Sankha sathi Paul

Romance Classics Inspirational

4  

Sankha sathi Paul

Romance Classics Inspirational

পুনরাবৃত্তি

পুনরাবৃত্তি

4 mins
701



সকালের বাজার সেরে ফিরেও অংশু দেখল বাড়ি চুপচাপ। অন্যান্য দিন বনানীর পুজোর আওয়াজ ভেসে আসে ঠাকুর ঘর থেকে। গতকাল রাত থেকে বনানীর হাঁপানির টানটা ভীষণ বেড়েছে। শীতকাল মানেই প্রায় দিন এই কষ্ট ভোগ করতে হবে বনানীকে এখন। আজ দুপুরে পাপান বাড়ি আসবে, পুরো পাঁচ বছর পর, ইউ এস এ থেকে।পি এইচ ডি করতে যাওয়ার পর থেকে আর আসে নি। ওখানেই জব পেয়েছিল ,অংশু ভেবেছিলেন আর বোধহয় কোনোদিনই দেশে ফিরবে না পাকাপাকিভাবে তাদের ছেলে। কিন্তু ক'দিন আগে হঠাৎই পাপান জানালো সে দেশে ফিরছে, তাও আবার পার্মানেন্টলি। আনন্দে মেতে উঠেছিল বুড়ো বুড়ি। পাপানের ঘর পরিষ্কার, নানান টুকিটাকি কাজ করতে গিয়েই নাজেহাল হয়ে গেছে বনানী।

দু' কাপ লিকার চা করে নিয়ে গিয়ে বনানীকে ডাকলো অংশু। বনানীর রুগ্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে বড্ড ভয় হয় মাঝে মাঝে - কে জানে অংশুকে একা করে আগেই চলে যাবে কিনা! পাপানের জন্মের সময় বনানীর যমে মানুষে টানাটানি দশা - তারপর থেকেই কিছুটা রুগ্ন বনানী। প্রথমে এক মেয়ে হয়ে মারা গেছিল দেড় মাস বয়সে। পাপান বহু কষ্টের সন্তান বনানীর। পাপানকে ঘিরেই বনানীর বেঁচে থাকা ছিল একসময়। সেই পাপান যখন বিদেশে চলে গেল তখনই বনানী ভেতর থেকে ফোঁপড়া হয়ে গেছে - যদিও স্বীকার করবে না কিছুতেই। বড় অভিমানী মেয়ে বনানী, জেদিও বটে।

*******

পাপানের আসার পর থেকে বাড়িটা আনন্দে ঝলমল করছিল। তখন ঘুণাক্ষেরও বোঝে নি এই কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে। সমস্ত বাড়ি আজ অন্ধকার - পাপান বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেছে, বনানীর সাথে চূড়ান্ত অশান্তি করে। বারান্দায় বসে আছে অংশু আর বনানী। কার্তিকের ঠান্ডা বাতাস ভারী হয়ে আছে বনানীর কান্নার শব্দে। বনানীর কান্নার সাথে মিশে অংশুর মনে কড়া নাড়ছে পঞ্চাশ বছর আগের অংশুর মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ। সেদিন বি. এ পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছিল। কলেজ থেকে রেজাল্ট নিয়ে ফিরেই দেখেছিল বাবা অরুণকে প্রচন্ড মারছেন, মা কাঁদছে, ঠাকুমা বাবাকে আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছিল না।খুড়তুতো বোন অংশুর কানে কানে বলেছিল, বাবা নাকি চিলেকোঠার ঘরে অরুণকে মানসদার সাথে অসভ্যতামি করতে দেখে ফেলেছে। গল্পটা বুঝতে অসুবিধা হয় নি অংশুর। অরুণ তো সব বলত অংশু-তাহলে এত বড় একটা কথা কেন বলল না? আর কই অংশুও তো কিছু বুঝতে পারে নি! হ্যাঁ, মানসদার সাথে ওর ভাব একটু বেশি ছিল বরাবরই কিন্তু তারমধ্যে অস্বাভাবিকত্বের কিচ্ছুটি বুঝতে পারে নি অংশু। তারপর অরুণ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিল সেদিন - বাবাও বেরিয়ে গেছিলেন, শুধু যাওয়ার আগে তাদের প্রত্যেককে সাবধান করে দিয়েছিলেন - কেউ যদি অরুণকে বাড়িতে ঢুকতে দেয় তবে বাবার মরা মুখ দেখবে। নাহ, কেউ ঢুকতে দেয় নি অরুণকে। বাবা নিজেই অরুণকে সাথে নিয়ে এসেছিল। কামরূপ এক্সপ্রেসে ছিন্ন ভিন্ন, পলিথিন দিয়ে মোড়ানো রক্ত মাখা কয়েক টুকরো মাংস খন্ড হয়ে ফিরেছিল অরুণ। বাবা বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছিল সেই ঘটনার পর থেকে। আর অংশু মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ শুনতে শুনতে নিজের হাতে, নিজের যমজ ভাই অরুণকে পুড়িয়ে গঙ্গার জলে শুদ্ধ হয়ে এসেছিল। কিছুদিনের মধ্যেই ঠাকুমা মারা গেছিল। বাবাকে অ্যাসাইলেমে দিতে হয়েছিল।সেই সময়ই এই চাকরিটা পেয়ে মাকে নিয়ে সব ছেড়ে চলে এসেছিল কলকাতায়। সময়ের সাথে সাথে শোকের ছায়া সরে নতুন করে জীবন শুরু করেছিল মাকে নিয়ে - শুধু অঙ্কে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট অরুণ মুখোপাধ্যায় হারিয়ে গেছিল সমকামিতার অপরাধে। মা কোথাও অরুণের কোনো স্মৃতি রাখতে দেয় নি, কোনও ফটো নয় - এমনকি কাউকেই জানতে দেয় নি জীবনের এই কলঙ্কিত অধ্যায়।


