দর্পন
দর্পন
কোলকাতার পুজোয় এই সময়টা যানজট এক অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার। সারা বছরে এই কটাদিনই তো আমাদের বিরামহীন আনন্দের। ছটার অফিস ফেরতা এখনও যানজটে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউতেই আটকে আছি।মাথাটা পুরো ধরে আছে।স্টার্ট বন্ধ করে একটু অন্যমনস্ক হয়েছি..জানলার কাঁচে ঠকঠক্।
'কি রে সোনামনি ,অনেকদিন পর..কি খবর?..কি এনেছিস আজ ?'
ময়লা উসকোখুসকো চেহারায় উজ্জ্বল দুটি চোখ আর মায়াময় একটা মুখ। না, ও আজ আর কিছু সাথে আনেনি।গাড়ি পোছাগুলো সবকটাই বিক্রি হয়ে গেছে।ওকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম একগোছা গোলাপ ছিল ওর হাতে।তারপর থেকেই মাঝেসাঝে এই ক্রসিং এ দাঁড়ালেই কোথা থেকে চলে আসে জানলায়। সবসময়ই যে কিছু বেচতে আসে তা নয়।
মাইকের দৌরাত্ম্যে কোন কথা ঠিকমত শোনা যাচ্ছে না।হঠাৎ কি খেয়াল হল সিগনাল গ্রিন হতেই ওকে বললাম এই ফুটপাথটায় দাঁড়া, আমি আসছি।পুজোর সময় পার্কিং এর খুব সমস্যা, অনেকটা এগিয়ে গাড়িটা রাখতে হল।
'কি খাবি বল' একটা স্ন্যাকসবারের বেঞ্চে ওকে বসালাম। লাজুক হেসে বলল..
'চাউমিন।'
ওকে তৃপ্তিকরে খেতে দেখে মনটা প্রসন্নতায় ভরে গেল।ওর হাতে কিছু টাকা গুজে দিলাম..
'সাবধানে রাখ।কি করবি টাকাটা দিয়ে?'
'মাকে দেব।'
'এ বাবা! মাকে দিবি কেন?এটা তোর,যা ইচ্ছা করবি,যা ইচ্ছা খাবি।'
'না,মাকে দিলে পুজোর কদিন রোজ চুলা জ্বলবে, আমরা সবাই খেতে পারবো।'
কথাটা যেন সজোরে চড় কষালো আমার মসৃন গালে । কি স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক আমি! সাত/আট বছরের শিশুটা এই মহৎ মহান আমিকে আয়না দেখালো। লজ্জায় মাথানত করলাম..
'বেশ।'
পুজোর সাজে সেজেছে গোটা শহর,রাস্তায় নেমেছে মানুষের মিছিল । আমার উপহারের ব্যাগ ভর্তি চিপস্ ,চকলেট আর ফ্রুটি হাতে ঝুলিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রাস্তা পার হয়ে আস্তে আস্তে ভিড়ে মিশে গেল সোনামনি ।ফোনটা ভাইব্রেট করছে,বাড়ীর ফোন ।অনেকটা দেরী হয়ে গেল।আজ আমারও সপরিবারে ঠাকুর দেখতে বেরোনোর কথা। মনে হতে লাগলো যে এত আড়ম্বর, এত অপব্যয়ের মাঝে সোনামনিদের জীবন যেন প্রদীপের তলায় জমা জমাট অন্ধকার।