Sayandipa সায়নদীপা

Thriller Fantasy

3  

Sayandipa সায়নদীপা

Thriller Fantasy

চক্রাবর্তন (দ্বিতীয় পর্ব)

চক্রাবর্তন (দ্বিতীয় পর্ব)

11 mins
995


ধনী বাড়ির একমাত্র ছেলে মৃত্যুঞ্জয়। চার দিদির পর হওয়া এই ছেলেটি তাই বাড়ির সকলের চোখের মণি। ছোট থেকেই যা চেয়েছে তাই পেয়েছে কিন্তু তাও মৃত্যুঞ্জয়ের ক্ষিদে যেন কিছুতেই মেটেনা। ছোট থেকেই তার মনে হতো আরো কিছু চাই তার, আরো বেশি কিছু চাই। যত বড় হয়েছে এই পাওয়ার ক্ষিদে ততই বেড়েছে কিন্তু ঠিক কি টা পেলে তার মনে সন্তুষ্টি আসবে সেটাই কোনোদিনও বুঝে উঠতে পারতো না সে। পড়াশুনোতে মৃত্যুঞ্জয়ের কোনোদিনও বিশেষ মন ছিল না, বাড়ির লোকও তাদের আদরের ছেলেকে বিশেষ জোর করেননি। বাবা তো প্রায়ই বলতেন আমি যা রেখে যাবো তিন পুরুষ বসে খাবে। টাকা পয়সার লোভ মৃত্যুঞ্জয়ের ছিলো না কিন্তু তার যে ঠিক কিসের লোভ ছিলো, কি পাওয়ার আশা তাকে তাড়া করে বেড়াতো সেটা দীর্ঘদিন তার কাছে অজানাই ছিলো। 


   এরপর তার জীবনে এলো সেই দিন। এক শীতের সন্ধ্যায় হঠাৎই তাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন এক সাধক। পরনে কালো আলখাল্লা, মাথায় কালো ফেট্টি, কপালে রক্ত তিলক, গলায় খান কয়েক রুদ্রাক্ষের মালা আর একখানা কাপড়ের ঝোলা। সেই বাবাজির চোখের দিকে তাকালেই যে কারুর গায়ের রক্ত জল হয়ে যেত। তার গলার স্বরে গোটা বাড়িটা যেন গমগম করছিল। মৃত্যুঞ্জয়ের বাবা ধর্মভীরু ব্যবসায়ী মানুষ। সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই আগত এই অদ্ভুত পোশাক পরিহিত সাধককে সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন, স্বেচ্ছায় নাকি ভয়ে সেটা বিতর্কের বিষয়। মৃত্যুঞ্জয়ের মায়ের মনটা অবশ্য কেমন যেন কু গাইছিল কেননা সাধকের বেশভূষা দেখে তাঁর দৃঢ় ধারণা হয়েছিল যে ইনি নিশ্চয় শ্মশান সাধক। কিন্তু এ হেন বাবাজিকে কুপিত করার পরিণাম ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারে এ কথা ভেবেই তিনি বাবাজির সেবায় মন দেন। ভেবেছিলেন সকাল হলেই বাবাজি চলে যাবেন, একটা রাতের তো মোটে ব্যাপার। কিন্তু এই একটা রাতই যে তাঁর জীবনে কি মারাত্মক ঝড় আনতে চলেছে তা তিনি তখন কল্পনাও করতে পারেননি।


