ছায়ানট সপ্তবিংশ পর্ব
ছায়ানট সপ্তবিংশ পর্ব
টেলিফোনে সংবাদ ছড়িয়ে দিলেন ডক্টর সুবীর বল। কে নাগার্জুন ফোন রেখে মনে মনে ভাবলেন মেঘ হয়তো কেটে গেছে ।
এদিকে রজনীকান্ত বাবু পরিবার পরিজনদের নিয়ে কলকাতায় এসেছেন তাঁর সদ্য কেনা বাটিতে। স্বল্প পরিসরে এতগুলো লোক নিয়ে একটু ফ্যাসাদেই পড়েছেন। তিন বেডরুমের ছোট্ট এই বাড়িতে টয়লেট এবং বাথরুম উঠোনের উল্টোদিকে বেশ খানিকটা দূরে। তবে উঠোনটা বেশ বড় ।
শীতের সকালে সূর্য্যোদয় থেকে সূর্য্যাস্ত রোদ ঝলমল করে উঠোনে । তুলনায় রুমগুলো একটু অন্ধকার । পরিকল্পনা মাফিক এখানেই রমাদি একটা অনাথ শিশুদের জন্য আশ্রম বানাবে বলে সকলে মিলে কলকাতা এসেছেন ।
আপাতত এই বাড়িতেই দু'চারটে শিশুকে রাখাই যায় । রমাদি সকলকে বাড়িতে রেখে বাবাকে বলল - চল, নিকটবর্তী থানায় এবং কোর্টে এফিডেবিট করিয়ে আসি।
কোর্টের কথা বলতেই রজনীকান্ত বাবুর নাগার্জুন সাহেবের কথা মনে পড়ে গেল । লোকজন, হৈ-হট্টগোলে গত দু'দিন তাঁর সঙ্গে কথাই হয়নি । কি জানি কি ভাবছেন তাঁকে নিয়ে !
রজনীকান্ত বাবু বললেন - সে তো হবেই। মা ! বলছিলাম আজ দু'দিন কলকাতায় আসা হল ; মিঃ কে নাগার্জুন সাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করলে হত না ?
- বেশ তো ! চল না ! তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসি ।
ওঁরা থানায় কাজ সেরে চললেন স্টার হোটেলের দিকে ।
রাস্তায় ট্রাফিক তেমন নেই । রবিবার - ছুটির দিন । অফিসের তাড়া নেই বলে অতিরিক্ত ভীড়ও নেই । ওঁরা ঘন্টাখানেকের মধ্যে স্টার হোটেলে পৌঁছে গেলেন ।
রিসেপশনে গিয়ে ২২২ নং রুমের বর্তমান অধিবাসীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন । ইন্টারকমে রিং বাজল ২২২ নং ঘরে।
মিঃ নাগার্জুন ফোন তুলে ' গুড মর্নিং ' বলতেই সুন্দরী রিসেপশনিস্ট জানাল - স্যার ! সামওয়ান মিঃ রজনীকান্ত ওয়ান্টস টু মিট ইউ।
তারা লিফট বেয়ে সাত তলায় ২২২ নং রুমের সামনে দাঁড়ালেন। মিঃ নাগার্জুন এক মুখ হাসি নিয়ে তাঁদের অভ্যর্দনা করলেন । প্রথমেই রিকোয়েস্ট করলেন তাঁর সঙ্গে লাঞ্চ করতে ।
রজনীকান্ত বাবু বললেন - সে হবে'খন । এখন বলুন কোন অসুবিধা হচ্ছে কি না ।
রমাদি বলল - স্যার, কোন আশা আছে ?
মিঃ নাগার্জুন - আছে মানে ! ধরে নিন কেস ফয়সালা করে দিয়েছি উইথ পজিটিভ রেজাল্ট । গতকাল রাতে মিঃ বল ফোন করে জানিয়েছেন মিঃ বিপত্তারণ চ্যাটার্জী ও মিসেস তকসশীলা দেবী বোথ আর ইন ইনসেন মাইণ্ড ।
রমাদি নেচে উঠল যেন । দু'হাত কপালে ঠেকিয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাল ।
বলল - বাবা ! এখনও পর্য্যন্ত সব ঠিকঠাক চলছে। জানি না ভবিষ্যতে কি হবে!
