বিসর্জন
বিসর্জন
প্রতিবারের মত এবারও মা এসেছেন, সারা রাজ্য মেতে উঠেছে উৎসবের আনন্দে। আকাশে বাতাসে খুশীর আবহাওয়া ছড়িয়ে পড়েছে। রাস্তা ঘাট সব সেজে উঠেছে উৎসবের সজ্জায়। ঊর্মি দেবী ফোনটা হাতে নিয়ে উদাস হয়ে বসে ছিলেন বারান্দায়। পুরনো দিনের স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছিলেন,মনে পড়ছিল- সমুদ্র , জুঁই ওদের কথা।সেই সব সময়গুলো ছিল খুব মজার,তখন কত ছোট ছিল ওরা ...
মা, এবার কিন্তু আমাকে পুজোতে একটা পুলিশের ড্রেস কিনে দেবে, আর একটা বন্দুক। দশ রিল ক্যাপ চাই আমার। রোজ রোদে দেবো, দেখবে কেমন ফাটে।
রান্নাঘরে নাড়ু বানানোর জন্য নারকেলে পাক দিতে দিতে ঊর্মি বলেন -
সমুর চাহিদা তো শুনলাম এবার তোর কি চাই জুঁই?
আমার একটা গোলাপি রঙের পরীদের ড্রেস। গোলাপি হেয়ারব্যান্ডও চাই, তিনটে ফুল লাগানো।
এই সময়ে হঠাৎ আবির্ভাব ঊর্মিদেবীর কর্তা প্রিয়ব্রত বাবুর, 'তা তোমার কি চাই জয়া?' বাজারের ব্যাগটা রান্না ঘরের এক কোণে নামিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলেন প্রিয়ব্রত বাবু।
'আরে, আরে তোমার কি কোনো দিন বুদ্ধি হবে না!
একশো দিন বলেছি, বাজার করে ব্যাগ রান্না ঘরে ঢোকাবে না! চেঁচিয়ে ওঠেন ঊর্মিদেবী ।
দেখলি সমু , দেখলি জুঁই তোদের মা কেমন সারাক্ষন আমায় বকতে থাকে। তোদের সাথে সাথে আমারও নিস্তার নেই তোদের মায়ের কাছ থেকে।
তারপর সবাই মিলে পুজোতে ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে ছিলেন সেবার। পুজোতে ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে ছবিও তোলা হয়েছিল স্টুডিওতে। একটা ছবিতে পুলিশের ড্রেস পরে সমুদ্র আর পরীর মতো সাজে জুঁই । আর একটা ছবিতে ঊর্মি, প্রিয়ব্রতর সাথে সমুদ্র , জুঁই । একটি সুখী পরিবারের ফ্যামিলি ফটো।
নিজের মোবাইল ফোন গ্যালারিতে ছবিগুলো দেখতে দেখতে চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে ষাটোর্ধ্ব ঊর্মির। অ্যালবাম থেকে ফোনে ছবি তুলে রেখেছিলেন ঊর্মি।
হঠাৎ পিছন থেকে প্রিয়ব্রত বাবুর গলার আওয়াজ পেলেন। 'ঊর্মি এভাবে বসে থেকে কি লাভ বলতো? ওরা সবাই ভালো আছে এটাই আমাদের শান্তি।আমাদের যে একসাথে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে এটাই তো এই বয়সে আমাদের পরম পাওনা। মা দুর্গার আশীর্বাদে ওরা সারাজীবন সুখে থাক। পুজোতে বাড়িতে ওদের কত বন্ধু বান্ধব আসে, আমরা ওখানে বেমানান। এখানে তো ভালোই আছি আমরা। ধীরে ধীরে কথাগুলো বলে চলেন প্রিয়ব্রত বাবু।
এরপর ঊর্মিদেবীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে প্রিয়ব্রত বাবু বললেন,' চলো আজ আমরা দুজনে মিলে একটু ঘুরে আসি। আজ তো দশমী। মনে আছে তোমার, আগে পুজোর চারদিনই বেরোতে হতো ওদের আবদারে। কত বছর হয়ে গেল...। কথাগুলো কানে যেতেই কাপড়ের আঁচলটা চেপে ধরেন চোখে ঊর্মিদেবী।
ঊর্মি, ও ঊর্মি... বলি কি আজ সকালেই চলো বেরোই। এদিক সেদিক একটু ঘুরে দুপুরে বাইরেই খেয়ে নেবো কিছু। এবার যে লাল পাড়ের সাদা তাঁতের শাড়িটা কিনে দিলাম সেটা পরো।
কখন যে মা আসেন, কখন যে তাঁর ফেরার সময় এসে যায় কিছুই বুঝতে পারেন না এই দুই বৃদ্ধ দম্পতি। ছেলে মেয়েকে বড় করা, ওদের চাকরি, ওদের বিয়ে দিতেই কখন যে এত্তগুলো বছর পেরিয়ে গেছে, নিজেদের দিকে ফিরে তাকানোর সময়ও পাননি তাঁরা।
একটা রিকশা নিয়ে চারটে প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখে, একটা সস্তার হোটেলে স্ত্রীকে নিয়ে ঢোকেন প্রিয়ব্রত বাবু।
হোটেলে ঢুকে দুজনে বসার পরে প্রিয়ব্রত বাবু হোটেলের কাজের ছেলেটিকে ডাকলেন।
বাবা, এদিকে এসো তো- মোচার ঘন্ট, দুটো সর্ষে ইলিশ আর এক প্লেট পাঁঠার মাংস দিও। হোটেলের ছেলেটিকে খাবারের অর্ডার দিয়ে মুচকি হাসেন প্রিয়ব্রত বাবু।
একটা কথা বলবো তোমাকে? তোমার বেশ কয়েকটা দাঁত পড়ে গেছে কিন্তু তোমার হাসিটা এখনো একই রকম আছে জানো।
ঊর্মির কথায় একটু চমকে গিয়ে হা হা করে হেসে ওঠেন প্রিয়ব্রত। 'তুমি আমার হাসি লক্ষ্য করেছো কোনোদিন, এটা তো জানতাম না! তা এই লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার অভ্যেসটা কবে থেকে হয়েছিল শুনি?'
