চলো যাই আশেপাশে
চলো যাই আশেপাশে


বহুদিন ধরে’ বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্ব্বতমালা
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।।
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অতি বড় বাস্তব কথাখানাকে কবিগুরু কি সুন্দর ছন্দে বেঁধেছেন। সত্যিই তো আমরা বড় বড় বাক্স-প্যাটরা গুছিয়ে ট্রেনে-প্লেনে চড়ে কত জায়গা ঘুরে ফেলি কিন্তু আমাদের খুব কাছাকাছি জায়গাতেও ভারী সুন্দর সুন্দর দেখার জিনিস আছে। প্রকৃতি তো অকৃপণ। তিনি সব জায়গায় দরাজ হস্ত তাই জানুয়ারি মাসের এক শীতের সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই আমাদের প্ল্যান তৈরী হয়ে গেল যে আমরা যাবো বেলপাহাড়ী আর ঝাড়গ্রাম ঘুরতে। জেলা ভাগ হবার পর এই জায়গা দুটো ঝাড়গ্রাম জেলার অন্তর্গত হয়েছে কিন্তু একসময় ছিল আমার জেলা পশ্চিম মেদিনীপুরেই অংশ।
পরের দিন সকাল সাড়ে ছটায় সবাই গাড়িতে চড়ে বসলাম। আমার ছোট্ট ছানা যীশুকে নিয়ে মোট নয় জনের দল আমাদের। মেদিনীপুর শহর ছাড়িয়ে গাড়ি ছুটে চলল। প্রথম গন্তব্য খান্দারানী লেক। প্রায় আড়াই ঘন্টার পথ মেদিনীপুর শহর থেকে। নাম শুনে ফিক করে একটু হেসে ফেলেছিলাম কিন্তু পৌঁছনোর পর মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতিকে উপভোগ করলাম। দূরে উঁচু উঁচু টিলা আর চারিদিকে জঙ্গলের নির্জনতার মাঝে শান্ত হয়ে শুয়ে রয়েছে খান্দারানী আর সোনালী সূর্যের আলো তার জলে হীরক দ্যুতির সৃষ্টি করছে। পরিযায়ী পাখিদেরও দেখা মেলে এখানে। ছোট্ট সেতুটি পেরিয়ে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেলাম। সবুজের শ্যামলিমায় দুচোখ জুড়িয়ে গেল। লেকের ধারে একটি পিকনিকের দলের দেখা পেলাম। প্রকৃতির এত সৌন্দর্য ক্যামেরা বন্দি তো করতেই হয় তাই বেশ কয়েকখানা ফোটো তুলে ফেললাম। ইচ্ছে না থাকলেও খান্দারানীকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে বসতেই হলো। একটু এগোবার পর মজার একটা ঘটনা ঘটল। আমার বড় মেসোমশাই আবিষ্কার করলেন যে তিনি যখন জঙ্গলের মাঝে হাত-পা ছড়িয়ে বসে বুক ভরে বিশুদ্ধ বাতাস গ্রহণের চেষ্টা করছিলেন তখন তাঁর চশমাটি সেখানে ছাড়া হয়ে গেছে। রাস্তা সরু তারই মধ্যে বহু কষ্টে গাড়ী ঘুরিয়ে আবার খান্দারানী। আমাদের তো ভারী মজা হলো। মেসো চশমা খুঁজতে গেলেন আর সেই ফাঁকে আমরা গাড়ি থেকে নেমে একদম জলের কাছে চলে গেলাম। সেইখান থেকে খান্দারানীর রূপ যেন আরও সুন্দর মনে হলো।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য গাডরাসিনি পাহাড়। বেলপাহাড়ী থেকে আট কিলোমিটার দূরত্ব। গাডরাসিনি পাহাড়ের পাদদেশে আছে একটি আশ্রম। লাহিড়ী মহারাজ ও স্বামী যোগানন্দের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত এই আশ্রম। প্রতি বছর অগ্রহায়ন মাসে বিশেষ উৎসব হয় এখানে। আশ্রম পেরিয়ে আমরা চললাম গাডরাসিনি পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। আমার মা, বড়মেসো আর দিদা প্রথমেই ক্ষান্ত দিলেন। যীশুকে কোলে