মোহনবাগান - ইস্টবেঙ্গল
মোহনবাগান - ইস্টবেঙ্গল
মোহনবাগান। একটা স্বপ্ন, বাঙালীর একটা আবেগের নাম৷ হবেনাই বা কেন। ১৯১১ সাল যে বাঙালীর ইতিহাস থেকে কোনোদিন মুছবে না। ইংরেজদের যে খালি পায়ে দমিয়ে রাখা সম্ভব, তা তেকাঠিতে দেখিয়েছিল শিবদাস, বিজয়দাস, অভিলাষদের মত কিছু দামাল যুবকই। লাখ দর্শকের সামনে সেদিন ইতিহাস তৈরি করেছিল তাঁরা। সে গর্বিত ইতিহাস কে না জানে। কিন্তু জানেন কি মোহনবাগান নামটির উৎস কোথা থেকে? হয়ত জানেন, কিংবা জানেন না। আসুন জানার চেষ্টা করি তবে। বিলিতি সাহেবদের হাত ধরে তখন সবে গড়ে উঠছে শহর কলকাতা। উত্তর কলকাতায় শোভাবাজারে রাজা নবকৃষ্ণের মৃত্যুর পরে রীতিমতো জাঁকিয়ে বসেছেন তাঁর দত্তক পুত্র রাজা গোপীমোহন দেব। সংগীত ও উদ্ভিদপ্রিয় রাজার গমন কলকাতার সর্বত্র।
শোনা যায় শোভাবাজার রাজবাড়ির অদূরেই রাজার ছিল এক মস্ত শখের বাগান। সঙ্গে বাগানবাড়ি। লোকে সেই জায়গাকে মোহনের বাগান বলেই চিনত। অতঃপর বদলে গেল সময়। ধীরে ধীরে রূপ বদলাতে শুরু করলো শহর। ১৮১২ সালে তৈরি হওয়া লটারি কমিটির হাত ধরে কলকাতা শহর পেতে শুরু করলো আজকের মহানগরীর রূপ৷ তৈরি হল ফুটপাথ, আলো, রাস্তা৷ রাজা গোপীমোহন দেবের মৃত্যুর পরে সময়ের কলে পড়ে বদলে গেল অধুনা শ্যামবাজার নিকটস্থ বাগানের চেহারাও। গোপীমোহন পুত্র রাজাবাহাদুর রাধাকান্ত দেবের সময় থেকেই শহর আধুনিক চেহারায় আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করলো। সারা কলকাতা শহর জুড়ে তৈরি হল অজস্র পাকাবাড়ি ও প্রাসাদ। ঠিক কিছু বছর পরে ১৮৮৯ সালের ১৫ই আগষ্ট উত্তর কলকাতার মিত্র ও সেন পরিবারের সহায়তায় ঠিক সেই জায়গায় বসু পরিবারের ভূপেন্দ্রনাথ বসু প্রতিষ্ঠা করলেন মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব। অবশ্যই নামের সূত্র সেই গোপীমোহন দেবের পুরনো বাগান। পরে অধ্যাপক এফ জে রো সাহেবের পরামর্শে ক্লাবের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় 'মোহনবাগান অ্যাথলেটিকস ক্লাব'।
মোহনবাগানের কথা বলব, আর ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে উহ্য রেখে, তা আবার হয় নাকি? চলুন পৌঁছে যাই কিছু বছর পরে ১৯২০ সালের ২৮সে জুলাই। প্রেক্ষাপট কোচবিহার কাপ। মোহনবাগান ও জোড়াবাগান এফসির ম্যাচ। জোড়াবাগান সেরা এগারো বেছে নিলো তাদের সেরা ডিফেন্ডার শৈলেশ বোসকে বাইরে রেখে। শৈলেশকে যুক্ত করতে ক্লাব সহসচিব সুরেশ চন্দ্র চৌধুরীর অনুরোধও বৃথা গেলো। হেরে গেল জোড়াবাগান। অপমানিত কর্মকর্তা চৌধুরী ত্যাগ করলেন ক্লাব এবং রাজা মন্মথ নাথ চৌধুরী, রমেশ চন্দ্র সেন, ও অরবিন্দ ঘোষ এর সাহচর্যে ১৯২০ সালের ১লা অগাস্ট আত্মপ্রকাশ ঘটালেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের। নিজে পদ্মার ওপারের মানুষ ছিলেন বলে ক্লাবের এহেন নামকরণ। বলা হয়, সেদিন যদি জোড়াবাগান জিতে যেত, তবে হয়ত ফুটবল নিয়ে কখনও বিভাজিতই হত না বাঙালী। তখন ছিল না বাঙালীর তথাকথিত বাঙাল ঘটির মিথ। ১৯৪২, ১৯৪৩, ১৯৪৫ সালে কোচবিহার কাপ জিতলেও কিছুপরিমাণ সমর্থক ও সদস্য নিয়ে একটি মাঝারি ক্লাবের পরিসরেই বেড়ে উঠছিল বর্তমান কলকাতার এই ফুটবলপ্রিয় জায়েন্ট ক্লাবটি। মোহনবাগান ততদিনে হয়ে উঠেছে বাঙালীর এক আস্ত অধ্যায় ও পরিচিতি। সব উল্টেপাল্টে দেয় ১৯৪৭ এর দেশবিভাগ। বিভাজন হয় বাঙালীর। ফুটবলেও দাগ লাগে তার। পূর্ববঙ্গ ছেড়ে আসা অসংখ্য বাঙালী 'ইষ্টবেঙ্গল' নামের মধ্যেই ফিরে পায় স্বদেশের অস্তিত্ব। ভিটেমাটির টান। দলে দলে ক্লাবের সদস্য ও সমর্থক বাড়তে থাকে প্রতিদিন। বাড়ে প্রত্যাশার চাপও। তৈরি হয় বাঙালীর সবচেয়ে মধুর অস্তিত্বের তর্জা - মোহনবাগান আর ইষ্টবেঙ্গল। চিঙড়ি আর ইলিশ। এভাবেই সূত্রপাত বাঙালির ফুটবল বিভাজনের। তথাকথিত বাঙাল-ঘটির পোশাকি লড়াই। বাকিটা তো ময়দানে গায়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা ক্লাবদুটির শতবর্ষ প্রাচীন ইটগুলোয় বাঁধানো। বিপক্ষের ছ্যূৎমার্গ ভুলে চাইলে একবার ছুঁয়ে আসতেই পারেন।