Rinki Banik Mondal

Crime Inspirational

2  

Rinki Banik Mondal

Crime Inspirational

দোষী

দোষী

7 mins
804


-----"একি জামা পরেছিস রে দিদিভাই!, অর্ধেকটা পা বেরিয়ে আছে, এইদিকে জামার হাতটাও তো একেবারে ফিতের মত সরু। এই ঠান্ডার মধ্যে আবার এরকম জামা!" 

-----"এটা একটু ফ্যাশন ঠাম্মি। থার্টি ফাস্টের পার্টিতে যাব। আর এমন কি হয়েছে একটু ছোট জামা পরেছি তো? আজকাল অনেক মেয়েরাই এরকম পরে আর আমাকে তো এর জন্য খারাপ লাগছে না। আমার শরীরের সাথে এই পোষাকটা মানাচ্ছে।" 

-----"তর্ক করিস না। তোর মা বাবা যে তোকে কেন কিছু বলে না বুঝিনা বাপু।" 

যবে থেকে সেনবাড়িতে শঙ্করবাবুর মা তুলসীদেবী এসেছেন ,তবে থেকে নাতনী তিন্নির সাথে কিছু না কিছু নিয়ে তর্কযুদ্ধ বেঁধেই আছে। আগে ছোট ছেলের বাড়ি ডায়মন্ডহারবারে থাকতেন তিনি, মাঝেমধ্যে বড়ছেলের বাড়ি আসতেন। তবে থাকতেন না। এবারে এসেছেন এখানে বেশ কিছুদিন থাকার জন্য। কিন্তু এখানে এসে নাতনীর চালচলন দেখে তাঁর ঘোর আপত্তি আছে। তাঁর কাছে মেয়ে সন্তানের অত দেমাক ভালো না। হয়তো তিনি আগেকার দিনের মানুষ বলেই।

কিন্তু তিন্নিও হয়েছে সেরকম অবাধ্য, ঠাম্মির মন রাখতে সে নিজেকে সংযত করতে পারবেনা। সে যাই হোক, ঠাম্মি আর নাতনীর বাকবিতণ্ডার মাঝখানে উপস্থিত হলেন তিন্নির মা ঝর্ণাদেবী ভগবানের প্রসাদ নিয়ে। 

-----"পায়েসটা খেয়ে যা।" 

-----"হ্যাঁ খেয়ে তো যাচ্ছি, তবে ভগবানের প্রসাদ বলে নয়, তোমার হাতে বানানো পায়েস বলে।" 

-----"কি বললি তুই, ভগবানের প্রসাদকে অমান্য করে তুই সেখানে মায়ের হাতের স্বাদ খুঁজছিস?" 

-----"তো কি হয়েছে ঠাম্মি? মানুষই তো ভগবান। আমি মূর্তি পূজা বিশ্বাস করি না ঠাম্মি, আমি মানুষকে বিশ্বাস করি।" 

-----"চুপ কর তুই। এসব কি শিক্ষাদিক্ষা বৌমা ওকে দিচ্ছ?" 

-----"আমাকে ক্ষমা করো ঠাম্মি। এতে আমার মা-বাবার কোন দোষ নেই। আমি তো এরকমই। আসছি ঠাম্মি। রাত্রে দেখা হবে। মা আসছি।"  


ঝর্ণাদেবী শুধু ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিলেন মেয়েকে। তিন্নি যাওয়ার পরই সন্তানকে শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে আরও দশ কথা বৌমাকে শুনিয়ে দিলেন তুলসীদেবী। আর তারসাথে এইটাও শুনিয়ে দিলেন কি তার ছোট ছেলের ঘরের ছেলেটা মানে তার আরেক নাতি অনেক সহবত জানে। ঝর্ণাদেবী কোনদিনও শাশুড়িমা'র মুখের ওপর কথা বলেনি, আজও তার অন্যথা হয়নি। শাশুড়িমার গম্ভীর গলায় শাসন সে আজও মুখ বুজে সহ্য করল।

কলেজ শেষে আজ তিন্নি আর কয়েকজন বন্ধু মিলে গেছে অভিদের বাড়ি। থার্টিফাস্ট নাইট উপলক্ষে সেখানে বন্ধুদের সাথে বেশ খাওয়া-দাওয়া আর জমিয়ে আড্ডা হল। সেখানে ঘড়ির কাঁটায় যখন রাত ন'টা, তখন তিন্নি বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসে। আর সব বন্ধুরা অভিদের বাড়িতেই রয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই বলেছিল তিন্নিকে অপেক্ষা করতে, কিন্তু তিন্নি আর অপেক্ষা করতে রাজি নয়। কারণ ওর মা-বাবা মুখে কিছু না বললেও যথেষ্ট চিন্তায় থাকবেন। তাদের অমর্যাদা ও করতে পারে না। সাতপাঁচ না ভেবে তিন্নি একটি ক্যাবে করে বাড়ির পথে রওনা হল।

বাড়ি আসার পথে তিন্নির মনে পড়ছে, ওর বাবার কথা। ওর মার কাছেই গল্প শুনেছে ও। ওর বাবা মানে শঙ্করবাবু একজন গৃহশিক্ষক ছিলেন। তিনি গৃহশিক্ষকতা করেই সংসার চালিয়ে একসময় অনেক কষ্ট করেছেন। তারপরে তিন্নি হওয়ার পর সরকারি হাই স্কুলে শিক্ষকতার চাকরিটা পান। বাড়ির কোন লোকই সেইসময় শঙ্করবাবুকে সাহায্য করেনি। ঝর্নাদেবীকে তিনি বাড়ির অমতে বিয়ে করেছিলেন। তাই সকলের থেকেই তিনি বঞ্চিত হয়েছিলেন। এমনকি বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। ভাড়াবাড়িতে থেকেই সংসারের হাল ধরেছেন। এখন মনের মত একটা বাড়ি বানাতে পেরেছেন। তিন্নি মানে, এইটা শঙ্করবাবুরই কষ্টের ফল।

হঠাৎই গাড়িটা জোরে ব্রেক কষাতে তিন্নির ভাবনাতে ছেদ পড়ে। ক্যাবের ড্রাইভার গাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িটাতে কি সব যন্ত্রপাতি দিয়ে খুটুর-খাটুর করেন। তারপর তিনি এসে বলেন- 

-----"দিদিভাই গাড়িটাতে কিছু সমস্যা হচ্ছে। আমি ঠিক করার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারছিনা। আপনি অন্য একটা ক্যাব করে নিন। মনে হচ্ছে গাড়ি ঠিক করতে সময় লাগবে, মেকানিককে খবর দিতে হবে।" 

তিন্নি গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। যদিও বাড়ি আসতে বেশি দেরী নেই। কিন্তু সেখানেই তো ছিল ওর বিপদ। তিন্নি ঠিক করে ও হেঁটেই চলে যাবে। ফাঁকা অন্ধকার গলিতে তিন্নির মত একটা ঊনিশ-কুড়ি বছরের মেয়েকে দেখে অনেকগুলো শয়তান ওকে ঘিরে ধরে। লোলুপ দৃষ্টিতে ওর দিকে হাত বাড়ায়। তিন্নি প্রাণপণে চেষ্টা করেছিল ওদের হাত থেকে বাঁচবার। কিন্তু কখন যে, কে ওর মাথার পেছনে একটা জোরে আঘাত করল, তারপর আর ওর কিছু মনে নেই। 


*********


-----"তিন্নি শুনতে পারছ? তুমি চোখ খোলো, দেখো তোমার মা বাবা এসেছেন।" 

একটা ভারী গলার আওয়াজে তিনি চোখ মেলে তাকায়। তিন্নি আবছা চোখে দেখতে পায়, একজন ডাক্তার আর ওর মা বাবা। তিন্নি বুঝতে পারে, ও বাড়িতে নেই। হয়তো হাসপাতলে। তিন্নি দেখে ওর মা ওকে দেখে অঝোরে কাঁদছে। তিন্নি মনে মনে ভাবতে থাকে, হয়তো ঐ ঘটনায় ওর সাথে কোনো খারাপ কিছু ঘটে গেছে। কিন্তু তখনই ওর বাবার আশ্বাসে ওর বুকে একটু জল এলো। 

