দুর্ঘটনার দায়
দুর্ঘটনার দায়
একটা দুর্ঘটনা আমার জীবন টাকে আমূল বদলে দিল। আমার যত রঙিন স্বপ্ন সব ভেঙ্গে চুরমার করে দিল। ঘটনার পর মা বিকাশ দের বাড়ি গিয়ে বুঝিয়েছিল
,"দিদি আমার মেয়ের কি দোষ বলুন, তখন তো আপনার ছেলেও ওখানেই ছিল, তাই আপনাকে অনুরোধ করছি বিয়েটা বন্ধ করে দেবেন না, তাহলে আমার মেয়ের জীবনটা একেবারেই নষ্ট হয়ে যাবে"
কিন্তু এর উত্তরে বিকাশের মা খুব ভারী গলায় উত্তর দিয়েছিল,
"এটা কি বলছেন আপনি? আপনার ছেলে থাকলে আপনি কি কোন ধর্ষিতা মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে পারতেন বলুন তো বুকে হাত দিয়ে?"
একটু থেমে আবার বলেন
"আর আমার কপাল ভালো ছেলেকে ফিরে পেয়েছি, কারণ ওই দুর্ঘটনায় বিকাশের প্রাণ যেতে পারত"
এর পরেও মা অনেক বার বুঝিয়েও কোনো ফল হয়নি। আমি বিকাশ কে ফোন করলে ও আর রিসিভ করে না। ওদের বাড়ি থেকে ফিরে মা আর খুব বেশি কথা বলে না। মায়ের এই উদাস চোখে চেয়ে থাকা আমার হৃদয়কে খুব জোরে চাবুক মারে। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা যদি কম্পিউটারের মত হত, তবে আমি আগে জীবনের ডেক্সটপ থেকে দুর্ঘটনার ফাইলটা ডিলিট করে দিতাম। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয় তাই এই দুর্ঘটনার দায় আমাকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। বাইরে বেরোনো প্রায় বন্ধ করে দিয়েছি। শুধু মাঝে মাঝে কোর্টে যেতে হয়।
সেদিন সকালে অফিস গিয়েই বিকাশ ফোন করেছিল।
"শোনো আজ তোমার বিয়ের আংটির মাপটা দিতে হবে তুমি আগের দিন যেখানে দেখা করেছিলে ওখানেই 7 টার সময় চলে আসবে"
বিকাশ যেন আমার স্বপ্নের রংটায় আরও একটা প্রলেপ দিল।
"ঠিক আছে আমি চলে যাব"
দুজনে সেদিন আংটির মাপ দেওয়ার পর একটা সিনেমা দেখেছিলাম। একটু রাত হয়ে যাওয়ায় বিকাশ বলল
"চলো আজ আমি তোমাকে বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে আসছি"
এমনিতেই বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল বিকাশ আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে সিগারেট কিনতে যায় আর তখনই চারজন ছেলে গাড়ি নিয়ে আমার সামনে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পরে। আমি কিছু বোঝার আগেই ওরা হ্যাঁচকা টানে গাড়ির ভেতর ঢোকাতে যায়, আমি পুলিশ পুলিশ বলে চিৎকার করলেও তখন সেখানে কেউ ছিল না ।বিকাশ দূর থেকে দেখে ছুটে এসে আমার আর একটা হাত ধরে টানতে থাকে, কিন্তু একটি ছেলের ঠেলাতে খুব দূরে গিয়ে পড়ে। তারপর আমি আর কিছু জানিনা কারন উত্তেজনায় আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। পরে শুনেছি বিকাশের পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গিয়েছিল। তবে বিকাশ আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু আমার ভাগ্য আমায় সায় দেয়নি। পরের দিন ওই চারজন আমাকে আবার ওই জায়গায় ফেলে দিয়ে গিয়েছিল। আমার ওই অবস্থা দেখে একজন পথচারী থানায় খবর দেয়। পুলিশের সাহায্যে আমি ওই চার জনকে শনাক্ত করেছি। তারা এখন জেলে। হয়তো তাদের সাজাও হবে কিন্তু আমার জীবনের এই দুর্ঘটনার দায় কি শুধুই আমার? খুব কষ্ট হয় যখন মা বলে বাবাকে
"এই দুর্ঘটনায় তুলির বিয়ে দেওয়া খুব মুশকিল হবে। হয়তো এই বাড়ি বিক্রি করে অন্য কোথাও চলে যেতেই হবে, মনির জন্য তুলির জীবনটা।আমরা কিছুতেই নষ্ট করতে পারি না"
তুলি আমার ছোট বোন। এ বাড়ি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। কিন্তু আমার কি করার আছে ?আমি তো ইচ্ছে করে এই ঘটনা ঘটায় নি, এটা কেউ বুঝছে না । একমাত্র সমু এখনো আমাকে ভরসা যুগিয়ে যাচ্ছে। সমু আমার ছোটবেলার বন্ধু আবার প্রতিবেশী ও বটে। আমরা একই সাথে পড়াশোনা করেছি একই স্কুলে। বয়সটাও প্রায় একই। সমু এখন দিনে দু তিনবার বাড়িতে আসে ।তখন আমি যদি চুপ করে বসে থাকি ও বলে
"দেখ একটা দুর্ঘটনার জন্য নিজের জীবনটাকে নষ্ট হয়ে গেছে ভাবিস না, আমি আছি তোর পাশে"
আমি একটু অবজ্ঞার হাসি হেসে বলি
"আমার বাবা মাই আমাকে সাথ দিতে চাইছে না, আর তিন বছর যার সাথে প্রেম করেছি সেও আজ আমার পাশে নেই , তাই এখন এসব কথা আর বলিস না"
সমু একটু চুপ করে থেকে বলে
"তুই কি করলে বিশ্বাস করবি বল তো? সত্যি করে বলছি আমি তোর পাশে থাকতে চাই"
এবার মনে হল সোমুর চোখটা জলে চিকচিক করে উঠলো। আমি বললাম
"আমার মত ধর্ষিতাকে তুই বিয়ে করতে পারবি?"
সমু মুখটা নীচু করে নিল। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর আমি নিরবতা ভেঙে বললাম
"কিছু মনে করিস না এটা যে সম্ভব নয় আমি জানি"
এবার সোমু আমাকে চমকে দিয়ে বলে উঠলো
"মনি তোকে আমি খুব ভালোবাসি কিন্তু কখনোই বলতে পারি নি। ভাবতাম কাকা কাকিমা হয়তো আমাকে খুব খারাপ ভাববে। আজ তুই যখন বললি তবে শুনে রাখ, আমি তোকে যে কোন অবস্থায় আমার নিজের করে নিতে পারি কারণ ধর্ষণ হয়েছে তোর দেহে, মনে নয়। এটা বিকাশ দা বুঝে গেলে খুব ভালো হতো কারণ জানি তোর মনটা এখনো তাকেই ভালবাসে"
সমুর দিকে আমি একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম। বিকাশ কি সমুর মতো এভাবে একবারও চিন্তা করতে পারে না? সেদিন তো বিকাশ আমার সাথেই ছিল তাও বিকাশ এই দুর্ঘটনার জন্য আমাকে দায়ী করে আমার জীবন থেকে সরে যেতে চাইছে। সমু আমার দু চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলে
"কাঁদিস না, এই দায় শুধু তোর একার নয়, তোর কোন দোষ নেই"
আমি সমুর হাতটা খুব চেপে ধরে ওর বুকে মাথাটা রেখে বলি
"তোর মত করে সবাই কেনো ভাবে না সমু?"