কেউ বিশ্বাস করবে না। তবে মানুর সাথে আর থাকিনি। মানসিক ভাবে এতটাই ভেঙ্গে পড়েছিলাম যে বাড়ি ফিরে গেছিলাম। ঐ অফিসে কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছিল। বস সবটা বুঝে আমায় কলকাতায় বদলি করেছিলেন। মানুও চাকরী ছেড়ে কলকাতা ফিরে এসেছিল। নতুন কাজ পেয়ে গেছিল এখানেই। মাঝে মাঝে আসত দেখা করতে। কিন্তু আমি ওকে এড়িয়ে চলতে চাইতাম। ভালো লাগত না ওর সাথে কথা বলতে। কেমন যেন লাগত। 

ডিপ্রেশনে ভুগছিলাম খুব, ডঃ অনিকেত হোরের নাম মানুই বলেছিল মাকে। ওর ব্যবস্থায় মা নিয়ে গেছিল আমায় । প্রথম সিটিং এই বেশ কাছের লোক হয়ে উঠেছিলেন ডঃ হোর। প্রথম দুবার মায়ের সাথে মানুও গেছিল। তারপর সপ্তাহে একবার একাই চলে যেতাম। ওনার কাউন্সিলিং এ খুব উপকার হচ্ছিল। হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছিলাম ধীরে ধীরে। অনিকেত ডাক্তার থেকে আমার বন্ধু হয়ে উঠেছিল অজান্তেই। তুহিনের কেসটা বন্ধ হয়ে গেছিল। কেউ ধরা পড়েনি। 


সেদিন কাউন্সিলিং চলার সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এমন আগেও এক দু দিন হয়েছিল। ঘুম ভাঙতেই আর কিছু মনে পড়ে না। একটা ভালো লাগার আমেজ নিয়েই ঘুম ভাঙে। অনিকেতকে খুব ব্যস্ত মনে হল। কেমন যেন ছটফট করছে। তাড়াতাড়ি ওলা ডেকে আমায় তুলে দিল। দুবার জানতে চাইলাম কি হয়েছে বলল না। আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে চাইছিল। কি একটা বলতে গিয়েও বলল না। 


আমি চুপচাপ বাড়ি ফিরে এলাম। কিন্তু রাত্রেই পুলিশ এলো। অনিকেতের খুনের দায়ে আমায় ধরে নিয়ে এলো। সন্ধ্যায় ওর চেম্বারে ওর মাথায় একটা ভারি মেমেন্টো ছুড়ে ওকে মেরেছে কেউ। মাথা ফেটে ঘিলু বেরিয়ে গেছিল। আমি ছাড়া সেদিন ওর আর পেশেন্ট ছিল না। তাছাড়া ওর চেম্বারের বাইরে সিসিটিভিতে শেষ আমায় দেখিয়েছে। আমার যে আর কোনো বাঁচার পথ ছিল না। 


মানু এসেছিল বেলের জন্য উকিল নিয়ে। আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। কিন্তু, কিন্তু.... আমি... মানুতো সব জানত।

ওকে বললাম,


-''এবার আমায় ছেড়ে দে, আর ভালো লাগছে না রে। আর কত ? ক্লান্ত লাগছে খুব। মনিষকে বুঝিয়ে বলেছিলাম, ও বোঝে নি। জোর করেছিল। তাই তো ধাক্কা দিয়েছিলাম। পরাগদা কে বলেছিলাম আমি অন্যরকম। আমায় ভুলে যেতে। মানল না। কিছুতেই শুনল না আমার আপত্তি। তাই তো বাধ্য হয়ে ......। তুই তো জানিস মানু। আমি যে পারি না ওদের সহ্য করতে। তুই ঠিক বলেছিলি। অনেক চেষ্টা করেও তুহিনকে ফেরাতে পারি নি রে। ছেলেটার মধ্যে কি যে ছিল!! কিন্তু সব শেষ করে ফেললাম নিজেই। ভোর রাতে আমায় দেখেও ও বোঝে নি আমি কি চাই।

অনিকেত সব জেনে নিয়েছিল। আমায় ঘুম পাড়িয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন, উফ। অসহ্য। তোকে বলেছিলাম ডাক্তার আমার চাই না। তুই তবু জোর করলি। তুই তো জানিস দেখতে নারী হলেও আমি মনে প্রাণে পুরুষ। তোকেই ভালবেসেছি সারা জীবন। আমার এই দুধরনের সত্তার কথা তোর তো অজানা নয়। তবে কেনো ডাক্তার দেখাতে জোর করলি? জানিস অনিকেতের চোখে আমি ভয় দেখেছিলাম। সেই ভয় যা মনিষ পরাগদা বা তুহিনের চোখে দেখেছিলাম শেষবার। কই, তুই তো সব জেনেও আমায় ভালবাসিস। আর ওরা যখন জানল আমি মনে প্রাণে পুরুষ তখন আমায় .....।

আমি না খুব ক্লান্ত মানু। একটু শুতে দিবি রে তোর কোলে মাথা দিয়ে? ঘেন্না করে দূরে ঠেলে দিবি না তো ? আমি খুন করতে চাই নি বিশ্বাস কর। কিন্তু আমার ভেতরের পুরুষ সত্তাটা গর্জন করে উঠেছিল রে। আমি আর পারছি না এক শরীরে দুজনকে বয়ে বেড়াতে। মুক্তি চাই রে, আর পারছি না এভাবে। আমায় একটু.. একটু ... ভালোবাস মানু। ''

কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি আমি। মানু কি পারবে আমায় ক্ষমা করতে ?


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Crime