ছায়ানট সপ্তদশ পর্ব
ছায়ানট সপ্তদশ পর্ব
শুনশান পথ ঘাট । সন্ধ্যে হতে না হতেই ঝোপেঝাড়ে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায় একটানা । মেঠোপথে সাপখোপের ভয় থাকেই।
প্রভুদাস দোকানের ঝাঁপ ফেলতে দেরী করলেন । খদ্দের তো ফিরিয়ে দেওয়া যায় না ! তবু অন্য দিনের আগেই দোকান বন্ধ করে চললেন দেউলটির দিকে । রমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে।
কতদিন পেটে ভালোমন্দ জোটেনি । আজ হয়তো খাবারগুলো স্বাদিষ্ট হবেই । তার চেয়েও বড় কথা রমা বলেছে সম্পত্তি ফেরৎ দেবার কথা । দেখা যাক কি হয় !
মোরাম বিছানো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলেছেন তিনি। হাতে একটা লন্ঠন । তারই আলোয় পথ দেখে চলেছেন ।
গ্রামের লোকজনও লন্ঠন বা হ্যারিকেনের আলোয় অভ্যস্ত। তিনিও তাই । খুব অসুবিধা হচ্ছে না ।
পথ চলতে একটা পুকুর পড়ল । তার পাড় ধরে রাস্তাটা ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে ধানের ক্ষেত বাঁচাতে। মধু কুঁইরির সাথে দেখা ।
- অ ঠাকুর ! পথ ভুলে এদিকে কুথায় যাও ?
প্রভুদাস বলেন - পথ ভুলিনি রে মোধা ( মধু নামটা এমনই বিকৃত হয় গেঁয়ো ভাষায় ) । রমামা নেমন্তন্ন দে গেছে। তা রাখতেই আমার তোদের গাঁয়ে আসা ।
- অ । তবে যাও গো। ঠেসে খেওনি কিন্তু ।
- কেন রে শালা ? তোকে উপদেশ দিতে কে বলেছে ?
- না গো ঠাকুর। এমনি বললাম ।
- নে সর দেখি । আমাকে যেতে দে ।
মধু সরে দাঁড়ায় । প্রভুদাস চলতে শুরু করেন ।
সাড়ে সাতটা নাগাদ রমাদির বাড়িতে পৌঁছে প্রভুদাস সিদ্ধান্ত দরজার কড়া নাড়েন ।
রজনীকান্ত বাবু এসে দরজা খুলে দেন । প্রভুদাসকে দেখে বলেন - আরে আসুন আসুন। আপনার জন্যই ওয়েট করছি। রমা ! ও রমা ! এই দেখ বেয়াই মশাই এসে গেছেন । বৈশালী ভেতরের ঘরে ঢুকে যায় । বুড়োটার মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না । মাগধীও ভেতরে চলে যায় । রমাদি নেমে এসে বলে - খুড়ো এসে গেছ। এস তোমার জন্য আমাদের কারোরই খাওয়াদাওয়া হয়নি ।
ভবতারণ এসে দেখা করে ।
প্রভুদাস ভয় পান । এ তো দেখি সবাই এসেছে। জিজ্ঞেস করেন - চাটুজ্যে মশাইও আছেন নাকি?
রমাদি বলে - খুড়ো তুমি রেডিও শোননি ?
- কোথায় পাব মা ? সবই তো কেড়ে নিয়েছিস ।
রমাদি হাসে । - আমি কিছু করিনি খুড়ো। সব তোমার কপালের দোষ ।
- মানে ?
- সেই মানেটা বোঝাব বলেই তো তোমাকে ডেকেছি। নাও চল , হাত মুখ ধুয়ে আগে খেয়ে নাও । তারপর সবাই মিলে একসাথে বসে আলোচনা করব ।
- আলোচনা ? কিসের আলোচনা ? হেই মা আর সবার সামনে অপমান করিসনে । বলেছি তো ভুল করেছিলাম।
রমাদি বলে - আগে চল খেয়ে দেয়ে নিই ; তারপর গল্প শুরু হবে ।
রাতের খাবারে এত আয়োজন দেখে প্রভুদাসের চোখে জল চলে এল । কতদিন যে খাইনি !