  সকালে সকলে ঘুম থেকে উঠে দেখে বাড়ির সদর দরজা খোলা, বাবাজি তাঁর ঘরে নেই। তার মানে ভোরের আলো ফোটার আগেই তিনি চলে গেছেন। কিন্তু একটু পরেই সকলে আবিষ্কার করে মৃত্যুঞ্জয়ও নিজের ঘরে নেই। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যায়না। থানা পুলিশ সব হয় কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়ের হদিশ কেউ এনে দিতে পারেনা। শোকে মৃত্যুঞ্জয়ের মা প্রায় পাগল হয়ে যান আর তাঁর বাবাও বিছানা ধরেন। আঠেরো উনিশ বছরের একটা জোয়ান ছেলের এভাবে রাতরাতি উধাও হয়ে যাওয়াটা কেউই মেনে নিতে পারেন না। কিন্তু এই শোকের মাঝেও সবার অলক্ষ্যে একজন মুচকি হাসতে থাকে। সে আর কেউ নয়, মৃত্যুঞ্জয়ের মেজ জামাইবাবু, মৃন্ময়। অনাথ এই ছেলেটিকে মৃত্যুঞ্জয়ের বাবা পুত্রস্নেহে মানুষ করেছিলেন এবং বড় হতে নিজের ব্যবসার কাজেও নিযুক্ত করেন। পরে মেজ মেয়ের সাথে বিয়েও দেন। সেই ছেলে আজ তার যোগ্য প্রতিদান দেয়। ব্যবসার সমস্ত ক্ষমতা নিজের করায়ত্ত করার জন্য সে দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করছিল। ভাগ্যও তার সহায় হয়, তাই তো হঠাৎ করেই একদিন কাকতলীয় ভাবে এই বাবাজির সাথে তার আলাপ হয়। বাবাজির কাছেই জানতে পারেন যে উনি একটি শক্ত সামর্থ্য কম বয়েসী ছেলের সন্ধানে আছেন। মৃন্ময় আর দেরি করেনি, নিজের শালাবাবুর সাথে ছোটবেলা থেকেই অনেকটা সময় কাটাবার দরুন তার মনের হাল হকিকত মৃন্ময়ের বিশেষ অজানা ছিল না; এমনকি নিজের মনের যে খবর স্বয়ং মৃত্যুঞ্জয়ের কাছেও অজানা ছিল ধুরন্ধর মৃন্ময়ের কাছে সে খবরও বিশেষ গোপন ছিল না। তাই এই মোক্ষম সুযোগটাকে সে কাজে লাগিয়ে ছকটা কষে। যদিও সে ভাবেনি যে এক রাত্রিরের মধ্যেই বাবাজি মৃত্যুঞ্জয়কে ফুঁসলিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন। তবে যাই হোক মৃন্ময়ের উদ্যেশ্য সফল হয়। লিখিতভাবে না হলেও শ্বশুর মশাইয়ের অসুস্থতার কারণে ব্যবসার সমস্ত ক্ষমতা তার কুক্ষিগত হয়।


   বছর সাতেক পর হঠাৎ করেই একদিন মৃত্যুঞ্জয় বাড়ি ফিরে আসে। চেহারার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছিল কিন্তু সব থেকে যে পরিবর্তন টা নজরে পড়েছিল সবার তা হলো মৃত্যুঞ্জয়ের চোখ দুটো। ওর চোখে এখন ছিল সেই আগুন যে আগুন আজ থেকে বহু বছর আগে বাবাজির চোখে দেখেছিল মৃত্যুঞ্জয়ের পরিবার। সকলে মিলে বেশ কয়েকবার মৃত্যুঞ্জয়কে জেরা করে, সে এত দিন কোথায় ছিল! কিভাবে ছিল! কিন্তু কেউ কোনো উত্তর পায়না। তারা আর ওকে বেশি ঘাঁটাতেও সাহস পাননা। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে, এর বেশি আর কি চাই। মৃত্যুঞ্জয়ের মায়ের মাথা অনেকটাই সেরে যায়, তার বাবাও খানিক সুস্থ হয়ে ওঠেন। ওই কথায় বলে না আমাদের রোগের মূল আসলে আমাদের মনে। যাইহোক, মৃত্যুঞ্জয়ের প্রত্যাবর্তন গোটা বাড়িতে খুশির হওয়া আনলেও বলাই বাহুল্য একজন খুশি হতে পারেনা, মৃন্ময়। সে নতুন করে ভাবতে থাকে কিভাবে সরানো যায় তার পথের কাঁটাকে।


  “আসতে পারি মৃন্ময়দা?”