অংশু কখনও দুঃস্বপ্নেও ভাবে নি, সেই একই ঘটনা আবার ফিরে আসবে তার জীবনে। পাপান, তাদের একমাত্র ছেলে সমকামী - এক ছেলেকে নিয়ে থাকতে চাইছে সারাজীবন। কি করবে এখন অংশু!! অংশু খুব ভালো করেই জানে বনানী যতই রাগ দেখাক, কান্নাকাটি করুক - আদপে সে সব কিছু মেনে নিতে পারে পাপানের মুখ চেয়ে । অংশুর অসহায় লাগছে। বুক চাপ লাগছে, দম আটকে আসছে। সমস্ত দৃষ্টি ফিরে ফিরে আসছে জুড়ে অরুণের সেই রক্ত ছিন্ন ভিন্ন মৃতদেহ। নাআআআআআআআআআআআ.......

******

অংশু এখন ভালো আছেন। আজ বিকেলে নার্সিংহোম থেকে রিলিজ করে দেবে। সেদিন একটা ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হাওয়ায় বেশ ক'দিন থাকতে হল এই নার্সিংহোমে। প্রথম দুদিন তো নাকি জ্ঞানই ছিল না তার। অবশ্য একদিকে ভালোই হয়েছে। আর কোনও দোলাচল নেই এখন মনের মধ্যে। বনানী আর পাপানকে অরুণের ঘটনাটা শেয়ার করেছেন - মেনে নিয়েছেন ছেলের সিদ্ধান্তকে। হ্যাঁ সমকামিতা আইনস্বীকৃত হলেও সমাজ হয়ত এত সহজে মেনে নেবে না। তবে একদিন এই সমাজের ভয়ে নিজের যমজ ভাই , নিজের অর্ধেক সত্ত্বাকে অকালে হারিয়েছেন, এমন আদর্শবান বাবাকে অ্যাসাইলেমে পচে মরতে দেখেছেন, মাকে পাষাণ প্রতিমা হয়ে বাঁচতে দেখে নিজে গুমরে মরেছেন। আজ আর কিছুতেই সেই ভুল করবেন না। সমাজের বিরুদ্ধে হাতে হাত রেখে নিজেদের স্বর্গ নিজেরাই গড়বেন এবার। এরমধ্যে সৃজনকে একদিন নার্সিংহোমে এনে আলাপ করিয়ে দিয়েছে পাপান - ছেলে বেশ ভালো, বড্ড মায়াময়। সৃজন আর কিছুদিন পর থেকে তাদের সাথে থাকবে। মনকে বুঝিয়ে নিয়েছেন অংশু - ভালো থাক দুটিতে, আর কিছু চাওয়ার নেই তার।

নার্সিংহোম থেকে ফিরে বাড়ি ঢুকেই থমকে গেল অংশু - মা বাবার ফটোর মাঝখানে অরুণকে ফটো - টাটকা রজনীগন্ধার মালা পরে মিটিমিটি হাসছে তার দিকে চেয়ে। পাপান হাতটা ধরে আলতো চাপ দিল, অংশুও আঁকড়ে ধরল ভরসার স্পর্শ। বুকের বাঁ-দিকের চিনচিনে সুখ ছড়িয়ে পড়েছে রক্তে, সারা সত্ত্বায়।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance