দুর্ঘটনার ঘটনা
দুর্ঘটনার ঘটনা
শাবিব ভাই এক দৌড়ে ট্রেনটা ধরে ফেললো। ট্রেনটা প্রাই মিস করতে-করতে বেচে গেলো সে। আর এই ঘন নিশুতি রাতে যদি শেষ ট্রেনটা মিস করতো তাহলে তাকে আর পৌঁছতে হতো না। প্ল্যাটফর্ম দিয়ে ঐভাবে ছুটে তারপর ফলিয়ে ট্রেনটা ধরায় সে যথেষ্ঠ হাপিয়ে গেছে আর জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিচ্ছে। ঐভাবে লাফ দিয়ে ট্রেন ধরায় তার যে কত কষ্ট হচ্ছে সেটাও সে বুঝতে পারছে, কারণ প্লাটফর্মটা যথেষ্ট নিচু। যাই হোক এখন একটু হাফ ছেড়ে দাড়িয়ে বড়ো করে নিশ্বাস নিতে নজর পড়ল ওই কনার সিটে বসা লোকটার দিকে। অবয়বটা দেখে বোঝা যাচ্ছে সেটা পুরুষ মানুষ, কারণ লোকটার আপাদমস্তক কালো চাদরে ঢাকা, শুধু কোটরে ঢোকা একজোড়া চোখ ছাড়া কিছুই বেরিয়ে নেই। খুব ভালোভাবে লক্ষ্য না করলে অবয়বটাকে একটা কালো বস্তা ছাড়া কিছুই মনে হবে না। লোকটার চাহনিতে শাবিব ভাইয়ের কেমন যেনো অস্বস্তি হতে লাগলো। ট্রেনের দরজা থেকে এগিয়ে, তার থেকে কিছুটা দূরের একটা সিটে পিছন ঘুরে শাবিব ভাই বসে পড়ল।
শাবিব ভাইয়ের যখন বেশ তন্দ্রা এসেছে তখন সে কাউকে যেনো তার পাশে অনুভব করলো। চোখ খুলতেই সেই আপাদমস্তক কালো চাদরে ঢাকা জ্বলজ্বলে চোখের লোকটিকে দেখলো। তার বুকের গতি হঠাৎই যেনো বেড়ে গেলো। তার মনে হতে লাগলো লোকটি যদি চোর বা ছিনতাইবাজ হয়, যদি পকেট থেকে আর্মস বের করে তাকে ধরে। এমন সময় চাদরের ভিতর দিয়ে লোকটা বলে উঠলো "এ তল্লাটে নতুন প্যাসেঞ্জার নাকি?" এমন আলাপি প্রশ্নে সে একটু আশ্বস্ত হয়ে বললো "তা কিছুটা বলতে পারেন, চাকরির সুবাদে গোটা এক বছর পর বাড়ি ফিরছি, আপনি কিকরে বুঝলেন"। শাবিব ভাইয়ের প্রশ্নের জবাবে লোকটা বললো "এমন শেষ ট্রেনের সময় না জানা থাকলেই মানুষ এইভাবে ওঠে"। লোকটার কোথায় কি বলবে ভেবে পেলো না শাবিব ভাই। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে লোকটা নিজেই আবার মুখ খুললো। সে বললো "আমি গত একবছর যাবত এই শেষ ট্রেনে যাতায়াত করছি, আসলে আমরা রাতের প্যাসেঞ্জারতো তাই জানি এই ট্রেন না ধরতে পারলে মসা র মাকড়শার মাঝে স্টেশনে কাটাতে হবে, তাই আপনাকে দেখে অনুমান করলাম মাত্র, তবে আপনি যথেষ্ট রিস্কে ট্রেনে উঠলেন, ভালো-মন্দ একটা হয়ে যেতে পারত"। শাবিব ভাই প্রতুত্তরে বললো "ট্রেনে কাটা পড়তে পারতাম বলতে চাইছেন"। লোকটি বলে উঠলো "হা ঠিক তাই, এ লাইনে এমন ঘটনা নতুন নয় আপনি এ লাইনে বেশি যাতায়াত করেননা তাই জানেনা কিন্তু এভাবে ট্রেনে ওঠা যথেষ্ট রিস্কি, আর কখনো এভাবে উঠবেন না যেনো"।
শাবিব ভাইয়ের মুখে এবার একটা ম্লান হাসি দেখা গেলো। সে বলল "আপনি কখনো কাউকে ট্রেনে কাটা পড়তে দেখেছেন?" তার এমন প্রশ্নে লোকটির মুখে বিস্বয়ের ভাব। বিস্বয় কাটাতে-কাটাতে লোকটি বলে উঠলো "দেখিনি তবে এমন অনেক ঘটনাই শুনেছি আর খবরের কাগজে তো আজকাল দুর্ঘটনাগুলি বেশি ছাপা হয়, কিন্তু আপনি এসব কথা আমায় জিজ্ঞেস করছেন কেনো বলুনতো, আপনি কি এমন ভয়াবহ ঘটনা দেখেছেন নাকি?" শাবিব ভাই এবার উঠে দাড়ালো। ট্রেন বেশ গতিতেই চলছে। শাবিব ভাই বললো "একবছর আগে হপ্তা খানিকের ছুটি নিয়ে রাতের শোভা দেখতে-দেখতে বাড়ি যাচ্ছিলাম এই শেষ ট্রেনেই। দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে দেখছিলাম রাতের আকাশে ট্রেনের গতির সাথে ছুটে চলা চাঁদটাকে। বেশ মনোরম পরিবেশ ছিল সেদিন ঠিক আজকের মতোই। ফুরফুরে হাওয়া আর চাঁদের স্নিগ্ধতায় চারিদিক আলোকিত হয়ে ছিল। এমন সুন্দর আবহাওয়ায় আমার কেমন যেনো ঘুমের আমেজ আসছিল। এক সময় তন্দ্রায় চোখ ঢুলে গেলো আর আমি ট্রেনের গতিতে টাল সামলাতে না পেরে চির দিনের মতো এই পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেলাম"। কথাগুলো বলতে-বলতে শাবিব ভাই দরজার দিকে এগিয়ে গেছে। পেছন ফিরে লোকটার দিকে তাকিয়ে একবার মাত্র বললো "গন্তব্য এসে গেছে দাদা, আবার বিদায়"। এই বলেই মুখ ঘুরিয়ে ঝাঁপ দিতে গেলো শাবিব ভাই, আর ঠিক তখনই লোকটা সিট থেকে তড়াক করে উঠে তার জামা টেনে ধরে তাকে ভিতরে আনার চেষ্টা করলো। কিন্তু শাবিব ভাই হাত ঘুরিয়ে তার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে সজোরে এক ধাক্কা মারলো। লোকটি মরণাপন্ন চিৎকার করে যখন পরে যাচ্ছে তখন শাবিব ভাই কুটিল হাসি হেসে বললো "বলেছিলামনা গন্তব্য এসে গেছে"।