চমকে ওঠে মৃন্ময়, এতক্ষন যার কথা ভাবছিল সে স্বয়ং এসে তার দরজায় উপস্থিত।


“আরে আরে জয়, এসো এসো। তুমি এতদিন পর ফিরলে অথচ তোমার সাথে আমার ঠিক করে কথাই বলা হয়নি।”


“ব্যবসার কাজে ভীষণ ব্যস্ত?”


“হেঁ হেঁ তা যা বলেছ ভাই, তুমি যাওয়ার পর বাবার এই অবস্থা। এখন তো আমাকেই সব দিক সামলাতে হয়।”


“আমাকে দেখে তুমি খুব চমকে গেছো তাই না?”


মৃন্ময়ের আবার চমকাবার পালা। কোনো মতে ঢোঁক গিলে বলে , “এমন কেন বলছো?”


“চমকাওনি?”


“না … মানে … ইয়ে… এতদিন পর তুমি এলে…”


“আমি সব জানি। গুরুজীর সাথে প্ল্যান করে তুমি আমাকে সরিয়ে ছিলে।”


“কি বলছো তুমি এসব! ভুলভাল কথা সব।”


“ভুল যে নয় সে তুমিও জানো। এখন যদি বাঁচতে চাও তো আমি যা চাইবো আমাকে দিতে হবে নয়তো সবার কাছে তোমার সত্যিটা ফাঁস করে দেব।”


“কি চাই তোমার?”


“টাকা, অনেক টাকা।”


“কেন?”

“আহ, কোনো প্রশ্ন নয়। শোনো এই ব্যবসা, এই সম্পত্তি আমার চাইনা। আমার শুধু সময়ে সময় কিছু টাকা চাই যেটা তুমি আমাকে দেবে।”


“বাবাজি কোথায়?”


“তোমার জানার প্রয়োজন নেই। রাজি কিনা বলো?”


“রাজি হওয়া ছাড়া তো উপায় নেই। কত টাকা চাই?”


“মাঝে মাঝে আসবো এখানে তখন যা আমাউন্ট চাইবো দিতে হবে। বুঝলে?”


“যদি না দি?”


“আজ সাত বছর বাবাজির সঙ্গে ছিলাম তাই সত্যি টা সকলের কাছে ফাঁস করা ছাড়াও আর যে কি কি করতে পারি আমি সে তুমি ভালো করেই আন্দাজ করতে পারো।”


   

   গুরুদেব উঠে দাঁড়ায়। নাহ বাপনের ওপর নজর রাখতে হবে ভালো করে, অন্তত এই কটা দিন। বলা তো যায়না কোথা দিয়ে কি হয়ে যায়। বাবাজিও কি কোনোদিনও ভাবতে পেরেছিলেন যে তাঁরই বিশ্বস্ত অনুচর মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে তাঁর অভীষ্ট সিদ্ধির ঠিক আগে মুহূর্তে তাকে মরতে হবে! হ্যাঁ, মৃত্যুঞ্জয় নিজের হাতে খুন করেছিল বাবাজিকে। সাত বছর ধরে সে বাবাজির সাথে ছায়ার মতো লেপ্টে থেকে একটু একটু করে শিখেছিল বিভিন্ন তন্ত্র মন্ত্র, কিছুটা বাবাজি নিজে শিখিয়েছিলেন আর কিছুটা মৃত্যুঞ্জয় শিখেছিল তাঁর অজ্ঞাতে। আসলে ওনার সব থেকে বড় ভুল যেটা ছিল সেটা হলো মৃত্যুঞ্জয়কে অন্ধের মতো বিশ্বাস করা। উনি মৃত্যুঞ্জয়কে সাধাসিধে একটা ছেলে ভেবে ভুল করেছিলেন। মৃত্যুঞ্জয়ের মধ্যে ছিল পিপাসা, অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা লাভের পিপাসা। আর সেই ক্ষমতা পাওয়ার জন্য সে যে কোনো মূল্য চোকাতে রাজি ছিল। গোপনে তাই সে বাবাজির ওপর নজর রাখতো, তার প্রতিটি পদাঙ্ক জরিপ করে নিজের স্মৃতিতে সংরক্ষিত করে নিতো। তারপর যা যা জানার ছিল সব জানা শেষ হতেই মোক্ষম সময়ে সে বাবাজির বুকে আমূল বিদ্ধ করে দেয় সেই ধারালো ছুরি, যেটা দিয়ে বাবাজি একটার পর একটা মেয়েকে হত্যা করিয়েছিলেন তাকে দিয়ে নিজের সাধনার জন্য। বাবাজির টাকা পয়সা বিশেষ ছিলো না, বিভিন্ন জায়গায় ডাক পেয়ে গিয়ে যেটুকু আয় হতো সেটুকুই ছিল সম্বল তাই যথোপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবে বাবাজির নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে অনেক সময় লেগেছিল। কারণ টাকাপয়সা ছাড়া আজকাল কিচ্ছু হয়না। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় বাবাজির মতো নয়। সে জানতো কিভাবে কম সময়ে নিজের অভীষ্ট সিদ্ধি করতে হয়। তাই মাত্র তিন বছরে সে নিজের লক্ষ্যের এত কাছে পৌঁছে গেছে, মৃত্যুঞ্জয় থেকে হয়ে উঠেছে গুরুদেব। আর মাত্র কয়েকটা দিন ব্যস। তারপরই পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী তন্ত্র সাধকে পরিণত হবে সে, এক আশ্চর্য অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা কুক্ষিগত হবে তার, যার সাহায্যে সব রকম অসাধ্য সাধন করতে পারবে সে। আর এই কাজের জন্যই তার এতদূর ছুটে আসা, এই বন্দিপুরে। বন্দিপুর শ্মশানের শান্ত নিঃঝুম পরিবেশকেই সে বেছে নিয়েছে তার সাধনা সম্পূর্ণ করার স্থান হিসেবে। বন্দিপুর একসময় ছিল বেশ বড় অবস্থাপন্ন গ্রাম কিন্তু এক বছর হঠাৎ করেই তিনদিনের এক অজানা জ্বরে ঘরের পর ঘর উজাড় হয়ে যেতে থাকে, এমন অবস্থা হয় যে এক ঘরে কেউ কাউকে জল দেয়ার লোক পাওয়া যায়না। যারা সুস্থ ছিল তারাও অন্যত্র পালিয়ে বাঁচে। সেই থেকে বেশিরভাগ লোকই আর ফেরেনি গ্রামে। কয়েকটি মাত্র পরিবার যাদের অন্য কোথাও গিয়ে নতুন করে ঘর বাঁধার সামর্থ্য ছিল না তারাই রয়ে গেছে এখনো এই গ্রামে। তাদেরই কল্যানে বন্দিপুর শ্মশান পরিত্যক্ত তকমাটা এখনো পায়নি। মাঝে মাঝে আসে এক আধটা মৃত দেহ দাহ হওয়ার জন্য। নিশু ডোম লোকটাও আশ্চর্য। শোনা যায় লোকটা আসলে ডোম ছিল না, ছিল চাষী। মড়ক এর সময় পুরো পরিবারকে হারিয়ে সে অর্ধ পাগল হয়ে যায়। তখন থেকে শ্মশানে এসে ছোট্ট একটা কুঁড়ে বেঁধে বাস করে, বলে এখানে থাকলে নাকি মনে হয় সে তার পরিবারের সঙ্গে আছে। যাই হোক, এই বন্দিপুর শ্মশানে আসার পেছনে গুরুদেবের আরো কারণ আছে। শোনা যায় মড়ক এর সময় নাকি মৃতদেহ গুলোর ঠিক মতো সৎকারও হয়নি তাই সেই সব গ্রামবাসীর অতৃপ্ত আত্মা এই শ্মশানের বাতাসে ভেসে বেড়ায়। আর এমন পরিবেশই তো গুরুদেবের সাধনার জন্য সর্বাধিক উপযুক্ত, তাই তিনি নিজের সাধনার অন্তিম পর্বের জন্য এমন চমৎকার স্থান বেছে নিয়েছেন, যেখানে আকাশে বাতাসে অশরীরী চেতনা।


   বন্দিপুর … শ্মশানের নামটা ভেবেই হেসে ফেলল মৃত্যুঞ্জয় ওরফে গুরুদেব। সে যদিও জানে না কেন এই জায়গাটার এরূপ নামকরণ হয়েছে কেন কিন্তু সামনের অমাবস্যা থেকে এই জায়গাটার নাম সার্থক করে তুলবে, মৃত্যুকে সে বন্দি করবে এখানে। হাঃ হাঃ হাঃ ... কিন্তু এসবের মাঝেই তার মনে আজকাল এক ভয়ের উদ্রেক হচ্ছে, মাঝে মাঝেই বাপনের মধ্যে তিনি দেখতে পাচ্ছেন সেই কয়েক বছর আগের মৃত্যুঞ্জয়কে!


       

                      বন্দিনীর ইতিবৃত্ত


সপাটে চড় টা এসে পড়ে শ্রীময়ীর গালে। টাল সামলাতে না পেরে শ্রীময়ী ধাক্কা খায় দেওয়ালে, কপালটা সঙ্গে সঙ্গে লাল হয়ে ওঠে। 

“ নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে..”


“ ছিঃ ছিঃ … গ্রামে আর মুখ দেখাতে পারবোনা তোর জন্য।”


“দাদা আমি কি অপরাধ করেছিলাম যে আমার নিজের মেয়ে আমার মুখে এভাবে চুনকালি লাগালো!”


বাবা আর জেঠুর ক্রমাগত বাক্যবাণের সামনেও নীরব থাকে শ্রীময়ী, কারণ সে জানে এখানে প্রতিবাদ করা বৃথা। মুখ বুজে সব শুনে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার। সব শেষ।


“মণি তোর লজ্জা করলো না একবারও? সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে হয়ে তুই এরকম একটা নিচু জাতের ছেলের সাথে … ছিঃ ছিঃ”


“ পেটে কালসাপ ধরেছিলে… দেখো দেখো … নিজের চোখে দেখো।”, এবার মন্তব্যটা ধেয়ে যায় দরজা ধরে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের জল ফেলতে থাকা শ্রীময়ীর মাকে লক্ষ্য করে। মাও এবার বলা শুরু করেন, “হ্যাঁ রে এসব করার আগে তোর একবারও নিজের মা বাবার মুখ টা মনে পড়লো না?”


শ্রীময়ী আগের মতোই স্থানুবৎ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, কোনো উত্তর দেয়না। জেঠুর রাগের পারদ আরো চড়ে যায়, বলে ওঠেন, “ইচ্ছে করছে তোকে জ্যান্ত পুঁতে দি। লেখা পড়া শিখতে দেওয়া হয়েছিল মেয়েকে আর এই সে শিক্ষা নিয়েছে! আমাদের এতো বছর ধরে গড়ে তোলা সম্মান … সব ধুলোয় মিশিয়ে দিলো । ছিঃ ছিঃ।”


জেঠুর হুকুমে মা শ্রীময়ীকে টানতে টানতে ওর রুমে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দেন। এতক্ষণ নীরব থাকার পর এবার শ্রীময়ী কান্নায় ভেঙে পড়ে। সে বুঝতে পারেনা এখন তার কি করণীয়, শুধু সামনে যেন দেখতে পায় এক বিশাল অন্ধকার আসছে তাকে গ্রাস করতে।


   বাঁশপুকুর গ্রামের এক বর্ধিষ্ণু ব্রাহ্মণ পরিবারের একমাত্র কন্যা শ্রীময়ী; সকলের আদরের। গ্রামের অন্য মেয়েদের অনেক কম বয়সে বিয়ে হয়ে গেলেও শ্রীময়ীর ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে তার পরিবার তাকে পড়াশুনো চালিয়ে যাওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিল। স্কুল ফাইনাল পাশ করার পর শ্রীময়ী কলেজে ভর্তি হয়, প্রতিদিন বাসে করে যাতায়াত করতো। গ্রামের লোক নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে নানা কথা আলোচনা করতে শুরু করে ঠিকই কিন্তু সামনে কিছু বলার সাহস পায়নি এতদিন। তার কারণ শ্রীময়ীর দোর্দণ্ডপ্রতাপ জেঠু শিশির কুমার ভট্টাচার্য্য যাকে গ্রামের ছেলে বুড়ো সকলে ডরায়। পড়াশুনো আর বাড়ির বাইরে শ্রীময়ীর আর কোনো জগৎ ছিলো না। কিন্তু মানুষের জীবনের আবহাওয়া চিরকাল এক রকম থাকে না। শ্রীময়ীর জীবনেও শরৎ বিদায় নিয়ে আসে বসন্তের ছোঁয়া। আর তা আসে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবেই।


   রোজ বাসে যাতায়াত করার সুবাদে বাসে অনেক লোকের সাথেই মুখ চেনা হলেও কোনোদিনও কারুর সাথে আলাপ হয়নি শ্রীময়ীর। বাচাল বা মিশুকে সে কোনোটাই নয়। বাসের নিত্য যাত্রীদের মধ্যেই একজন ছিল অরূপ। রোজ বাসে দেখা হলেও কোনোদিনও কথা হয়নি দুজনের মধ্যে। শ্রীময়ী সুন্দরী… বাসে তাই সবার নজর একবার করে হলেও ওর দিকে যাওয়া ছিল অবশ্যম্ভাবী, অরূপও এর ব্যতিক্রম ছিল না। যতবার শ্রীময়ীর চোখ অরূপের চোখের দিকে চলে যেত শ্রীময়ী ততবারই অরূপের চোখে দেখতে পেত নিজের জন্য এক প্রচ্ছন্ন প্রশংসা। কিন্তু শ্রীময়ীর মনে তা কোনো দাগ কাটেনি কোনোদিন কেননা তার রুপে মুগ্ধ এমন লোকের সাথে সাক্ষাৎ তার প্রায় প্রতিদিনই হয়। কিন্তু বিধাতা যে অরূপকে শুধু একজন সাধারণ রূপমুগ্ধ হিসেবে শ্রীময়ীর জীবনে পাঠাননি! ভাগ্যের বিড়ম্বনায় একদিন শ্রীময়ীর সাথে অরূপের আলাপটা হয়েই যায় আর শ্রীময়ী অবাক হয়ে দেখে অন্যদের মতো অরূপের চোখে তার জন্য নেই কোনো কামনা, আছে শুধু এক অন্যরকম শ্রদ্ধা। ধীরে ধীরে অরূপের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হতে শুরু করে শ্রীময়ীও, কোনো এক দুর্নিবার আকর্ষণে সে বারবার ছুটে যেতে থাকে অরূপের কাছে। অরূপের মধ্যে খুঁজে পায় ভালোবাসার এক অন্যরূপ। পুরুষ মানেই যে শুধু দমন পীড়ন নয়, পুরুষ যে ভালোবাসা, আগলে রাখা, আদরে রাখারও নাম হতে পারে তা অরূপকে কাছ থেকে দেখে শ্রীময়ী প্রথম উপলব্ধি করতে পারে। শ্রীময়ী জানতো তার বাড়িতে জানাজানি হলে কি সর্বনাশ হতে পারে কিন্তু তৎসত্ত্বেই নিজেকে সংযত করতে পারেনা সে। যতবার চেষ্টা করে অরূপের থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে চলে যেতে ততবারই যেন সজোরে গিয়ে আছড়ে পড়ে অরূপের বুকে। কোনো এক অদৃশ্য স্থিতিস্থাপক বন্ধনী দিয়ে যেন বিধাতা তাদের বেঁধে দিয়েছেন। অবশেষে মস্তিস্ক আর হৃদয়ের দীর্ঘদিনব্যাপী যুদ্ধের পর জয়ী হয় হৃদয়ই, শ্রীময়ী নিজেকে সমর্পণ করে অরূপের কাছে। এক অনাবিল আনন্দের সমুদ্রে ডুব দিয়ে কেটে যায় একটা বছর। শ্রীময়ী উপলব্ধি করে অরূপকে ছাড়া তার জীবন অসম্পূর্ণ। সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করত সাময়িক রাগারাগি করলেও তাদের ভালোবাসার কাছে তার পরিবার নিশ্চয় নতি স্বীকার করবে, মেনে নেবে অরূপকে।


  কিন্তু শ্রীময়ী বা অরূপ দুজনেই ভুলে গিয়েছিল বসন্তের পরই আসে গ্রীষ্মের দাবদাহ। গ্রামের ভেতর কথা হাওয়ার থেকেও দ্রুত ছোটে। তাও তো শ্রীময়ী আর অরূপের অনুরাগের খবর গ্রামে এসে পৌঁছতে পুরো একটা বছর লেগেছিল; কিন্তু যখন পৌঁছালো তখন পৃথিবী ওলট পালট করা কালবৈশাখী ডেকে আনলো। সত্যের সাথে গ্রামের লোকের অতিরঞ্জিত কল্পনার রঙের মিশেলে যা শ্রীময়ীর পরিবারের কাছে উপস্থাপিত হলো তার ফল হলো মারাত্মক।


  অল্পদিনের মধ্যেই বলপূর্বক শ্রীময়ীর বিয়ে হয়ে গেল শহরের ধনী ব্যবসায়ী হরিশ্চন্দ্র চক্রবর্তীর একমাত্র ছেলে মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তীর সঙ্গে। জাত্যাভিমান এতই প্রকট ছিল ভট্টাচায্যি পরিবারের কাছে যে মেয়ের বিয়ে দেয়ার আগে ভালো করে খোঁজখবরও নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করলেননা। পালটি ঘর, ধনী পরিবার … ব্যস। কিন্তু তারা একটু খোঁজ খবর করলেই জানতে পারতেন চক্রবর্তী পরিবারের এই ছেলেটির ইতিহাস যে ধোঁয়াশার চাদরে আচ্ছাদিত। তারা জানতেও পারলেন না যে তাদের একমাত্র কন্যা আসলে হয়ে গেল শ্রীমতী চক্রবর্তীর এক বিশেষ পরীক্ষার গিনিপিগ। বিবাগী ছেলেকে হয়তো ঘরে স্থিত করতে পারবে এই আশায় চক্রবর্তী গিন্নি সুন্দরী বৌমা আনলেন ঘরে, কিন্তু বিধি বাম।


   ফুলশয্যার রাতে মৃত্যুঞ্জয় শ্রীময়ীকে জানালো তার আসল পরিচয় … সে সাধক তাই তার কাছ থেকে শ্রীময়ী যেন স্বামীর ভালোবাসা প্রত্যাশা না করে। শ্রীময়ীও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। তার দেহ মন সব অরূপের জন্য, নাই বা পেলো অরূপকে এ জীবনে কিন্তু তাও অরূপের সাধনায় সে তার কৌমার্য সংরক্ষণ করে রাখতে পারবে এ কথা চিন্তা করেই আনন্দিত হল। মৃত্যুঞ্জয় শ্রীময়ীকে প্রস্তাব দিল তার সাধন সঙ্গিনী হওয়ার, তার সাথে এই বাড়ি ছেড়ে তার আশ্রমে যাওয়ার। উপায়ান্তর না দেখে শ্রীময়ী সম্মত হলো। মৃত্যুঞ্জয় শ্রীময়ীর নতুন নামকরণ করলো “ ছায়া” ।


ক্রমশ...



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Thriller