'তুমি না একটা যা তা ! লোকলজ্জার মাথা খেয়ে বসে আছ,এত লোকের মধ্যে কি যে বলো না! লজ্জা পেয়ে যায় ঊর্মি।
এই ঊর্মি... তোমার লজ্জাটাও তো এখনো একই রকম রয়েছে। মনে আছে যেদিন তোমায় দেখতে গেছিলাম সেদিনও ঠিক এই রকমই লজ্জা লজ্জা মুখ করে বসে ছিলে। আর ফুলশয্যার দিন...
বাবু, আপনাদের খাবার.. খাবার নিয়ে আসা
হোটেল বয়ের কথায় চুপ করে যান প্রিয়ব্রত বাবু।
আরাম করে খাওয়া দাওয়া শেষ করে, ধীরে ধীরে বিকেলের দিকে গঙ্গার ধারে এসে বসেন দুজন। ভাসান দেখবেন বলে। একে একে মায়ের ভাসান চলতে থাকে।
ঊর্মি তুমি একটু বসো আমি আসছি, বলে মিনিট দশেক পরেই ফিরে আসেন প্রিয়ব্রত।
'পেছন ফেরো দেখি, আহ, বলছি একটু পেছন ফেরো।' কিছুটা কাঁপা কাঁপা হাতেই একটা জুঁই ফুলের মালা জড়িয়ে দেয় ঊর্মির খোঁপায়।
'সাদা চুলে সাদা মালাটায় কিন্তু বেশ লাগছে তোমায় জয়া। বুড়ি হয়ে গিয়ে এখন যেন একটু বেশি সুন্দরী হয়ে গেছো।' নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ওঠেন প্রিয়ব্রত বাবু। এই রসিকতায় অপ্রস্তুত ঊর্মিদেবী লজ্জা পেয়ে যান। 'বুঝলাম, বুড়ো বয়সে প্রেমটা তোমার একটু বেশি বেড়েছে! তা আর কিছু বাকি আছে নাকি!' কপট রাগ দেখান ঊর্মিদেবী।
পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিঁদুরের কৌটো বার করে ঊর্মির সিঁথি রাঙিয়ে দিয়ে দুগালে বুলিয়ে দেন সিঁদুর।
শুভ বিজয়া ঊর্মি...
ঊর্মি দেবী স্বামীর পায়ে প্রণাম করে বলেন-
এই সিঁদুর মাথায় নিয়েই যেন আমি শেষ যাত্রায় যেতে পারি গো।
একে একে দেবীর ভাসান হয়ে চলেছে গঙ্গার বুকে... সূর্য তখন পশ্চিম আকাশ রাঙিয়ে ম্লান মুখে বিদায় বেলায়।
আর সমস্বরে চিৎকার ভেসে আসছে-
" বলো দুর্গা মাই কি... জয়...
আসছে বছর... আবার হবে..."
এই পরিবেশে দাঁড়িয়ে দুজনেই দুজনকে যেন নূতন ভাবে ফিরে পেলেন। মায়ের যেমন বিসর্জন হয় না, হয় বিশেষ ভাবে অর্জন - আজ ঊর্মিদেবী ও প্রিয়ব্রত বাবুও খুঁজে পেলেন যে ওদের ভালোবাসার বিসর্জন হয় নি, আজ তাদের ভালোবাসাকে তারা বিশেষ ভাবে আবার অর্জন করলেন।
