বিশ্বভারতী ও নারীশিক্ষা
বিশ্বভারতী ও নারীশিক্ষা


১৯০৮ সালে ৬ জন বালিকাকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে নারীবিভাগের প্রথম সূচনা করেন গুরুদেব। তখন দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল সুশীলা দেবীর উপর। পরে এই বিভাগটি বন্ধ হয়ে গেলেও আবার ১৯২২ সালে সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময়েই শান্তিনিকেতন হয়ে ওঠে 'বিশ্বভারতী'। তখন স্নেহলতা সেন বিভাগটির দেখভাল করতেন। আশ্রমের মেয়েরা পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলাতেও অগ্রণী ভূমিকা নিতে শুরু করে। ভারতীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সে এক দুর্বার সময়। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সারা দেশে প্রায় অচলাবস্থা জারি হলেও আশ্রমের আঙিনা ছিল সম্পূর্ণ শান্ত ও রাজনীতিমুক্ত। ছেলেরা ও মেয়েরা একযোগে গুরুদেবের সান্নিধ্যে গড়ে তুলতে থাকে আত্মচরিত্র। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ চিরকালই বিশ্বমৈত্রীর স্বপ্নে থাকতেন বিভোর। তাঁর নেতৃত্বে বিশ্বভারতী তখন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যেন এক মিলনক্ষেত্র। তাই তো আলমোড়া জেলে বন্দি থাকাকালীনও পন্ডিত নেহেরু নিশ্চিন্তে থাকতেন আশ্রমবাসী কন্যা ইন্দুকে নিয়ে। গুরুদেবের উপর তাঁর ছিল অগাধ আস্থা। শুধু নেহেরুই নয়, জাতীয় শিক্ষাক্ষেত্রে নারীশিক্ষায় ও অগ্রগতিতে তখন থেকেই বিশ্বভারতীর প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশের প্রতিটি কোণে। সেই সময় ইন্দিরার সাথে সহপাঠিনী হিসাবে আশ্রমে পড়তেন অশোকা সিংহ, জয়া আপ্পাস্বামী, সোমা যোশির মতো আরও বহু অবাঙালি ও ভিন্ন প্রদেশের ছাত্রীরা।
১৯৩৬ সালে নিখিলবঙ্গ নারীকর্মী সম্মেলনের বক্তৃতায় কবি বলেন, নারীর স্বভাবের মধ্যে রয়েছে সংসারকে শান্তি ও আনন্দ দেবার এক সহজাত প্রবৃত্তি। তাঁদের স্বভাবের এই রূপটিকে শিক্ষার দ্বারা উদ্ভাসিত করা, সমাজের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। তিনি আগাগোড়াই চেয়েছিলেন নারীর রক্ষণশীল মনটাকে আধুনিকতার মোড়কে মুড়ে ঘুণ ধরা সমাজের কাছে জবাব হিসাবে ফিরিয়ে দিতে। তিনি বিশ্বাস করতেন নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠায়। আজকের যুগে নারীস্বাধীনতার যে মুক্ত স্রোতের ওপর ভিত্তি করে সাবলম্বী হয়েছে আধুনিক সমাজ, তারই গূঢ় তত্ত্বটুকু কবি তৈরী করে গেছেন প্রায় ১০০ বছর আগে। বিশ্বভাতৃত্বের লক্ষে নারীপুরুষ নির্বিশেষে খোলা আকাশের তলায় রাখিবন্ধন কবির প্রগতিশীল ও আধুনিক সমাজদর্পনের এক নতুন আঙ্গিক প্রতিষ্ঠা করে সেবিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই।
বিশ্বভারতীর প্রথম রিপোর্টে দেখা যায়, কলাভবনের শিল্প বিভাগের পড়ুয়া সংখ্যা ৫০ জন। তাঁদের মধ্যে ১০ জন ছাত্রী। অন্যদিকে সংগীত বিভাগে ৪০ জনের মধ্যে ২০ জনই ছাত্রী। রবীন্দ্রনাথ সেযুগের বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সংস্থা গার্ল- চাইল্ড এর স্থানীয় শাখার নামকরণ করেন 'গৃহদীপ'. পরে নাম বদলে নাম রাখেন 'সহায়িকা'। তিনি চাইতেন তাঁর আশ্রমে মেয়েরা হোক স্ময়ংসম্পূর্ণ, স্বনির্ভর। প্রতিটি কাজে তাঁরা রেখে যাক পুরুষ সমান কর্মদক্ষতা। বিশ্বভারতী বুকে ধরে আছে সেই সংকল্পটুকু। আজও বিশ্বভারতী প্রাঙ্গনে প্রতিটি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর কাজেও পুরুষ ও নারী ছাত্রছাত্রীদের সমদ্যোগ চোখে পড়ার মতন।
‘বিশ্বভারতী নারীবিভাগ’ এই শিরোনাম নিয়ে 'প্রবাসী' অগ্রহায়ণ ১৩৩০ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি প্রকাশ করেছিল। যার ছত্রে ছত্রে ছিল নারীপ্রগতির কথা। যাতে উল্লেখ পাওয়া যায় - ‘শান্তিনিকেতন আশ্রমে বিশ্বভারতীর আন্তর্গত নারী বিভাগ হইতে স্ত্রীলোকদের শিক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হইয়াছে। আপাতত এখানে অন্যান্য শিক্ষণীয় বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীত, চিত্রকলা, বস্ত্রবয়ন এবং বই বাঁধানো প্রভৃতি হাতের কাজ শিক্ষা দেওয়া চলিতেছে। সেইসঙ্গে স্বাস্থ্যতত্ত্ব, রোগী পরিচর্যা, শাকসব্জী, ফুলফলের বাগান তৈয়ারী, বিজ্ঞান বিহিত গৃহকর্ম-প্রণালী প্রভৃতির বিষয়ে ছাত্রীরা পারদর্শিতা লাভ করে, ইহা আমাদের ইচ্ছা। নারীশিক্ষায় আগ্রহবান ব্যক্তিদিগের নিকট হইতে যথোচিত আনুকূল্য পাইলে দেশবিদেশ হইতে উপযুক্তা শিক্ষয়িত্রী সংগ্রহ করিয়া এখানে উচ্চ আদর্শের নারী শিক্ষালয় গড়িয়া তুলিতে কৃতকার্য হইব।’
তাই আজকের থেকে এক শতাব্দী আগেও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আজকের দিনেরই এক আধুনিক পুরুষ। সেই রক্ষণশীল সমাজেও তিনি এমন এক প্রতিষ্ঠান নিজে হাতে তৈরী করেছিলেন যেখানে তাঁর নিজের ইচ্ছেগুলোই বাস্তবের মাটি ছুঁয়েছিল অনায়াসে। আর এখানেই তাঁর প্রাসঙ্গিকতা।