খাওয়া দাওয়া শেষ হলে রমাদি প্রভুদাসকে নিয়ে দোতলার কোণার বড় ঘরে এনে বসাল ।
বলল - আমরা আসছি দশ মিনিট পর । ততক্ষণ তুমি একটু জিরেন দাও ।
প্রভুদাসেরও এর চেয়েও বেশী সম্পত্তি ছিল । ধান জমি , খামার বাড়ি, দোকান, পুকুর কি ছিল না। ছিল না শুধু একটা পাকা বাড়ি । যেটা ইচ্ছে করলেই বানিয়ে নিতে পারতেন । মুশকিল হল ছেলের বিয়ে দিয়ে । প্রথম প্রথম বৈশালীকে বৌমা বলে ডাকতেন। পরে কি যে হল পাপিষ্ঠ মনের! বৌমা কথাটা হঠাৎ ছোট হয়ে গেল । শুধু বৌ বলতেন - যেমন বলত প্রভুদয়াল । আর ওর বৌটা নেহাতই অপরিপক্ক ছিল তাই তাঁর পাপের ডাকটা বুঝতে পারেনি।
আর এর জন্য দায়ী ছিলেন চাটুজ্যেমশাই নিজে। তিনি তাঁর মেয়ের প্রতি এমন আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁর কাণ্ডজ্ঞানও লোপ পেয়েছিল । ফলশ্রুতি তো হাতেনাতে।
চাটুজ্যেমশাই প্রায় আসতেন । মেয়ের রূপচর্চা করতেন। সদ্য বিপত্নীক প্রভুদাসের মন উথালপাথাল করে দিয়ে পরের দিন চলে যেতেন ।
- বুঝলেন বেয়াই ! আর কিছুদিন আগে যদি আপনার স্ত্রী মারা যেতেন; তবে বৈশালীকে আমি প্রভুদয়াল নয়; আপনার হাতেই তুলে দিতাম । রোগা লিকলিকে জামাই করতাম না । আপনার মত সুপুরুষের সাথেই বৈশালীর বিয়ে দিতাম ।
এই ভাবে নিজের ছেলেকে ধীরে ধীরে হিংসে করতে শেখালেন চাটুজ্যে মশাই । আর তাঁর পাতা ফাঁদে অতি সহজেই পা কেন গলাটাও বাড়িয়ে দিলাম ।
- অমন ছেলে থাকা না থাকা সমান । চাটুজ্যে মশাই বলেছিলেন।
- ওর সাথে আমার মেয়েকে এক্কেবারেই মানায়নি । এর চেয়ে আপনি নিজেই ঢের ভালো ছিলেন । কিন্তু কি করব ? মেয়েটার কপালই এযনি ।
প্রভুদাস নিজেকে বীরপুরুষ ভাবতেন।
- আমিও সেটাই মনে করি মশাই । ছেলেটা কোন কাজেরও নয় জানেন ; যা বলি তার উল্টো করে বসে ।
চাটুজ্যে মশাই বলেছিলেন - বৈশালীকে আপনার মনে ধরে গেছে না ?
প্রভুদাস উত্তর দেননি । লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিয়েছেন ।
গোরুকে জাবনা দিতে গিয়ে ভাঙা দেয়ালে হাত রেখেছিল ছেলেটা । সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল - ও বাবাগো, জ্বলে গেল পুড়ে গেল ।
তারপর কেমন চুপ করে গেল । চাটুজ্যে মশাই দৌড়ে গিয়ে দেখলেন ।
- গোখরোয় কেটেছে মনে হচ্ছে ।
প্রভুদাস তখন জৈষ্ঠ্যমাসের গরমেও ঠকঠকিয়ে কাঁপছেন।
চাটুজ্যে মশাই গেলেন ওঝা ডাকতে । ছেলে তখন গোঙাচ্ছে । ওঝার আসতে দেরী হল । এখন বেশ বোঝা যায় চাটুজ্যে ইচ্ছে করেই দেরী করে দিয়েছেন। ওঝা রুগী দেখেই বলে দিল - আর কিছু করার নাই গো। সব শেষ হয়ে গেছে । ঘরে তখন বৈশালী আছাড়ি-পিছাড়ি কাঁদছে।
- এ আমার কি হল গো ! বাবা ( চাটুজ্যে মশাইকে উদ্দেশ্য করে ) এবার কি হবে ?