রজনীকান্ত বাবু বললেন - আমারও এই কথাটা মনে হয়েছে। কিন্তু আইন ব্যবসা অন্য, চিকিৎসা শাস্ত্রও ভিন্ন। দু'টোর এমন ধারা পরাগ মিলন হবে ভাবতে পারিনি।
মিঃ নাগার্জুন বললেন - তদন্ত রিপোর্ট এবং নিম্ন আদালতের রায় পর্য্যবেক্ষণ করে প্রথমেই এই অসঙ্গতিটা আমার নজরে পড়ে । তাই তো কেসটা হাতে নিয়েছি।
রজনীকান্ত বাবু বললেন - স্যার । এবার আসি। এত বড় খবর আর চেপে রাখতে পারছি না । সবাইকে বলি গে' যাই।
- সেকি রজনী ! উইদাউট লাঞ্চ তো আমি ছাড়ব না । তোমার মেয়ে এসেছে আমার ঘরে তাকে তো কিছু না খাইয়ে ছাড়ছি না।
রজনীকান্ত বললেন - স্যার, খাওয়াটা কোন কথা হল ! যে কোনদিন খেলেই হবে । আপনি তো দশ তারিখ পর্য্যন্ত কলকাতায় আছেন ? কলকাতা লিভ করার আগে অবশ্যই খেয়ে নেব ।
- দিস ইজ ভেরি ব্যাড রজনী ! এটলিস্ট ব্রেকফাস্ট করতেই হবে ।
রমাদি বলল - স্যার খাওয়ানোর কথা তো আমাদের ! আপনি আমাদের গেস্ট । আজ আসি , কথা দিচ্ছি পরশু মানে যেদিন আদালত বসবে - সেদিন রায় শোনার পর সকলে মিলে ডিনার করব ।
মিঃ নাগার্জুনকে আশ্বস্ত করে ওরা বেরিয়ে এল স্টার হোটেল থেকে ।
পথে বাবা মেয়েতে খুনসুটি করতে করতে নতুন বাড়িতে এসে খবরটা দিল ।
হেমা বা ক্ষমা দু'জনে তখন নাচতে নাচতে বলল - হো যায়ে পিকনিক।
ঈশানি দেবী চমকে উঠলেন । রজনীকান্তকে একটু আড়ালে ডেকে বললেন - ঢেকির স্বর্গেও সুখ নেই ।
রজনীকান্ত বাবু ঢোক গিলে বললেন - তোমার ভয় নেই। এত জনের জন্য রান্নাবান্না করতে হবে না । খাবার দাবারের বন্দোবস্ত করে দিয়েছি । ঠিক ঠিক সময়ে ঠিক ঠিক লোকের হাতে চা, জলখাবার, লাঞ্চ, ডিনার সব হোটেল থেকে আসবে ।
- আমি কি রান্নাবান্নার কথা বলেছি না কি ? বাড়িতে কে ও সব করত বল তো !
ঈশানি দেবী ঢয় পেয়েছিলেন পাছে পিকনিকের রান্নার ভার নিতে হয় । কিন্তু স্বামীর কথায় ভরসা পেলেন ।
রজনীকান্ত বাবু বললেন - এখানেও তোমাকৈ রান্না করতে হবে না । তারও বন্দোবস্ত করেছে রমা । আমিষ, নিরামিষ সব পদ আছে।
রমাদি এগিয়ে এসে বলল - কি ফিসফিস করছ মা ?
- কই ? কিছু না তো !
- বুঝেছি । তোমার মনের কথা। তাই তো এরেঞ্জ করতে গেলাম । আর শোনো এর পর থেকে আর কোনদিন তোমাকে রান্নাঘরে যেতে হবে না । কেবল তদারকি করবে ।
ঈশানি দেবী বললেন - কাজ তো বেড়ে গেল মা !
রসময় বাবু পাশেই ছিলেন। বললেন - এখন আর পিছন ফিরে তাকাতে চাই না। এই দৃষ্টি ছাড়লাম সামনে। আলো অন্ধকার দুটোই দেখছি। চয়েস অপনা অপনা ।
প্রভুদাস বাবু বললেন - সংশোধিত সংস্করণ। আর কোন না নেই। এবার শুধু আলোটুকু ধরে রাখার আশা।
রমাদি বলল - আশা নিরাশা দুই থাকবে । ঠিক আলো আর অন্ধকারের সংযোগে। আমরা মানুষের দৃষ্টি নিয়ে দেখব । দেব বা অসুর হতে চাইব না।
রজনীকান্ত বাবু বললেন - এ তো গেল আমাদের কথা। যারা নতুন আসছেন - তাঁদের যোগদানের অপেক্ষায়।
মাগধী , বৈশালী - এরা যেন কোথাও তাদের উচ্ছ্বাসটুকু হারিয়ে ফেলেছে।
- আমাদের তো কিছু রইল না !
রজনীকান্ত বাবু বললেন - কি খুইয়েছ বল মা ! দেখবে যা হারিয়েছ তা শতরূপে বারবার ফেরত পাচ্ছ ।
রমাদি বলল - বড়দি, ছোড়দি - তোমাদের বলছি । আর পুরানো দিনের কথায় দুঃখ পেয়ো না গো । ধরে নাও তোমাদের কিছু হয়নি । সেই পনের বছর বয়সে ফিরে গেছ।
মাগধী ইঙ্গিত বুঝল ; কিন্তু বৈশালী এর অর্থ বুঝল না।
প্রশ্ন করল - পনের বছর বয়সে ফিরে গেছি মানে কি রে ?
রমাদি কিছু বলতে যাবে ; অমনি প্রভুদাস সামনে এসে বললেন - তুমি আর মা মাগধী - তোমাদের দুজনেরই গোটা জীবনটা পড়ে আছে। তোমরা ইচ্ছে করলে নতুন করে আবার শুরু করতে পার।
রহসয় বাবু এবং রজনীকান্ত বাবু বললেন - আমরা তোমাদের পাশে ছিলাম, আছি, থাকব । পুরাতন পোষাক ছেড়ে নতুন পোষাক পরতে চাইলে বাধা কোথায় ?
বৈশালীর মাথা ধরে গেল । কি সব হেঁয়ালি বলছেন এঁরা?
মাগধীর মন তখনও মাধবেই পড়ে রইল । বৈশালীকে বলল - তোর কচি বয়স । আবার বিয়ে করতেই পারিস। আমরা নতুন করে তোর আবার বিয়ে দেব ।
- ধ্যাত ! তাই হয় নাকি !
প্রভুদাস এসে বললেন - কেন হয় না মা ? রমা মা'র উপর ভরসা রাখ । ও সাক্ষাৎ শক্তির প্রতিরূপ ।
এবার বৈশালী বুঝতে পেরে লজ্জায় মুখ রাঙা করে পালিয়ে গেল ।
( ক্রমশঃ )