-----"তুই যা ভাবছিস তার কিচ্ছু হয়নি মা, তোকে কেউ হালকা ডোজের ঘুমের ওষুধের মত নেশার জিনিস কিছু খাইয়ে দিয়েছিল। আর তোর মাথাতেও একটা আঘাত পাওয়া গেছে। আর কিচ্ছু হয়নি।" 

এরই মধ্যে পুলিশ এসে পুরো ঘটনা তিন্নির কাছ থেকে জানলেন। পুলিশ চলে যাওয়ার পর হঠাৎই ঝর্ণাদেবী এসে তিন্নির গালে একটা সপাটে চড় কষিয়ে বলেন-  

------"আমাদের মান সম্মান সব ধূলোয় মিশে গেল, সমাজে মুখ দেখানোর উপায় নেই আমাদের। অসভ্য মেয়ে একটা। মরে যেতে পারলি না তুই?" 

মায়ের কথাতে তিন্নির মনটা যেন দগ্ধ হয়ে গেল। ও তো বুঝতেই পারছে না এতে ওর কি কোন দোষ আছে! আর ওর সাথে তো তেমন কিছু হয়নি। কারণ ওর বাবা'ই তো ওকে বলেছে। আজ গাড়ি থেকে নামিয়ে তিন্নিকে ঘরে নিয়ে এল শঙ্করবাবু। বাড়িতে আসতে না আসতেই শঙ্করবাবুর মা তুলসীদেবীর একের পর এক তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ তিন্নিকে একেবারে ক্ষতবিক্ষত করে দিল। তবে শঙ্করবাবু তার মেয়েকে সব সময় আগলে রেখেছেন। তার জন্য অনেকের সাথেই তিনি তর্কে জড়িয়ে পড়ছেন।  

-----"পোড়ামুখী এইটাই বাকি ছিল! তোর বাড়াবাড়ি দেখেই বুঝেছিলাম আমি, তুই কোন সর্বনাশ ঘটাবি।" 

-----"চুপ করো মা, ওকে কেউ কিছু বলবে না তোমরা। ওর কোন দোষ নেই। দোষ ঐ শয়তানগুলোর।" 

-----"চুপ কর্ তুই বড় খোকা। তোর মেয়ে যে ধরণের পোষাকগুলো পরে, ওগুলো কি ভদ্র সমাজের মেয়েরা পরে? আর ওই মেয়ে ভগবান বিশ্বাস করে না। দেখলি তো ভগবানের দেওয়া শাস্তি। সমাজের মুখ দেখানোর পথ বন্ধ করে দিয়েছে। এবার তো এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে তোকে।" 

-----"মা দয়া করে চুপ করো, ওকে একটু বিশ্রাম নিতে দাও। আজ তুমি পোষাকের নামে দোষ দিচ্ছ, তাহলে ঐ ছোট্ট শিশুগুলো কেন পশুদের হাতে বলি হচ্ছো বলো?"

ঠাম্মি আর বাবার কথোপকথন শুনে হাজার প্রশ্ন চিহ্নমুখে তিন্নি শঙ্করবাবুকে জিজ্ঞেস করলো- 

-----"কি হয়েছে বাবা? মা, ঠাম্মি এরকম করছে কেন আমার সাথে? তুমি যে বললে আমার কোনো সর্বনাশ করেনি ওরা। তাহলে? 

-----"না,,আসলে,," 

-----"কি আসলে? চুপ করে থেকো না বাবা। বলো আমায়।"  

বাবা মেয়ের কথার মাঝখানেই তুলসীদেবী উত্তরে বলে উঠলেন-


 -----"মুখ পুড়িয়েছিস তুই। তোর ঐসব নোংরা ছবি সবার ফোনে দেখা গেছে।" 

তিন্নি কাছে এই কথা পরিষ্কার নয়। ও আবার ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করলো- 

-----"কি হয়েছে বাবা? বলো আমায়?" 

-----"আসলে মা, ওরা তোর শরীরের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি ঠিকই, তবে তোর নগ্ন ছবি সোশ্যাল সাইটে পোস্ট করেছিল। তবে তুই চিন্তা করিস না মা। এইটা একটা ষড়যন্ত্র। আমাদেরকে বদনাম করার জন্য। পুলিশ সব ব্যবস্হা নিয়েছে। কিছু সময় পরেই পোস্টগুলো সোশ্যাল সাইট থেকে সরিয়ে দিয়েছে।"

ঝর্ণাদেবী এবার বলে উঠলেন- 


-----"ঐটুকু সময়তেই যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গেছে। তুমি আর শাক দিয়ে মাছ ঢেকো না। পাড়ার দুজন মানুষই তো তোমায় খবরটা দিলেন। তারা যখন জানতে পেরেছে, পুরো পৃথিবী জানতে পেরেছে।" 

সব শোনার পর তিন্নির মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। কি হল, কেন হল ওর মাথাতেই আসছে না। তবে একটি ছেলে কদিন ধরে ওকে বিরক্ত করছিল, সেটা তো আজ ও পুলিশকেও জানালো হসপিটালে। কিন্তু পুলিশ তো এই ছবির বিষয়টা কিছুই বলেনি। এইসব নানা প্রশ্নের, নানা চিন্তার কথা হঠাৎ ঘুরপাক খেতে থাকে তিন্নির মাথায়।

এরইমধ্যে ক্রিংক্রিং শব্দে বাড়ির ফোনটা বেজে ওঠে। তার সাথে বাড়িতে উপস্থিত সকলের মনটাও ধড়ফড়িয়ে ওঠে। যদিও বাড়িতে উপস্থিত দুএকজন পাড়ার প্রতিবেশীদের মধ্যে একটা খুশির মেজাজই বয়ে যায়। থানা থেকে ফোন করে জানায় ছেলেগুলো নাকি ধরা পড়েছে। অফিসাররা আবার নাকি আসবে, তিন্নির সাথে কথা বলতে।

তিন্নি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মাটিতে দুম করে বসে পড়ে। সেদিনই রাত্রিবেলা তিন্নি ঠিক করে, নিজেকে একেবারে শেষ করে ফেলবে, কিন্তু শঙ্করবাবুর জন্য তা আর হয়ে ওঠেনি। শঙ্করবাবু মেয়ের এই পরিস্থিতিতে এরকমই কিছু একটা আন্দাজ করেছিলেন। 

-----"ছেড়ে দাও বাবা আমায়। আজ আমি নিজেকে শেষ করে দেব।"

-----"কখনোই নয় মা। এতে তোর কি দোষ মা? দোষ তো ওদের, যারা এরকম অসভ্যতা করেছে। সমাজ কি বলল, তোর নিজের লোক কি বলল তাতে কান দিস না মা। তুই তো জানিস, তোর কোনো দোষ নেই। তাহলে?" 

-----"সত্যিই আমি পারবো বাবা, এই সমাজের কথাকে তুচ্ছ প্রমাণ করতে?" 

-----"দেখ, মা, মুখে বলাটা যতটা সহজ হবে, কাজে করাটা ততটাই কঠিন হবে। পদে পদে ধাক্কা খাবি। এখনো পর্যন্ত যা যা খারাপ কথা লোকে তোর উদ্দেশ্যে বলেছে, এর থেকেও অনেক বেশী শোনা তোর পক্ষে বাকি আছে। কিন্তু তুই ভয় পাস না মা। তোকে লড়াই করে বাঁচতে হবে। তুই পারবি মা। আমি তোর পাশে সবসময় আছি।"

এই বলে শঙ্করবাবু তিন্নিকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তিন্নির চোখে জল। শঙ্করবাবুর বুকের মাঝখানটাতে এসে তিন্নির মনটা একটু হালকা হল। 

(দোষ তো ঐ শয়তানগুলোর যারা নারীদের সর্বনাশ করে। এরজন্য নারীর পোষাককে দায়ী করে কি লাভ? ঐ নির্দিষ্ট মেয়েটার মনের জোর সমাজকেই বাড়াতে হবে, আর তা যদি না হয়, তাহলে মেয়েটাকে দোষী করার কোনো অধিকার সমাজের নেই। নারী বলেই সব সময় তাকে মাথানত করতে হবে, এটা কিন্তু ঠিক নয়।) 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Crime