Kausik Chakraborty

Inspirational Others

3  

Kausik Chakraborty

Inspirational Others

লৌহমানবী

লৌহমানবী

3 mins
273



ব্যারাকপুর ও বহরমপুরের ছাউনি থেকে তখন মহাবিদ্রোহের আঁচ ছড়িয়ে পড়ছে তামাম ভারতবর্ষের আনাচেকানাচে। কলকাতা শহরও তার বাইরে নয়। রাজধানী কলকাতায় তাবড় ধনপতিরা তখন বিভিন্ন ভাবে ইংরেজদের সাহায্য করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। কেউ অর্থ দিয়ে, কেউ লোকলস্কর, ঘোড়া, হাতি দিয়ে। শহরের বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় তৈরী হচ্ছে সেনা শিবির। এদিকে ইংরেজদের দুর্গের অদূরে জানবাজারের রাণী রাসমণিও ৬ টি হাতি আর অনেক খাদ্য ও নগদ অর্থে সাহায্য দিনের সরকার বাহাদুরকে। এমনকি এই উপকারের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সেকালে সরকার বাহাদুর রানীকে একখানা প্রশংসাপত্রও দিয়েছিলেন বলেও জানা যায়। বিদ্রোহের আগুনকে প্রশমিত করবার জন্য সরকার পক্ষে যথারীতি কার্ফু জারি হলো শহরজুড়ে। বিকেল চারটের পর সুনসান রাস্তাঘাট, বন্ধ দোকানপাট, যানবাহন, এমনকি মানুষের জটলার ওপরও করা নজরদারি। কোথাও দোকান খোলা অথবা মানুষের ভিড় দেখলেই অযথা অত্যাচার করছে গোরাদের দেশি পুলিশ। তেমনই একদিন দুপুরে জানবাজার রাজবাড়ীর খোলা বারান্দায় বসে রয়েছেন যদুনাথ, দ্বারিকানাথ ও রানীর অন্যান্য উত্তরসূরিরা। এদিকে খুব কাছেই কয়েকজন সাহেব খোলা দোকানের মধ্যে ঢুকে প্রায় ইচ্ছাকৃতই উৎপাত করতে লাগলেন দোকানির সাথে। হিতাহিত না দেখে বারান্দায় বসে থাকা বাবুদের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখলেন না দোকানদার। অন্য কোনো উপায় না থাকায় বাবু যদুনাথ চৌধুরী আর বাবু দ্বারিকানাথ বিশ্বাস (রানীমার পৌত্র) বাড়ির ভেতরমহলে গিয়ে দারোয়ানদের পাঠালেন লুঠপাঠ বন্ধ করতে।


বিষয়টা আজকের আঙ্গিকে আপাতভাবে খুব স্বাভাবিক মনে হলেও সেযুগের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গোরাদের বিরুদ্ধে লোকলস্কর পাঠানোটা ভবিষ্যতের জন্য ঠিক কতটা জটিলতা তৈরী করতে পারে, তা শুধু সেযুগে দাঁড়িয়েই অনুভব করা যায়, তা সে সাহেবটির পদাধিকারবল আদৌ কিছু থাকুক আর নাই থাকুক। যথারীতি গোলমাল যে ভয়ঙ্কর পর্যায়ে গেলো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সেযাত্রায় সাহেবরা পালিয়ে প্রাণ বাঁচালেন ঠিকই, কিন্তু সরাসরি নালিশ জানালেন উচ্চপর্যায়ে, কর্ণেলের কাছে। কর্নেল সাহেব তখনি একেবারে এক রেজিমেন্ট সৈন্য সাজিয়ে-গুছিয়ে পাঠিয়ে দিলেন জানবাজারে। সৈন্য এসে ঘিরে নিলো জানবাজারের তিনমহল্লা রাজবাড়ীটি। এদিকে সন্ধে নেমে যাওয়ার পর বাড়ির দরজা ভেঙে অন্দরে ঢুকে পড়লো ইংরেজ সিপাই। বাড়ির মধ্যে সে এক হুলুস্থূল ব্যাপার। একতলার বৈঠকখানা আর বাহিরমহলে নির্বিচারে তারা ভাঙতে লাগলো ঝাড়লণ্ঠন, আসবাব আর সমস্ত সুসজ্জিত জিনিসপত্র। অথচ সকলে ছোটাছুটি, কান্নাকাটি করলেও অন্দরমহলে রাণীমাকে কেউ একচুলও নড়াতে পারলো না কোনওভাবে। সমস্ত সময়টুকু তিনি একহাতে বিভিন্ন চাবি আর অন্যহাতে ধারালো তরবারি নিয়ে বসে রইলেন স্থিরভাবে। এমনই ছিলেন দৃঢ়চেতা এই লৌহমানবী। নিজেকে অত্যন্ত অনাড়ম্বর জীবন ও ধর্মীয় অনুশাসনে মিশিয়ে রেখেও সংকল্পে ছিলেন স্থির। আমরা দেখেছি তার কিছু আগেই নাটোরের রাণী ভবানীর মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীর অভাবে তার অগাধ সম্পত্তি বেমালুম ব্রিটিশ সরকাররাজের কালগর্ভে চলে যেতে।


অথচ অকালে স্বামী রাজচন্দ্র দাসের মৃত্যুর পরেও তিনি কিভাবে তাঁর বিশাল সম্পত্তিকে আগলে রেখেছিলেন এবং ব্যবসা পরিচালনা করে তা প্রায় দুকূল ছাপিয়ে ফেলেছিলেন তা এখনো বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাসে সোনার হরফে লেখা আছে। সোনা যায়, সেইযুগে তিনি প্রায় ৫৫ হাজার টাকা ব্যয় করে তাঁর স্বামীর শ্রাদ্ধশান্তির কাজ সম্পন্ন করেন। যাই হোক, ফিরে যাওয়া যাক সেদিনের কথায়, ইংরেজ সিপাইদের জানবাজার বাড়ি ভাঙচুর করতে দেখে বাবু মথুরামোহন বিশ্বাস থানায় গিয়ে সব জানালেন। তখন নালিশ পেয়ে ইন্সপেক্টর, সার্জেন এসে কর্ণেলকে এই মর্মে বোঝালেন যে এই বাড়িতে কোনো বিদ্রোহীর আখড়া নেই, এমনকি বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে রাণী সরকারকে সাহায্য পর্যন্ত করেছেন। এরপর কোনো বিদ্রোহী খুঁজে না পাওয়ায় সেবারের জন্য ফিরে যায় ইংরেজ কর্ণেলের অত্যাচারী সৈন্যদল। সেইদিন থেকে এমন অযথা অত্যাচার রুখতে রাণী নিজের বাড়ি রক্ষা করার জন্য একেবারে ইংরেজদের গোরা সৈন্য চেয়ে বসেন, এবং বড়লাটও অগত্যা তাঁর সুরক্ষার জন্য ১২ জন ইংরেজ পাইক জানবাজার বাড়ির দরজায় প্রহরায় বসান। বলাই বাহুল্য, পরে সেই ইংরেজ কর্ণেলের নামে ম্যাজিস্ট্রেটকে নালিশ জানিয়ে সমস্ত ক্ষতিপূরণ তিনি আদায় করে তবেই নিবৃত্ত হয়েছিলেন।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational