STORYMIRROR

Nikhil Mitra Thakur

Classics

4  

Nikhil Mitra Thakur

Classics

দুকড়িবালা দেবী

দুকড়িবালা দেবী

5 mins
532

দুকড়িবালা দেবী

নীলমণি চট্টোপাধ্যায়ের বসত বাড়ি ছিল বীরভূম জেলার নলহাটি থানার অন্তর্গত ঝাউপাড়া গ্রামে। তার স্ত্রীর নাম কমলকামিনী দেবী। তাদের কন্যা ছিলেন দুকড়িবালা চট্টোপাধ্যায়। গ্রামেই ফনিভূষন চক্রবর্তীর সাথে দুকড়িবালা দেবীর বিয়ে হয়। তাদের তিনটি সন্তান হয়,তারা হলেন সুধীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সৌরেন্দ্র কুমার চক্রবর্তী ও সমরেন্দ্র কুমার চক্রবর্তী।

ঝাউপাড়া গ্রামটি ছিল ব্রাহ্মণী নদী ঘেঁষা। ব্রাহ্মণী ও তিরপিতা নদী দিয়ে ঘেরা। চারিদিকে বাঁশঝাড়ে ভর্তি থাকায় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা অতি দুর্গম হওয়ায় বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের আদর্শ জায়গা ছিল এই গ্রামটি। দুকড়ি বালা দেবীর বোনপো নিবারণ ঘটক ছিলেন সশস্ত্র বিপ্লববাদী। তিনি মাসিমা দুকুড়িবালা দেবীর ঘরটিকে বিপ্লবী বইপত্র পড়ার নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করতেন।

কৌতুহলবশত একদিন দুকড়িবালা দেবী সকলের আড়ালে বোনপো নিবারণ ঘটকের বইপত্র পড়ে দেখেন এবং বোনপো এইসব পড়ার জন্য বকাবকি করেন।অবশ্য স্বদেশী বইপত্র পড়ে তিনি নিজেও স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। এদিকে বিপ্লবী নিবারণ ঘটক মাসিমা দুকড়িবালা দেবীর মৌন সম্মতিতে ধীরে ধীরে বিপ্লবী সদস্যদের সেখানে নিয়ে আসতে থাকেন। দুকড়িবালা দেবীর বাড়িটি স্বদেশী সশস্ত্র বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা হয়ে পড়ে।

দুকড়িবালা দেবীর বাড়িতে মাস্টার মশাই নাম নিয়ে এলেন অধ্যাপক বিপ্লবী জ্যোতিষ ঘোষ। তিনি দীর্ঘদিন এখানে আত্মগোপন করে ছিলেন। এরপর সিয়ারসোল রাজ স্টেটের কর্মচারীর ছদ্মবেশে রণেনবাবু নাম সেখানে এলেন বিপ্লবী বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী। তিনি এখানে রাজ স্টেটের কর্মচারীর হিসাবে লাঠি খেলা, ছুরি খেলা শেখানোর নাম করে দীর্ঘদিন আত্মগোপন করে থাকেন।

স্বদেশী বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ,আত্মবিশ্বাস ও সাহস দেখে দুকড়িবালা দেবী মুগ্ধ হয়ে পড়েন‌। স্বদেশী বিপ্লবী বিপ্লবীদের প্রতি তার শ্রদ্ধা জেগে ওঠে। এমন সময়ে একদিন বোনপো নিবারণ ঘটকের সঙ্গে তার বিয়ে নিয়ে তর্কে ইচ্ছাকৃত হেরে যান এবং তর্কের শর্ত হিসাবে তাকে স্বদেশী বিপ্লবী দলে যোগ দিতে হবে।

এরপরেও বোনপো নিবারণ ঘটক বারবার তাকে এই দুর্গম পথে পা বাড়াতে নিষেধ করেন। তিনি খোঁচা খাওয়া সিংহীর মত গর্জে ওঠেন। বলেন তুমি যদি দেশের জন্য প্রাণ দিতে পারো তাহলে তোমার মাও পারে প্রাণ দিতে পারে। তোমরা পুরুষরা যদি দেশের জন্য আত্মবলি দিতে পারো তাহলে নারীরাই বা কেন পারবে না।

কোন অজুহাতে দুকড়িবালা দেবীকে স্বদেশী বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষা নিতে আটকানো গেল না। আত্মগোপন করে থাকা বিপিনবিহারী গাঙ্গুলীর কাছে তিনি বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিতা হলেন। সেই থেকে বাংলার বিপ্লবীদের কাছে তিনি মাসিমা বলে পরিচিত হয়ে পড়েন।শুরু হয় স্বদেশী বিপ্লবী রূপে দুকড়িবালা দেবীর জীবনের নব অধ্যায়। দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে রক্ষা করার জন্য দুকড়িবালা দেবী অদম্য সংগ্রাম।

১৯১৪ সালে কলকাতায় বিপ্লবী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলীর নেতৃত্বে রডা কোম্পানীর মাউজার পিস্তল ও তার কার্তুজের ৫০ টি বাক্স লুট হয়। তিনি রডা কোম্পানির জেটি সরকার শ্রীমিত্রের নির্দেশ মাল খালাস করতে জেটি ঘাটে যান। ২০২ টি বাক্স বোঝায় অস্ত্র সাতটি গরুগাড়ি বোঝাই করে নিয়ে আসতে থাকেন। ছটি গরুর গাড়ি বোঝাই অস্ত্রশস্ত্র রডা কোম্পানির গুদামে পৌঁছে দেন। একটি গরুর গাড়িতে নটি অস্ত্র বোঝায় বাক্স নিয়ে ছদ্মবেশী গাড়োয়ান বিপ্লবী হরিদাস দত্ত উধাও হয়ে যান।

সেই সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ভাগ করে বিপ্লবীদের বিভিন্ন আস্তানায় পাঠানো হয়। এই সব অস্ত্রশস্ত্রের কিছু আসে নিবারণ ঘটকের কাছে। নিবারণ ঘটক সাতখানি মাউজার পিস্তল ও কার্তুজ নিজের হেফাজতে লুকিয়ে রাখার জন্য দুকড়িবালা দেবীকে দেন।

অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধারের জন্য সারা বাংলা জুড়ে ইংরেজ পুলিশের চিরুনি তল্লাশি চলতে থাকে। গোন্দলপাড়ায়

বিপ্লবী ক্ষেত্র বাবুর আস্তানায় তল্লাশির সময় পুলিশ একটা চিঠি পায়। এই চিঠিতে লেখা ছিল "নদীর ধার ঘেসা গ্রাম, বাঁশঝার ওয়ালা বলে পরিপূর্ণ। সেখানে মাসিমার কাছে ফুলের চারা ও বীজ রয়েছে। মাসিমা ফায়ার করতে জানেন।"

এই চিঠিতে কেবলমাত্র 'ফায়ার করতে জানেন' এই সূত্র ধরেই ইংরেজ পুলিশ মাসিমার খোঁজ শুরু করে। দীর্ঘ তিন বছর ধরে খোঁজাখুঁজির পর দায়িত্বে থাকা সিআইডি ইন্সপেক্টর সুবোধ চক্রবর্তী নন্দীগ্রামের এক বিয়ে বাড়িতে যান বরযাত্রী সেজে। সেখানে তিনি জানতে পারেন ঝাউপাড়ার মাসিমার কথা।

খবর পেয়েই শুরু হয় ইংরেজ পুলিশের বিশেষ তৎপরতা। ১৯১৭ সালের ৭ জানুয়ারি পুলিশ বাহিনী নিয়ে নলহাটি থানা থেকে দারোগাবাবু যান ঝাউপাড়া গ্রামে। রাতে দলবল নিয়ে ঘিরে ফেলা হয় বিপ্লবী মাসিমার বাড়ি।

ভোরের দিকে মাসিমার কানে ফিসফিস আওয়াজ আসতে থাকে। বাইরে ফিসফিস আওয়াজ শুনে তিনি বিপদের আঁচ করে খুব সাবধানে দরজার কাছে গিয়ে কান পাতেন। ফিসফিস আওয়াজের সাথে ভারী জুতোর খুটখাট আওয়াজ শুনতে পেলেন। আসন্ন বিপদের কথা স্মরণ করে অস্ত্রশস্ত্র রক্ষার জন্য মানসিক প্রস্তুতি শুরু করেন। তিনি বিপ্লবী অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিতা, তাই বুকের রক্ত দিয়েও বিপ্লবীদের অস্ত্র রক্ষা করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে পড়েন। এরপর গীতা স্মরণ করে বালিশের তলা থেকে হাতে তুলে নিলেন পিস্তল।

ভীষণ ভয়ঙ্কর বিপর্যয় বুঝতে পেরে বাক্স খুলে আরও দুটি পিস্তল কোমরে গুঁজে নেন। এরপর ছেলেকে ধীরে ধীরে ঘুম থেকে ওঠান। পুলিশের আসার কথা তাকে জানিয়ে বলেন 'পুলিশ যদি কিছু জিজ্ঞাসা করলে তোমরা শুধু কাঁদবে। অন্য কিছু বললেই পুলিশ তোমাদের মাকে মেরে ফেলবে'। তিনি বাড়ির কাজের লোক পাঁচকড়ি লেটকে ঘুম থেকে তোলেন। তার মাথায় বাক্স চাপিয়ে সশস্ত্র সৈনিকের মতো পাহারা দিয়ে প্রতিবেশী সুরধনী মোল্লানির বাড়িতে তা লুকিয়ে রাখতে রাখেন।

বাক্স লুকিয় রাখতে গিয়ে কিছুটা গোল বাঁধে মোল্লানি দেবী চেঁচিয়ে বলে ওঠেন 'ওরে পাঁচকড়ি,ওসব বাবা এখানে রাখবি না।' ওকে চুপ করানোর জন্য মাসিমা এগিয়ে যান ততক্ষণে বাড়ির পাশ দিয়ে প্রাতঃভ্রমণে যাওয়া গ্রামের নায়েব বিশ্বাসঘাতক নিলিনী রায় সব শুনে ফেলেন।

পুলিশ ধৈর্য হারিয়ে দুকড়িবালা দেবীর বাড়ির দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করে। তিনি কোন কিছু না জানার ভান করে জিজ্ঞাসা করেন, 'কে?' পুলিশ পরিচয় দিয়ে বলে, তার বাড়ি সার্চ করা হবে। পুলিশের সেই হুংকারে কোনরকম ভীত না হয়ে দুকড়িবালা দেবী পাল্টা জানান, "এখনো সকাল হয়নি। পুরুষ অভিভাবকহীন এই বাড়ি। লোকজন জেগে না ওঠা পর্যন্ত বাড়ি খোলা হবে না। অপেক্ষা করতে হবে।" সকালবেলা পুলিশ ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, জমিদারের গোমস্তা এবং গ্রামের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে বাপের বাড়ী ও স্বামীর বাড়ি সার্চ করেও পুলিশ কিছু পেল না।

সার্চ করার পর কিছু না পেয়ে পুলিশ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বাড়ির বইপত্র, জিনিসপত্র এবং খাদ্য সামগ্রী সব নষ্ট করে দেওয়ার পরও দুকড়িবালা দেবী এবং তার বাড়ির কেউ ঘুণাক্ষরে কিছু টের পেতে দেননি যে সব অস্ত্রশস্ত্র অন্যত্র সরিয়ে ফূলা হয়েছে। অবশ্য তার বাড়ি থেকে বেশ কিছু বিপ্লবী বই এবং কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়।

পুলিশ যখন ব্যর্থ হয়ে ফিরতে চলেছে ঠিক সেইসময় বিশ্বাসঘাতক নলিনী রায় কিছু উৎকোচের লোভে ইশারা করে সুরধনী মোল্লানির বাড়িতে বাক্স থাকার কথা জানিয়ে দেন। সিআইডি ইন্সপেক্টর সুবোধ চক্রবর্তী এবং সাব ডিভিশনাল পুলিশ ইন্সপেক্টর অন্নদাবাবু সদলবলে মোল্লানির বাড়ি সার্চ করতে শুরু করে। পুলিশ সেখানে গোপন বাক্সের সন্ধান পায়। গ্রেপ্তার করা হয় দুকড়িবালা দেবী এবং সুরধনী মোল্লানিকে। তাদের রাখা হয় নলহাটি থানায়। ৯ জানুয়ারি তাদের রামপুরহাট এসডিও আদালতে তোলা হয়। সুরধনী মোল্লানি জামিন পেলেও দুকড়িবালা দেবী জামিন পাননি।

বিচারের প্রস্তুতির নামে দুকড়িবালা দেবীর উপর অকথ্য অত্যাচার শুরু করে পুলিশ। অকথ্য অত্যাচার করেও তার মুখ থেকে একটাও তথ্য বের করতে পারেনি ব্রিটিশ পুলিশ। স্পেশাল ট্রাইবুনাল কেসে সিউড়িতে বিচার শুরু হলে অস্ত্র আইনের ধারায় ১৯১৭ সালের ৮ই মার্চ বিচারক তাকে দু'বছর ছয় মাসের জন্য কারাদণ্ডের সাজা দেন। তাকে পাঠানো হয় প্রেসিডেন্সি জেলে।

দুকড়িবালা দেবী পরাধীন ভারতের প্রথম মহিলা যিনি অস্ত্র আইনে দণ্ডিত হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সি জেলেও অন্যান্য খবরের জন্য তার ওপর অকথ্য অত্যাচার চলতে থাকে। তাকে দিয়ে প্রতিদিন আধমন ডাল ভাঙানো হতো। তাঁর মুখ থেকে একটিও সূত্র পায়নি পুলিশ।

জেল থেকে বেরিয়ে তিনি সমাজসেবামূলক কাজে নিযুক্ত হন। এই মহীয়সী মহিলা পরে ১৯৭০ সালের

২৮ এপ্রিল বার্ধক্যজনিত কারণে অমরত্ব লাভ করেন।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics