বিসর্জন
বিসর্জন


মনা প্রতিবার পুজোর সময় রায়বাড়িতে কাজ করে। ঐ পাঁচটা দিন তো অনেক মানুষজন আসে, কাজও প্রচুর থাকে - - তাই বাড়তি কাজের মেয়ে লাগেই। মনার তাই এ-কাজ বছর বছর বাঁধা ধরা। সারা বছর অন্যান্য যেসব বাড়িতে ঠিকে কাজ করে, তারা অনেকেই পুজোর সময় থাকে না - বেড়াতে যায়। তাই রায়বাড়িতে কাজ করতে কোনো অসুবিধাও হয় না। কিছু টাকাও মেলে, আবার মা - মেয়ের চারটি ভালো-মন্দ খাবারও জোটে।
এবারেও সেই মতোই চলছিল সব। ঠাকুর বরণের পর বিসর্জন যাত্রা। মনার মেয়ে গৌরী জেদ করে যাবার জন্য। মনার যদিও ইচ্ছা ছিল না যাওয়ার, ঐ ক'দিন এত কাজ করে। কিন্তু মেয়েটা তো কখনও কিছু চায় না, আজ যখন জেদ করছে - - এটুকু নাহয় হাঁটবে কষ্ট করে। আট বছরের বাচ্চা তো সারা পুজো একা একা ছিল রায়বাড়ির এক কোণে, আজ নাহয় সবার সাথে একটু আনন্দ করুক। বারবার পড়ছে মনা, শোভাযাত্রার ভিড় থেকে।
ঘাটে পৌঁছে বাঁধানো সিঁড়িতে বসে পড়ে মনা, বুক ধড়পড় করছে। একটু না জিরোলে আর পারছে না। কিন্তু গৌরীকে চোখে পড়ছে না। ভিড়ের মধ্যে আছে নিশ্চয়ই।
ততক্ষণে দেবীকে জলে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। গঙ্গার জলে ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। রায়বাড়ির প্রথা অনুযায়ী দেবী যা কিছু সোনা বা রূপার গয়না পান, সবসহই বিসর্জন দেওয়া হয়। সেই সংগ্রহের জন্যই এত হুড়োহুড়ি চলে।
পর মুহূর্তেই বুকটা কেঁপে ওঠে ভয়ে। গৌরী কি এইজন্যই আজ আসতে জেদ করলো। বেশ কিছুদিন যাবৎ শরীরটা ভালো যাচ্ছে না মনার, গ্রামের ডাক্তার শহরে দেখাতে বলেছিল। পয়সার টানাটানিতে সে আর হয়ে ওঠে নি। তবে কি সেই জন্যই গৌরী......
মনা দৌড়ে যায় নদীর ধারে, চিৎকার করে গৌরীর নাম ধরে ডাকতে থাকে। ঢাকের আওয়াজ, মানুষের কোলাহলে হারিয়ে যায় সে আর্তি।
পরের দিন পাশের ঘাটে ভেসে ওঠে গৌরীর মৃতদেহ - - কচি হাতের মুঠোয় তখনও শক্ত করে ধরা সোনার টিকলি।