Kausik Chakraborty

Inspirational

3  

Kausik Chakraborty

Inspirational

বাঙালির সাম্বা নাচ

বাঙালির সাম্বা নাচ

4 mins
850


রেফারির বাঁশির শব্দ যেন এক শব্দব্রহ্ম। সৌজন্যে কলকাতাবাসী, প্রেক্ষাপট স্বাধীনতা পূর্ববর্তী পরাধীন বাংলা, স্থান কলকাতা ময়দান আর মন্ত্রমুগ্ধতার নাম ফুটবল, ওরফে তৎকালীন মোহনবাগান ক্লাব। ১৯১১ সাল খুব পিছিয়ে যায়নি বাঙালির ফুলবল মানচিত্রে। গোরাদের পর্যুদস্ত করে কলকাতার ছেলে শিবদাসের (তৎকালীন মোহনবাগান অধিনায়ক শিবদাস ভাদুড়ী) মাথায় শিল্ডজয়ের মুকুট - ব্যাস, বাংলার ফুলবল স্বর্ণযুগের শুরু। ১৮৬৩ সালের ব্রিটেন যদি পৃথিবীকে গোলকটা চিনতে শেখায়, তবে পিছিয়ে নেই তৎকালীন নব্য বাংলাও। ১৮৮০ সালে বাংলার রেনেসাঁ লগ্নে হেয়ার স্কুলের নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারীর (১৮৬৯-১৯৪০) হাত ধরে ফুটবলতায় লাথি মারতে শেখা বাঙালির। আর এই সামান্য সময়ের তফাৎটা হয়তো সেদিনই মুছে গেছিলো যেদিন কলকাতার মাঠে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টের থেকে খালিপায়ে শিল্ডটা কেড়ে নেন মোহনবাগান ক্লাবের অভিলাষ, সুধীর, শিবদাসরা। ইতিহাস অন্তত সেরকম কথাই বলে। অংকের হিসাবে ১৯১১ সাল হয়তো মান্ধাতার আমল, চার প্রজন্ম পিছনে। কিন্তু একটা স্বপ্নের নেপথ্যে যতটা ইচ্ছে জড়িয়ে থাকে, তা হয়তো কোনোদিনই কালের হিসেব মানেনি, মানবেও না। আজও সময়সারণি বেয়ে ১৯১১ তে পিছিয়ে গেলে দেখা যায় ফুটবলের মোড়কে ২৯সে জুলাই ছিল বাঙালি ও বাংলার এক জাতীয়তাবাদের দিন, দেশপ্রেমের দিন। সেদিন খেলার মাঠেও উঠেছিল 'বন্দেমাতরম' মহামন্ত্র। এটাই হয়তো ফুটবলধর্ম, বাঙালি অন্তত সেভাবেই খেলাটাকে চেনে। 

খাতায় কলমে ফুটবল বিশ্ব মানচিত্রে ভারতের স্থান ৯৭ (তথ্যসূত্র - ফিফা ওয়েবসাইট, জুন, ২০১৮), কিন্তু সেই যে স্বপ্নটা, যার হাত ধরেই বাঙালির ইচ্ছেপূরণ শুরু, তার বিচারে আমাদের দেশ বিশ্বকাপে অগ্রগণ্য নয় কী? যখন বর্ধমানের পাড়ার গলিতে ঝুলতে থাকে দিগ্বিজয়ী ব্রাজিলের প্রকান্ড পতাকা, অথবা হাওড়ায় হোমকুন্ড বাঁধিয়ে যাগযজ্ঞ করে জয় প্রার্থনা করা হয় মেসির আর্জেন্টিনার, তখন? এরপরও কী বলবেন যে "আগে তো বিশ্বকাপ খেলুক"...

১২০ কোটির দেশে মাত্র ১০ কোটি বাঙালি, আর একটাই যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন - বাংলার ফুটবল মক্কা। যতই ইতিহাসকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাবার অভিনয় করি না কেন, ইতিহাস ছাড়বার পাত্র নয়, সে যেন আরো জাপটে ধরে পেনাল্টি লাইনের ভেতরে, কিন্তু ফাউল দেবে সাধ্য কার? তাই ফুলবলের ক্ষেত্রে আজও কেউ বাঙালিকে আটকে রাখতে পারেনি ফাউলের বাঁশি বাজিয়েও। তাই এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের কথাতেই বলতে ইচ্ছে করে "দেশদেশান্তর-মাঝে যার যেথা স্থান/খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।" হ্যাঁ, শুধুমাত্র হয়তো ফুটবল ক্ষেত্রেই বাঙালি আজও বাঙালি হয়েই আছে, বলাই বাহুল্যু মানুষ হবার বৃথা চেষ্টা চালায়নি।

১৮৮৮ সাল, ভারত ভূখণ্ডের তৎকালীন বিদেশ সচিব মোর্তোমের ডুরান্ড সিমলা থেকে ঘোষণা করলেন ডুরান্ড কাপের। এফ এ কাপ ও স্কটিশ কাপের পর এটিই পৃথিবীর প্রাচীনতম ফুটবল টুর্নামেন্ট। এরপর ১৮৯৩ সালে পৃথিবীর চতুর্থ পেশাদারি ফুটবল টুর্নামেন্ট হিসাবে শুরু 'আইএফএ শিল্ড' এর। তৎকালীন রাজধানী কলকাতাই হয়ে ওঠে ব্রিটিশদের ফুটবল মক্কা। প্রসঙ্গত বলে রাখি ভারতের প্রাচীনতম পেশাদারি ফুটবল ক্লাব 'সারদা এফসি' এই সময়েই তাদের দল গঠন করে। এরপর ধীরে ধীরে তৈরী হয় ক্যালকাটা এফসি, ডালহৌসি ক্লাব, ট্রেডার্স ক্লাব এবং ১৮৮৯ সালে উত্তর কলকাতার ভুপেন্দ্রনাথ বোসের হাত ধরে বাঙালির ফুটবল আবেগ মোহনবাগান এসি। বাকিটা গঙ্গার স্রোতের মতোই বহমান।

কলকাতা আদ্যোপান্ত ফুটবল নগরী, এখনো কাজের দিনেও ডার্বির তালে সাম্বা নাচে বাঙালি। শুধু যুবভারতীর গালিচাতেই নয়, ফলত পুরো বাংলাই অর্ধেক হয় সেই ৯০টি মিনিট। এই তো সুযোগ, আবার কিছু ইতিহাসের পাতা ঘাঁটা যাক বরং। চলুন পৌঁছে যাই ১৯২০ সালের ২৮সে জুলাই, প্রেক্ষাপট কোচবিহার কাপ,মোহনবাগান ও জোড়াবাগান এফসির ম্যাচ - জোড়াবাগান সেরা এগারো বেছে নিলো তাদের সেরা ডিফেন্ডার শৈলেশ বোসকে বাইরে রেখে। শৈলেশকে যুক্ত করতে ক্লাব সহসচিব সুরেশ চন্দ্র চৌধুরীর অনুরোধও বৃথা গেলো। অপমানিত কর্মকর্তা চৌধুরী ত্যাগ করলেন ক্লাব এবং রাজা মন্মথ নাথ চৌধুরী, রমেশ চন্দ্র সেন, ও অরবিন্দ ঘোষ এর সাহচর্যে ১৯২০ সালের ১লা অগাস্ট আত্মপ্রকাশ ঘটালেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের। এভাবেই সূত্রপাত বাঙালির ফুটবল বিভাজন, তথাকথিত বাঙাল-ঘটির তরজা। বাকিটা তো শতবর্ষ প্রাচীন ইঁটগুলোয় বাঁধানো।

ইস্ট বেঙ্গল, মোহনবাগানের হাত ধরে আবার ফেরা যাক কলকাতা ডার্বির কথায়, আন্তর্জাতিক ফুটবল নিয়ামক সংস্থা ফিফার ক্লাসিক ডার্বি লিস্টে এসি মিলান - ইন্টার মিলান, রেঞ্জার এফসি - সেলটিক এফসির সঙ্গে জ্বলজ্বল করে কলকাতার মোহনবাগান - ইস্টবেঙ্গল এর নাম। বাঙালির চির ফুটবল প্রতিদ্বন্ধিতার এটাই হয়তো প্রকৃত প্রাপ্তি। ৮ই অগাস্ট, ১৯২১ - কোচবিহার কাপে প্রথম মুখোমুখি হয় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই পক্ষ, খেলা 'গোললেস ড্র'। তারপর থেকে ১০০ বছর ময়দানে বয়ে গেছে অনেকগুলো বসন্ত। ৩৬৪ টি ডার্বি ম্যাচে ইস্ট বেঙ্গল ১২৭ বার জয়ী এবং সার্ধপ্রাচীন ক্লাব মোহনবাগানের ঝুলিতে ১১৮ টি বিজয়ের মুকুট, বাকি ম্যাচ গোলশূন্য।

ফিফার আন্তর্জাতিক আঙিনায় ভারতের বর্তমান উত্তরণও বেশ চমকপ্রদ। আন্তর্জাতিক ক্রমতালিকায় ১৪৪ থেকে ৯৭ তে উত্তরণ তারই প্রাথমিক স্তর। আজও এই পথ চলার প্রান্তিক গন্তব্যে বিশ্বকাপকে স্বপ্নে দেখে বাংলা তথা ভারতের ফুটবলপ্রেমী জনতা। বাংলার সাথে সাথে গোয়া, পাঞ্জাব, মুম্বাই, বেঙ্গালুরুও স্বপ্ন দেখাচ্ছে ভারতকে। খালিপায়ে চামড়ার গোলকে লাথি দিয়ে যে আবর্তের সূচনা, ১৯৫০ সালে বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন (যদিও বিশেষ কারণবশত অংশ নিতে পারেনি ভারত), ১৯৫৬ সালে বুলগেরিয়ার কাছে ৩-০ তে হেরে অলিম্পিকে চতুর্থ স্থান দখল সেই আবর্তেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইতিহাস উজ্জ্বল হয় সমাজের হাতে, মানুষের প্রচেষ্টায়, তাই এই চক্রাবর্তের গতিমানতায় খুব তাড়াতাড়ি আগামী কোনো বিশ্বকাপে আমাদের ভারত যে অংশ নেবে না, তা কে হলফ করে বলতে পারে? দুবছর আগে ফিফা যুব বিশ্বকাপ থেকে যে পথ চলা শুরু হয়েছে, তারই অত্যাবশ্যক যাত্রাপথে আমরা লড়াই করছি আন্তর্জাতিক ফুটবল বিশ্বের সবথেকে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের - স্বপ্নটা এভাবেই তোলা থাক। বাঙালি এগোক, আর তার সাথে সওয়ার হোক ১৩০ কোটির আকাঙ্খা।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational