Sourya Chatterjee

Comedy Classics Fantasy

4.8  

Sourya Chatterjee

Comedy Classics Fantasy

বউ কথা কও

বউ কথা কও

5 mins
320


খুব মুশকিলে পড়েছি , বুঝলেন। এমনিতে করোনা পরিস্থিতি, লকডাউনের ফলে মন মেজাজ ভালো নেই, তার উপর যা গরম পড়েছে কি বলবো! এমন অবস্থায় বউ হঠাৎ কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে কোনো এক অজ্ঞাত কারণবসত। কাল অবধি ঠিকঠাক কথা বলল, আজ সকাল থেকে কোনো কথা নেই। আটটা নাগাদ চা নিয়ে এসে আমায় ডাকে ও সাধারণত। কিন্তু আজ ঘুম থেকে উঠে চোখ খুলে দেখি ন’টা বেজে গেছে। আমি তো ভয় পেয়ে গেছি প্রথমটায়। রান্নাঘরে গিয়ে দেখি সে দিব্বি পরোটা বেলছে। দুবার জিজ্ঞেস করলাম “কিগো, আজ চা দিলে না?” কোনো উত্তর নেই। ঘরে এসে দেখি আমার টেবিলের উপর চায়ের কাপ, বিস্কুট সব রাখা। চায়ের প্লেটের তলায় চাপা দেওয়া একটা চিরকুট। তাতে লেখা “চা রেখে গেলাম। ঠান্ডা হয়ে গেলে মাইক্রোওয়েভে গরম করে খেয়ে নিও।” ভালো মতোই বুঝলাম যে আজ সারাদিন ঘরের ভেতরে একটা সাইক্লোন চলবে, যেটা কিনা আমায় প্রতিনিয়ত সামলে চলতে হবে।


আজ কী ওর জন্মদিন বা আমাদের বিবাহবার্ষিকী! উমম, মনে তো হয় না। তাও একবার নিশ্চিত হয়ে নেওয়া ভালো। কাউকে বলবেন না যেন, আমার ল্যাপটপে একটা পাসওয়ার্ড প্রটেক্টেড ডকুমেন্টে আমি সব গুরুত্বপূর্ণ তারিখ সেভ করে রেখেছি। ডকুমেন্টটা খুললাম, কিছু যদি মিস যায়, দেখে নেওয়াই ভালো। বউয়ের জন্মদিন জুন মাসের সতেরো তারিখ, বিবাহবার্ষিকী অগস্টের তিরিশ, প্রথম হাত ধরা ফেব্রুয়ারির তেরো তারিখ, প্রথম কফি ডেট নভেম্বরে, প্রথম চুম্বন মার্চে, ইত্যাদি ইত্যাদি। নাহ, আরো এরম পনেরো কুড়িটা তারিখ আছে ডকুমেন্টটায়, কিন্তু কোনোটাই আজকের তারিখ নয়। তবে এই গুমোট আবহাওয়া এবং সাইক্লোনের কারণ কি!! আরো তদন্ত করতে হবে। নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ফেলু মিত্তিরকে বার করে আনা এই মুহূর্তে একান্ত কাম্য।


খিদে পাচ্ছে। দশটা বাজতে চললো। খাবার ঠাবার দেবে না নাকি? আজ তো উনি ডাকবেন না, কিন্তু কোথাও চিরকুটও দেখতে পাচ্ছি না তো। একবার গিয়ে দেখেই আসি ব্রেকফাস্ট বানানো হয়েছে কিনা। অফিসের একটা কল আসতে পারে, ফোনটা নিয়েই যাই। এ কি!! কান্ড দেখুন!! বউ মিনিট কুড়ি আগে হোয়াটস্যাপ করেছে “ব্রেকফাস্ট রেডি। খেতে এস”। আবার মিনিট পাঁচেক আগে লিখেছে “পরোটা ঠান্ডা হয়ে গেল!” বুঝুন তো কি হাল! কোথায় যে যাই!!

এই গুমোট পরিবেশে ফেলু মিত্তির হওয়া কি অত সহজ কাজ মশাই! নৈব নৈব চ। তবুও কারণ তো খুঁজতেই হবে। পরোটা আর আলুর চোখাটা কিন্ত আজ খাসা বানিয়েছে বউ। যদি বাজার করতে গিয়ে কোনো জিনিস আনতে ভুলে যেতাম তবে তো রাগটা খাবারের উপরও পড়তো। তাই না? কিন্তু খাবারের উপর রাগটা পড়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তাও সাবধানের মার নেই। গতকালের ফর্দটা দেখে একবার মিলিয়ে নেই বাবা! সব ঠিকঠাক এনেছি কিনা। একবার ফর্দতে লেখা ছিল পিপার, ভুল করে পেপার ভেবে খবরের কাগজ নিয়ে চলে এসেছিলাম। বাপরে বাপ! তারপর আমার ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। নাহ, কাল তো সব ঠিকঠাক-ই এনেছি। তবে আর কি কারণ হতে পারে বলুন তো! মাথায় কিছু আসছে না। যাক গে, “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” চলছে। কাজ করতেও বসতে হবে। অগত্যা তদন্তের কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ রেখে বসলাম অফিসের কাজ করতে।


মাইক্রোসফট এক্সেলে কিছু ডেটা ভরছিলাম। অফিসের কাজে কাজের কাজ যা না থাকে, তার থেকে এই ডেটা এন্ট্রি, ডেটা ডিলিট, হেনা তেনা এইসব কাজই বেশি থাকে। তবুও সেসব কাজও মনোযোগ সহকারেই করতে হয়। ছোটবেলা ইস্কুলে যেরকম ঘন্টা পড়ত, হঠাৎ করে সেরকম ঘন্টার আওয়াজ কানের সামনে। চমকে উঠলাম। আমাদের বাড়ির আশেপাশে তো কোনো স্কুল নেই। যদি থেকেও থাকে তবে তা তো এখন বন্ধ। তবে এমন শব্দর কারণ কি! ও, বাবা! দেখি আমার গিন্নি চামচ নিয়ে আমার দুপুরের ভাতের থালায় ঢং ঢং করে ঘন্টার আওয়াজ করছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলাম দুপুরের খাবার খাওয়ার সময়ের জানান দেবার জন্যই ওই ঘন্টা।


খেতে বসে হঠাৎ একটা বিষম খেলাম। কথায় বলে বিষম খাওয়ার মানে ‘কেউ হয়তো মনে করছে’। বউ যদি আবার সেটা সত্যি ভাবে তবে তো কেলেঙ্কারির এক শেষ। না, মনে হয় ভাবেনি সেসব। বিদ্যুতবেগে আমার দিকে জলের গ্লাস এগিয়ে দিল। আমি একটু খুশিই হলাম গোটা দিনে প্রথমবার। আমার বিষম খাওয়ায় বউয়ের চোখে মুখে চিন্তার চাপ আসলে তো ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। গদগদ হয়ে বললাম “থ্যাংক ইউ”। তারপর, আবার যে কে সেই। কোনো উত্তর এলো না। খেয়েদেয়ে উঠে আবার যখন অফিসের কাজে বসতে যাচ্ছি, ওমা! দেখি হোয়াটস্যাপে বউয়ের ম্যাসেজ “ওয়েলকাম। এত তাড়াহুড়ো করে খাও কেন? শোনো, যখন লাঞ্চে আসবে হাতে দশটা মিনিট বেশি সময় নিয়ে আসবে”। কি জানি, কি মনে হলো – রিপ্লাই দিলাম “আচ্ছা, কাল থেকে তাই করব”।