নিয়ে একটু ওঠার চেষ্টা করলাম কিন্তু আলগা পাথরে ভর্তি চড়াই পথ। বুঝলাম সম্ভব নয়। ততক্ষণে আমার বোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আর নয় তাই বোন যীশুকে নিয়ে নেমে গেল। বেশ ভয় ভয় লাগছিল যদি পা পিছলে পড়ে যাই। দুপাশে জঙ্গল মাঝে রাস্তা। সাবধানে উঠতে লাগলাম তারই মধ্যে আবার যীশুর বাবার ফোটো তুলে দিতে হলো। বেশ কিছুটা ওঠার পর একটি বিষ্ণু মন্দির পেলাম। সেখানে বসে একটু জিরিয়ে নিয়ে নেমে আসবো ভাবছিলাম এমন সময় দেখলাম কয়েকজন সশস্ত্র জওয়ান পাহাড়ের ওপর থেকে একজন পুরোহিত মশাইকে নিয়ে নামছেন। জওয়ানদের একজন বললেন যে আর মাত্র একশ মিটার মত উঠলেই একদম শীর্ষে পৌঁছে যাব। সেখানে একটি শিব মন্দির আছে তবে পুরহিত মশাই ওনাদের সঙ্গে নেমে যাচ্ছেন। যাই হোক ওনার কথায় উৎসাহিত হয়ে আবার উঠতে আরম্ভ করলাম কিন্তু মনে হলো এই একশ মিটার পথটাই সবচেয়ে কষ্টকর। পথ বলে কিছু নেই সেরকম। পা স্লিপ করলে বিপদ হতে পারে। রীতিমতো ঘেমে-নেয়ে গেছি। অবশেষে একসময় পৌঁছে গেলাম শীর্ষে। উঠে দেখি আমার বাবা আর বড় মাসিমনি আগেই পৌঁছে গেছেন । আমরাও দুখানা পাথর খুঁজে বসে হাঁপাতে লাগলাম। একটু সামলে নিয়ে যখন ওপর থেকে চারিদিকে তাকালাম সব কষ্ট উধাও হয়ে গেল। আকাশের নীল আর দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেত-জঙ্গল সবুজ দিকচক্রবালে পরস্পরের হাত ধরেছে। অপূর্ব সে দৃশ্য। শিব মন্দিরটি বন্ধ তাই দেব দর্শন না করেই ফেরার পথ ধরলাম। নীচে নেমে এসে দেখি যীশু তার আধো আধো বুলিতে রীতিমতো গল্প জুড়েছে জওয়ানদের সাথে। তাঁদের হাতের বড় বড় বন্দুকগুলোই তার কৌতূহলের বিষয়। সে গল্প শেষ হতে আবার একটি ভ্রমনার্থী পরিবার ওর সাথে আলাপ-পরিচয় করলেন। যীশুর গল্পগাছা পর্ব মিটতে আমরা আবার গাড়িতে চড়ে বসলাম। পরবর্তী গন্তব্য ঘাঘরা ফলস। পাথরের ওপর প্রকৃতির অসাধারণ খেলা আর পান্না সবুজ জল। চারিদিকে শাল-পিয়ালের জঙ্গল। প্রকৃতি এখানে নির্জন থেকে নির্জনতর। বর্ষাকালে ঘাঘরা ফলসের দুরন্ত রূপ দেখার মত। শুনলাম এখানে নাকি বাংলা সিনেমা " বেহুলা-লখিন্দরের" শুটিং হয়েছিল। ঘাঘরার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে বুঝতো পারলাম পেটের মধ্যে ছুঁচোগুলো ক্যারাটে-কুংফু শুরু করে দিয়েছে। বেলপাহাড়ীতে এসে হোটেলে দুপুরের খাওয়া সারলাম মাছ-ভাত দিয়ে। যীশু অবশ্য বাড়ি থেকে বানিয়ে আনা খিচুড়ি খেল কারণ খাবারে ভালোমত ঝাল ছিল।
উদর পূর্তি করে আমরা চললাম চিলকি গড়ের উদ্দেশ্যে। চিলকি গড়ের মূল আকর্ষণ দুটি চিলকি গড় রাজবাড়ী আর কনক দুর্গার মন্দির। সেই সঙ্গে আছে ডুলুং নদী। নামের মতোই নদীটিও ভারী মিষ্টি। রাজবাড়ী আর মন্দিরের মাঝখান দিয়ে সে বয়ে চলেছে উচ্ছল কিশোরীর মত। রাজবাড়ীর চারিদিক পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বর্গী আক্রমণ ঠেকানোর জন্যই এরকম করা হয়েছিল। কনক দুর্গার মন্দিরের মূল চত্বরে ঢোকার আগেই পড়বে নানা প্রকার ঔষধি গাছে পূর্ন জঙ্গল। অনেক মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ গাছে ভরা এই জঙ্গল। এখানেই একপ্রকার বিশেষ প্রজাতির বাঁদরের বাস যদিও তাদের দর্শনের সৌভাগ্য আমাদের ঘটেনি। মূল মন্দির চত্বরটি খুবই খোলামেলা। একধারে পুরান ভগ্নপ্রায় মন্দিরটি দাঁড়িয়ে আছে অন্যদিকে নতুন মন্দিরে বিরাজ করছেন দেবী মহামায়া। কনক শব্দের অর্থ সোনা। মূল বিগ্রহটি পাথরের হলেও সেটি সম্পূর্ণ সোনা দিয়ে মোড়া। এই মন্দিরের ইতিহাস প্রায় তিনশ বছরের পুরনো। জনশ্রুতি অনুসারে রাজা গোপীনাথকে স্বপ্নাদেশ দেন দেবী মহামায়া। একই সঙ্গে শিল্পী যোগেন্দ্রনাথ কামিল্যা এবং ব্রাহ্মণ রামচন্দ্র সারঙ্গীও স্বপ্ন দেখেন। এই শিল্পীই স্বপ্নে দেখা দেবী মূর্তিকে বাস্তব রূপ দেন আর আজও সারঙ্গী পদবিধারীরাই মন্দিরের পূজারী নিযুক্ত হন।
মন্দিরে আমরা সবাই পুজো দিলাম। মন্দিরের সামনের খোলা চত্বরে তখন ধামসা-মাদল সহযোগে আদিবাসী নৃত্য অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। আমরা কিছুক্ষণ সেই নাচ দেখার পর চারিদিক ঘুরে দেখতে লাগলাম। যীশু ততক্ষণে সেখানে দোলনায় উঠে দোল খেতে আরম্ভ করে দিয়েছে। বেশ খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আমরা বেরিয়ে এলাম। পার্কিং লটের বাইরে অনেকে পিকনিক করছেন দেখলাম।
এবার আমাদের গন্তব্য প্রায় বারো কিমি দূরের ঝাড়গ্রাম শহর। প্রথমেই গেলাম জঙ্গলমহল জুলজিক্যাল পার্কে যা ঝাড়গ্রাম মিনি চিড়িয়াখানা বা ঝাড়গ্রাম ডিয়ার পার্ক নামেই অধিক পরিচিত। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই চিড়িয়াখানাটি একটি শাল জঙ্গলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এন্ট্রি ফি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই যীশু আনন্দে লাফিয়ে উঠলো একটা বাচ্চা হাতি দেখে। এরপর একে একে ভালুক, ফিশিং ক্যাট, শেয়াল, হায়না প্রভৃতি অনেক রকম পশু দেখলাম। এই চিড়িয়াখানার মূল আকর্ষণ অজস্র হরিণ। বিশাল এলাকা জুড়ে হরিণদের স্বাভাবিক বিচরণ ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির পাখিও দেখলাম। গোখরো, অজগর ইত্যাদি নানা ধরনের সাপও আছে তবে চুপিচুপি একটা কথা জানাই আমি ভয়ে সাপের খাঁচার দিকে যাইনি। আমাকে যীশু এসে কি কি সাপ আছে তার বর্ণনা দিয়েছিল।
মনের আনন্দে চিড়িয়াখানা ঘুরে চললাম ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ীর উদ্দেশ্যে কিন্তু আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। বিশেষ কারণে দর্শনার্থীদের ঢোকা বন্ধ ছিল তখন। শুধু বয়স্ক মানুষ বলে আমার দিদাকে গেটের ভেতরে ঢুকে সামনেটা একটু দেখতে দিয়েছিলেন সিকিউরিটির দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন তাঁরা। দিদার সাথে ফ্রি মানুষ হিসেবে যীশুও অবশ্য ঢুকে পড়েছিল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল এরপর ঘরে ফেরার পালা। ফেরার পথে চাঁদড়ায় আমরা চা খেলাম আর যীশু খেল রসগোল্লা। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ঢুকেই মনে হল আবার যে কোনও দিন বলে উঠব, “ চলো লেটস গো।”