চাটুজ্যে মশাই প্রভুদাসকে বললেন- যান সামলান । আমি চললুম । এখানে তো আমার আর কোন কাজ নেই ।
প্রভুদাস ছেলের সৎকার করতে গেলেন । একা বৌ ঘরে থাকতে পারবে না বলে পড়শীর মেয়েদের ডেকে পাহারার বন্দোবস্ত করে গেলেন ।
সেই রাতেই যাবার আগে চাটুজ্যে বলে গেলেন - বৈশালীকে মানিয়ে নেন এবার । ও তো এখন থেকে আপনার হেপাজতেই রইল ।
প্রভুদাস যেন নতুন বৌ পেয়ে গেলেন। স্বয়ং চাটুজ্যে বলেছেন যখন ; তাঁর চেষ্টা করতে দোষ কি ?
সকলেই শুনল প্রভুদাসের কথা । বৈশালী, মাগধী রমাদি সবাই । বৈশালীর মনে হল ধরণী দ্বিধা হও। মাগধী বলল- তাহলে আমার স্বামীর মৃত্যুর জন্যও কি বাবাই দায়ী ?
ভবতারণ বলল - বোধ হয় না । কেন না বাবা বড় একটা সেখানে যেতেন না । তবে মায়ের যাতায়াত ছিলই ।
- তবে কি মা ?
রমাদি বলল - না, আমার মনে হয় মাধবদাকে মারার পিছনেও তোমার বাবা-ই আছেন । তবে মাধবদার বাবাকে উস্কানি দিয়েছিলেন তোমার মা । অবশ্য এটা আমার মনে হয় । ভুলাও হতে পারে । আর সঠিক ঘটনা জানতে হলে এথোড়া আমাদের যেতেই হবে ।
রমাদি প্রভুদাসকে বললেন - যদি আপনি আপনার সম্পত্তি ফেরত পেতে চান তবে পুলিশের সামনে সত্যিটা স্বীকার করবেন । কি আছে ! আপনার তো ফাঁসি হবে না ; ডড় জোর জেল জরিমানা হতে পারে। আর তাই বা কেন ? আপনি তো কোন খুন করেননি । খুন করেছে তো আমার শ্বশুর ।
প্রভুদাস কি বুঝলেন বললেন - রমামা যা বলবি আমি তাই করব ।
সবাই আনন্দিত হয়ে বলল - তাহলে তো এবার রাত কাটিয়ে ভোর বেলায় রওনা দিতে হয় ।
রমাদি বলল - খুড়ো রাতটা এখানেই কাটিয়ে ভোর বেলায় যাবে ।
প্রভুদাস বললেন - মা গো আমি তো যেতে পারব না। বিক্রির টাকা চাটুজ্যেকে না দিলে যে ঝামেলা হবে !
- কোথায় ঝামেলা ? এখন ওঁরা দু'জনেই পুলিশ হাজতে।
প্রভুদাস অবাক হয়ে বললেন - পুলিশের এত ক্ষমতা ? তবু মা গো আমায় বাদ দে । তোরা ঘুরে আয় ; আর আমার বৌমাকে বলিস যেন ওর এই ছেলেটাকে মাফ করে দেয় ।
বৈশালী উঠে এসে গলায় কাপড় জড়িয়ে প্রভুদাসকে প্রণাম করল ।
- তোমার মঙ্গল হোক মা ! প্রভুদাস কৃতজ্ঞতা জানালেন।
রমাদি বলল - এই নাও খুড়ো তোমার মাসোয়ারা । আর কিছুদিনের ভেতরেই তোমার সম্পত্তি ফেরৎ পেয়ে যাবে ।
( ক্রমশঃ)
-
