Kausik Chakraborty

Abstract Others

3  

Kausik Chakraborty

Abstract Others

দুর্যোগ

দুর্যোগ

3 mins
279


ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কুঠির মন্ত্রণাসভার সদস্য রাসেল সাহেব লিখছেন;এমন ভয়ানক ঝড় আমি জীবনেও ভুলিতে পারিব না। মুষলধারে বৃষ্টি, মুহুর্মুহু বজ্ৰপাত, ঝড়ের বিষম ঝাপট ও সন্ সন্j; শব্দ দেখিয়া, আমি উপরতলা হইতে নীচে নামিয়া আসিলাম। আমার বিশ্বাস, যে বাড়ীতে আমি বাস করিতাম, তাহা অন্যান্য সকল বাড়ী অপেক্ষা মজবুত। কিন্তু ঝড়-ঝাপটা, ও বাতাসের দমকা ইত্যাদি দেখিয়া আমার প্রতিমুহূর্তে ভয় হইতে লাগিল, যে বুঝি বাড়ী চাপা পড়িয়া,আমাদের জীবন্ত অবস্থায় সমাধিস্থ হইতে হইবে। মিসেস্ ওয়াসটেল নামধেয় এক ইংরাজরমণী, আমাদের বাড়ীতে পুত্রকন্যাদিসহ আশ্রয় লইয়াছিলেন। প্রাণের ভয়ে, আমি তাহাকে লইয়া নীচে নামিয়া আসিলাম । তিনি উপরে যে ঘরে ছিলেন তাহার দরজা জানালা পড়িয়া গেল। এইভাবে ভয়, উদ্বেগ, অপঘাত মৃত্যুর আশঙ্কা লইয়া সমস্ত রাত্রিটা আমরা বসিয়া কাটাইলাম।;


প্রায় ৩০০ বছর আগের কলকাতার। ১৭৩৭ সালের ১১ই অথবা ১২ই অক্টোবর (কেউ বলেন ৩০শে সেপ্টেম্বর। তারিখ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে)। ইংরেজ কোম্পানীর জমিদারীতে সবেমাত্র তিল তিল করে গড়ে উঠছে কলকাতা। আনাচেকানাচে কাঁচাবাড়ি। পাকাবাড়ি হাতেগোনা। প্রাসাদ তেমন একটাও নেই। বড় পাকা বাড়ি যা আছে, তা কেবলমাত্র কোম্পানীর সিভিল অফিসার ও বিচারকস্থানীয়দেরই। নেটিভ টাউনে শুধুমাত্র রোগ, অসুখ, অপরিচ্ছন্নতা আর নতুন বিদেশী মনিবের ছত্রছায়ায় বেঁচে থাকবার দৈনন্দিন লড়াই। এসবের মধ্যেই একটা রাতে বয়ে গেল সেই মহা বিপর্যয়। সিভিয়ার সাইক্লোন। তখন অবশ্য এখনকার মত ঘটা করে ঝড়ের নাম দেওয়ার প্রচলন ছিল না। এক সপ্তাহ আগে থেকে আলিপুরের পূর্বাভাসের তো কোন প্রশ্নই নেই। তাই যথারীতি ঘটে গেল চরম সর্বনাশ। এক রাতের ঝড়ে নতুন শহরটা আর চেনার মত অবস্থাতেই রইল না। তৎকালীন ইউরোপীয় দৈনিক লিখছে, একরাতে দুর্যোগের বলি হয়েছিলেন প্রায় তিন লাখ মানুষ (যদিও এই তথ্য হয়ত সত্য নয়, কারণ কলকাতার তৎকালীন জরিপ বলছে, সেই সময় তত সংখ্যক মানুষই থাকতেন না এ শহরে)। তবে যাই হোক, ঠিক আম্ফানের মতোই সেই দিনটাও ছিল এক বিভীষিকার প্রহর। প্রবল ঝড়ে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো উপাসনার গীর্জা, ইংরেজদের নতুন কাঁচা দূর্গ, এমনকি ব্ল্যাক-জমিদার গোবিন্দরাম মিত্রের প্রতিষ্ঠিত নবরত্ন মন্দির, চিত্তেশ্বরী কালী মন্দিরও (যাঁর নামে আজকের চিৎপুর)। গোবিন্দরামের মন্দিরটি বাগবাজারের কাছে তখন স্বমহিমায় বিরাজ করত। শোনা যায় অক্টারলোনী মোনুমেন্টের (বর্তমান শহীদ মিনার) থেকেও বেশি উঁচু ছিল সেই মন্দির। এখন নাহয় থাক সেসব কথা। আবার ঝড়ে ফিরে আসি। অভিশপ্ত সেই রাতে গঙ্গার জল প্রায় চল্লিশ ফুট ফুলে ফেঁপে ভাসিয়ে দিল সম্পূর্ণ শহরটিকে। ভেসে গেল গরু বাছুর ছাগল ভেড়া হাঁস মুরগী। কাঁচাবাড়ি তো বটেই, ভেঙে পড়ল সাহেবদের দশ বারোটা পাকাবাড়িও। গঙ্গা থেকে বহু ব্যাপারী-জাহাজ ও ডিঙি হাওয়ার টানে আছড়ে পড়ল ডাঙায়। খালের জলে নোঙর করা বহু নৌকা তলিয়ে গেল চোখের সামনে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, তখন কলকাতার মধ্যিখান দিয়ে বয়ে যেত একটা খাল। আজকের বাবুঘাটের কাছে গঙ্গা থেকে খালটি শুরু হয়ে এঁকেবেঁকে তালতলা, ওয়েলিংটন স্কোয়ার, মৌলালী দিয়ে গিয়ে পড়ত লবনহ্রদে। এখনও তালতলার ডিঙাভাঙা লেন এই ঝড়ের সেই নৌকাডুবির বিধ্বংসী স্মৃতিটুকু ধরে রেখেছে বুকে করে। সবকিছু ঠাণ্ডা হবার পর পরেরদিন সকালে দেখা যায় শহরটা পরিণত হয়েছে একখণ্ড আবর্জনায়। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে সবকিছু। এই দুর্বিপাকের হাত থেকে ঘুরে দাঁড়াতে প্রায় দুবছর সময় লেগে গেছিল নতুন শহর কলকাতার। কোম্পানীর ডিরেক্টরা এই দুবছর দেশী প্রজাদের খাজনা মাফ করে দেন। নিজস্ব তহবিল থেকে ঠিক আজকের সরকারের মতোই সাহায্য করেন গরীব দুঃখী ও ঘরহীনদের। দেশে খাবারের অভাব পড়ায় কাউন্সিল বিলেতে চাল রপ্তানি পর্যন্ত সাময়িক বন্ধ করে দেয়।মাঝে কেটে গেছে ২৮৩ টি বছর। গঙ্গা দিয়ে গড়িয়েছে বহু জল। তবু কোথাও যেন আজকের মহানগরী কলকাতা মিলেমিশে গেছে সদ্য জন্ম নেওয়া এক শিশু শহর কলকাতার সাথে। আজ আর ইংরেজ জমিদারী নেই, নেই হোয়াইট আর ব্ল্যাক টাউনের বেড়াও। তবু আম্ফানের সময় ফিরে এসেছে দুর্যোগ। শুধু চিনিয়ে গেছে যে প্রকৃতির সামনে আজও মানুষ কতটা অসহায়। ঠিক সেদিনের মতোই। মনে হয় মাঝখানের ২৮৩ টি বছর যেন নেহাতই এক সংখ্যামাত্র, মানবসভ্যতার ক্রমপঞ্জি নয়।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract