ছায়ানট চতুর্বিংশ পর্ব
ছায়ানট চতুর্বিংশ পর্ব
মিঃ কে নাগার্জুন , এম এ , এল এল এম, এস জে ডি ফিলাডেলফিয়া মাদ্রাজ হাইকোর্টে সিনিয়র ল'য়ার হিসাবে কাজ করেন । তাঁর ব্যারিস্টারিতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েন খোদ বিচারকও । প্র্যাক্টিসের প্রথম দিকে এক আধবার হোঁচট খেয়েছেন ঠিকই; পরবর্তী সময়ে ভারতীয় আইন বিধি এবং পাশ্চাত্যের আদালতে ব্যবহারজীবি রূপে নিজেকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন ।
দুঃখ একটাই। তিনি সাধারণ মানুষের খুবই কম উপকারে আসেন । তাঁর দক্ষিণা দেবার সঙ্গতি সম্পন্ন লোকের আকাল । কর্পোরেট জগতের ক্লায়েন্ট ছাড়া সাধারণ কেস গ্রহন করেন না ।
অথচ আশ্চর্য্য এই রজনীকান্ত বাবুর অনুরোধ তিনি ফিরিয়ে দিতে পারেননি। কারণ তো অজানা।
রজনীকান্ত বাবু মাদ্রাজে গেলেন । হাইকোর্ট চত্বরে তাঁর সঙ্গে দেখা করতেই নাগার্জুন সাহেব বললেন - হ্যালো রজনীকান্ত ! হাউ আর ইউ ?
রজনীকান্ত বাবু নাগার্জুন সাহেবের জুনিয়র হিসাবে মাদ্রাজ শহরে ছোটখাটো কেস লড়েছেন । সকলকে জিতিয়েও দিয়েছেন । সেই সময় কথা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে যে তিনি হাই প্রোফাইল কেসগুলো নেবেন ; রজনীকান্ত তাঁকে সাহায্য করবেন ।
রমাদির বাবা তাই করেছিলেন কিন্তু শেষের দিকে বাড়ি ফিরে আসা অপরিহার্য হয়ে গেছল বলে মাদ্রাজ থেকে চলে আসেন । দীর্ঘদিন নাগার্জুনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়নি ।
তাঁর ভাগ্য সুপ্রসন্ন তাই হয়তো তিনি এতদিন পরেও তাঁকে চিনতে পেরে ডেকে নিয়েছিলেন ।
বললেন - আফটার এ লঙ্ ইন্টারভ্যাল উই মেট এগেইন।
কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রজনীকান্ত বাবু সরাসরি জানালেন তাঁর আর্জি ।
ইতস্তত করেননি মিঃ নাগার্জুন ।
বলেছিলেন - আরে রজনীকান্ত ! এতদিনের বন্ধুত্ব তোমার সাথে আর এইটুকু করতে পারব না ? তুমি হাইকোর্টে আপিল কর । আমি এটেণ্ড করব।
রজনীকান্ত বাবু বললেন - স্যার, আপনার ফিজ দেবার মত স্পর্ধা তো নেই । তবু যদি বলেন ---!
হাসলেন মিঃ নাগার্জুন ।
- এ কি বলছ রজনীকান্ত ! ফিজ নেব তোমার কাছে ? আর কেস যখন তোমারই নিকটাত্মীয়ের?
রমাদি বলল - কি বললেন তখন ?
- রাজিই হলেন না । আমিও আর পীড়াপীড়ি করিনি। কিন্তু মা ! এখানে একটা কিন্তু তো থেকেই যায় !
রমাদি চিন্তি হয়ে পড়ল ।
- কিপের কিন্তু বাবা ? উনি কি খুব বেশি চেয়েছেন ?
- কিছুই চাননি । নো ডিমাণ্ড । আর এই ' নো ডিমাণ্ড' কথাটার অর্থ মানে তো হেভি ডিমাণ্ড ।
রমাদি বলল - তাহলে ছেড়ে দাও বাবা । তুমি অন্য উকিল ধর ।
- মা রে ! এই কেস এত জটিল যে দুঁদে উকিল ছাড়া বিশেষতঃ মিঃ নাগার্জুনের মত উকিল ছাড়া লড়াই করা অসম্ভব ।
- তা' হলে কি হবে বাবা ? ওনাদের কি ফাঁসিতেই ঝুলতে হবে ?
- সেই তো ! তবে ঘাবড়াস না। আমি জেনে নেবার চেষ্টায় থাকলাম।
মিঃ নাগার্জুনকে ফোন করলেন রজনীকান্ত বাবু। তখন রাত এগারোটা হবে । ফোন তুলে অপর প্রান্ত থেকে নাগার্জুন সাহেব বললেন - হু ইউ প্লিজ ?
পরিচয় পেতেই নাগার্জুন তো ফোন ছাড়তে চান না। পুরানো দিনের গল্প জুড়ে দিলেন ।
- এখানে অসংখ্য গরীব মানুষ এখনও তোমাকে মিস করে রজনীকান্ত। কম টাকায় একমাত্র তুমিই এদের সাহায্য করতে। আর তুমি তো জানো আমি জটিল কেস ছাড়া একসেপ্ট করিনা।
- তার মানে স্যার আপনি আমার কেস নিয়েছেন মানে এটা খুব জটিল!
- ভেরি ভেরি কমপ্লিকেটেড। বাট লেট মি স্টাডি ফার্সট। দেন উইল টেল ইউ দ্য ফ্যাক্ট ।
- স্যার কোন আশা কি দেখতে পাচ্ছেন না ?
- আপাতত 'না' । তবু ছাড়ব না । লড়াই করে দেখিয়ে দিতে চাই।
- স্যার আপনার জন্য......
- ওকে। গুড নাইট রজনীকান্ত। লেট মি রিড দ্য টেক্সট এগেইন ।
ফোন কেটে দিলেন মিঃ কে নাগার্জুন ।
আসল কথাটা জানা হল না । তবে কেস যত জটিল হোক না কেন ; নাগার্জুনকে অবিশ্বাস করার মত কোন জায়গা নেই।
রমাদি বলল - কি বললেন ?
রজনীকান্ত বাবু মেয়েকে বললেন - যাতায়তের বিমান ভাড়া , থাকা খাওয়ার জন্য উচ্চমানের হোটেলের ব্যবস্থা করে দেবার কথা বললেন ।
ইচ্ছে করেই মেয়েকে মিথ্যা বললেন । এ লড়াই তারও তো ! যাতে ভেঙে না পড়ে তাই ।
রমাদি বলল - এ আর এমন কি ! আমরা মিটিয়ে দেব ।
যথাসময়ে কলকাতা হাইকোর্টে নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হল ।
এক্ষেত্রে বিবাদী পক্ষের অভিযোগকারীদেরকে দিয়ে রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আপিল করা হল । আর এই কাজ করা হল মিঃ নাগার্জুনের নির্দেশে ।
কাকভোরে রমাদি সকলকে জাগিয়ে দিল ।
- কই গো ? উঠে পড়ুন উঠে পড়ুন । ট্রেনের সময় এগিয়ে এল ।
এমন চেঁচিয়ে কথাগুলো বলল যেন বাড়িতে ডাকাত পড়েছে । সবাই জেগে গেল এবং তৈরি হয়ে নিলেন । রমাদি যেন বিশ্বজয়ে যাচ্ছে এমন ভাবে তদারকি করতে লাগল
আজ উচ্চ আদালতে আপিলের উপর শুনানি হবে। রমাদির তাই ব্যস্ততা । ঠাকুর ঘরে একে একে প্রণাম করে প্রার্থনা করলেন । তারপর সকলে চললেন কলকাতা হাইকোর্টের দিকে ।
মিঃ কে নাগার্জুন সাহেব গতকাল সন্ধ্যায় কলকাতায় পৌঁছে গেছেন । শেষবারের মত কেস স্টাডি করে একবার পুনরায় আচমন করে নিলেন।
রমাদির এটা যেন স্বপ্ন মনে হল । তার বাবা যে এত করিৎকর্মা মানুষ ভ বতে বুকটা গর্বে ভরে গেল ।
নাগার্জুন সাহেব আদালতের মেইন গেটে অপেক্ষা করছিলেন । রজনীকান্ত বাবুরা সকলেই এসে গেছেন দেখে খুবই আশ্বস্ত হলেন ।এগিয়ে গিয়ে রজনীকান্ত বাবুকে বললেন - গুড মর্নিং রজনীকান্ত! হ্যাভ আ নাইস ডে।
রজনীকান্ত বাবু প্রতি নমস্কার জানিয়ে একে একে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
- স্যার ! ইনি হলেন বিপত্তারণ চ্যাটার্জীর বড়মেয়ের শ্বশুর মশাই মিঃ রসময় ব্যানার্জী। আর ইনি হলেন ওনার ছোটমেয়ের শ্বশুর মশাই মিঃ প্রভুদাস সিদ্ধান্ত মহাশয় ।
মিঃ নাগার্জুন ' হ্যালো ' বলে স্বাগত জানালেন । তারপর একে একে সবার সঙ্গে আলাপ করে নিয়ে গেলেন আদালতে।
- ইয়োর অনার ! আজকের যে আপিলের শুনানি হতে চলেছে ; সেই অভিযোগকারীদের আমি আদালতে এনেছি নিম্ন আদালতের রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি নিয়ে ।
বিচারপতি বললেন - আমি নিম্ন আদালতের রায় পড়েছি। কোথাও কোন অসঙ্গতিপূর্ণ কথা তো দেখছি না ?
মিঃ নাগার্জুন বললেন - আপাতদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছেন না।
- তবে কি বিচারপতির কাজ করতে এসে দিব্যদৃষ্টিও লাগবে নাকি ? বিচারপতির কৌতুকপূর্ণ উক্তিতে আদালত কক্ষে হাসি খেলে গেল ।
অমনি মিঃ নাগার্জুন বললেন - এটাই চেয়েছিলাম। এই যে এতগুলো লোক কৌতুকে হেসে ফেললেন আশা করি শুনানির শেষে সকলে মিলে মন ভরে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরবেন ।
বিচারপতি বললেন - আপনি এতটা সিওর হলেন কি ভাবে ?
- স্যার, আমি কিন্তু কৌতুক করিনি । আপনি আপাতদৃষ্টিতে যা দেখতে পাচ্ছেন না ; আলোটুকু দিলাম - দেখবেন সবটা জলের মত পরিস্কার হয়ে গেছে।
বিচারপতি বললেন - মানে ? হোয়াট ডু ইউ মিন ?
মিঃ নাগার্জুন বললেন - আসামী পক্ষের কোন উকিল ছিলেন না বলে নিম্ন আদালত পুরোপুরি পুলিশ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে অনৈতিক রায় দিয়েছেন যা ৩০২ (এ) এবং ৩৫৪(৫) ধারার সঙ্গে সাযুজ্য নয় ।
বিচারপতি জানতে চাইলেন - এ কি বলছেন আপনি ?
- স্যার ! ঠিক বলছি । প্রথমত পুলিশ তদন্ত করে রিপোর্ট জমা দিয়েছে ; সেই মত চার্জশিট ইস্যু করেছে। কিন্তু আসামী দু'জন যে মানসিক বিকারগ্রস্ত সে কথা ভাবেনি । সে কথা ভাবেনি নিম্ন আদালতও ।
- মানসিক বিকারগ্রস্ত?
- ইয়েস স্যার । ডিউ টু দেয়ার মেন্টাল ইলনেস দে অ্যাট্টেড লাইক এ ক্রিমিনাল। বাট দে ওয়্যার নট ডাইরেক্টলি ইনভলভড ইন ইট ।
বিচারপতি বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন - আপনার কাছে কি প্রমাণ আছে ?
- স্যার প্রমাণ তো আপনার হাতেই আছে ।নিম্ন আদালত যে মন্তব্য করেছেন; ওই যে স্যার রায়ের খতিয়ানে লিখেছেন আসামী দু'জন এমন নিকৃষ্টতম কাজ করেছে যে মনে হয় তাঁরা মানসিক বিকারগ্রস্ত। আর এই লাইনটাই আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে যে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দান সঠিক ভাবে হয়নি । কারণ মানসিক বিকারগ্রস্তদের ডেথ সেন্টেন্স দেওয়া যায় না ।
ইয়োর অনার আমার সঙ্গে অভিযুক্তদের সাক্ষাৎ করিয়ে দেবার অনুমতি চাইছি। এ বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করতে হবে ; তাঁরা সত্যিই মানসিক কোন রোগে ভুগছেন কি না ।
- বিচারপতি বললেন - অবশ্যই অনুমতি দেওয়া হল ।
নাগার্জুন সাহেবের কথায় সকলে বিস্মিত হলেন এমনকি ভবতারণেরও মনে হল তার বাবা মা মানসিক রোগী।
( ক্রমশঃ )