সবই তো হচ্ছে, সন্ধেবেলার চা-টাও তো ও চায়ের কাপের টুংটুং আওয়াজ করতে করতে আমার কাছে দিয়ে গেল এসে। কিন্তু কোনো বাক্যালাপ নেই। কোনো প্রতিবেশীর সাথে ঝামেলা ঠামেলা হলে এরকম কথা বলা বন্ধ করে দেয় মাঝে মধ্যে। একবার জিজ্ঞেস করে দেখব! কিন্তু এই মুহূর্তে তা তো বিড়ালের গলায় ঘন্টা পরানোর মতো ব্যাপার। তাও অনেকটা সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “বলছি, কারোর সাথে কোনো ঝামেলা হয়েছে নাকি!” কোনো উত্তর তো দিলই না, উল্টে এমনভাবে তাকালো আমার দিকে কটমট করে, ভাবটা যেন “আমার সাথে ঝামেলা করবে এমন লোক পৃথিবীতে জন্মেছে নাকি!”


চব্বিশ ঘন্টা পেরোতে যায়, কিছু আঁচই করতে পারছি না। এই ভেতরকার ফেলু মিত্তির, বের হ এবার। মাথা চুলকেই চলেছি, কিন্তু কিছুই আসছে না মাথায়। একটু সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে ঘাটাঘাটি করি রাতে, আজ আর ইচ্ছে করল না। শুয়ে পড়ি বরং আজ। মশারি টাঙানোর দায়িত্বটা আমার-ই। সুন্দরভাবে সেই দায়িত্ব পালন করে পড়লাম শুয়ে। রাত্রিবেলা পাশে শোয়ার পর বউ যদি কথা বলে, সেই আশায় আশায় একটু তো ছটফট করছিই। কথায় আছে না আশায় মরে চাষা। সেরম ব্যাপার আর কি!


ঘুম আসছে না। দুটো বাজল, তিনটে বাজল। ভেবেই চলেছি কি করা যায়। যাকে নিয়ে ভাবছি সে কিন্তু আমার পাশে শুয়ে দিব্যি ঘুমাচ্ছে। তখন রাত চারটে মত হবে, বুঝলেন। বউ ঘুম থেকে ধড়মড় করে উঠে বসল। ঘড়িটা দেখে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলল “কিগো, ঘুমাচ্ছো না কেন?”। চিমটি কেটে দেখে নিলাম - না, না স্বপ্ন তো নয়, সত্যিই আমার সাথে কথা বলছে। বিস্ময়ে আমি হতবাক। বউ একটু আড়মোড়া ভেঙে বলল

- একটু জল দাও। আর শোনো, আজ সারাদিন খুব পরিশ্রম হয়েছে। কাল রেস্ট নেব। আমার সব কাজকর্মগুলো মানে রান্নাবান্না, একটু ঝাড়পোছ এগুলো একটু সামলে নিও কাল।

আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম

- একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

- ঢং না করে তাড়াতাড়ি বল। ঘুম পাচ্ছে।

- বলছি, আজ সারাদিন কিসে পরিশ্রম হল গো তোমার! মানে রোজ যা কর..

বউ আমার কথাকে থামিয়ে দিয়ে বলল

- আহা, মরণ! কিছুই জানোনা, বোঝোনা দেখছি। বউয়ের প্রতি কোনো খেয়ালই নেই। আজ যে সারাদিন কথা বলিনি সে খেয়ালও নেই। কি বর জুটলো যে কপালে!

- হ্যাঁ, সেটাই তো,মানে..

- কি সেটাই তো সেটাই তো বলে তোতলাচ্ছ! বগলাচরণ বাবার নির্দেশে কাল ভোর চারটে থেকে আজ ভোর চারটে অবধি মৌনব্রত পালন করেছি সংসারের কল্যাণের জন্য। কথা না বলে থাকাটা কত পরিশ্রমের তুমি বুঝবে কি করে! কাল কিন্তু পাক্কা সকাল আটটায় আমার বেড টি চাই। আমি ঘুমালাম।


একটা “বউ কথা কও” পাখি ডাকতে শুরু করেছে ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে। আজ আর আমার ঘুম হলো না বোধহয়।



Rate this content
Log in