ওহি
ওহি
ওহি-কে যখন বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম তখন বাবলুর বয়স মোটে চারবছর। ইনফ্যাক্ট, বাবলুর জন্যই ওহি-কে আনতে বাধ্য হয়েছিলাম আমি। চুমকি মারা যাওয়ার পর বাবলুকে কিছুতেই একা হাতে সামলাতে পারতাম না। এত দুরন্ত, তার ওপর মায়ের অভাবে ছেলেটা আমার দিন দিন অবাধ্য, জেদি, একগুঁয়ে হয়ে উঠেছিল। তখনই ওহি-কে নিয়ে এসেছিলাম রোবোটিক্স জেড কোম্পানি থেকে। ওহি-কে পেয়ে বাবলু ওর মায়ের অভাব ভুলে গিয়েছিল। আসলে আমার অর্ডার পেয়ে কোম্পানি ওহি-কে ওভাবেই প্রোগ্রামিং করেছিল।
আজ বারো বছর ওহি এবাড়িতেই আছে। আমি তো এখন সংসারের কিছুই দেখি না। ওহি ঠিক চুমকির মতো করে সব সামলে রাখে ।বাবলুকেও সন্তানস্নেহে মানুষ করেছে।
কিন্তু এখন সমস্যা হচ্ছে বাবলুকে নিয়ে। বাবলু এখন ষোল বছরের। ২০৯০ সালে দাঁড়িয়ে ষোল বছরের মানুষকে আর বাচ্চা বলা চলে না। এখন সবাই পনের বছর হলেই পড়াশোনার সাথে সাথে কাজকর্ম করে স্বনির্ভর হয়ে ওঠে। সেটা অবশ্য খুবই ভালো। কিন্তু এখন বাবলুর আর ওহি-কে পছন্দ হচ্ছে না - - বরং ওকে অপ্রয়োজনীয় বলেই মনে হচ্ছে।
প্রথম প্রথম নিজের অপছন্দটা আকারে ইঙ্গিতে আমাকে বোঝাতে চেয়েছিল। আমি বুঝেও না বোঝার ভান করেছিলাম। আসলে আমার ওহি-কে কখনও অপ্রয়োজনীয় বলে মনেই হয় না। বরং ওকে আমার পরিবারের একজন বলেই মনে হয়েছে বরাবর।
কারণে বাবলুর সাথে চরম অশান্তি হয়েছে। বাবলু পরিষ্কার বলেছে, ও চায় না ওহি আর এই পরিবারে থাকুক। এমনকি এও বলেছে, ও নাকি একটা নতুন রোবোট অর্ডার দিয়েছে - - যা সাতদিনের মধ্যে বাড়িতে ইনস্টল করে দেবে। আর আমাকে তার আগেই ওহি-কে বিদায় করতে হবে। কারণ ভারত সরকার এখনও এক পরিবারে একাধিক রোবট রাখা অ্যালাও করে নি।
কিন্তু ওহি-কে আমি কোথায় ফেলব!
আজ সারাদিন এদিক-ওদিক ঘুরেছি। কেউ আর অত পুরনো মডেলের রোবট নিতে আগ্রহী নয়। এমনকি ম্যানুফ্যাকচরার-রাও আর ঐ মডেল তৈরি করে না। তাই কোনো রিপ্লেসমেন্ট-ও সম্ভব নয়।
"কেনো এতো চিন্তা করছ! খেয়ে নাও", ওহি-র ডাকে সম্বিৎ ফিরল।
বাড়ি ফিরে বসে ছিলাম চুপ করে। ওহি কিন্তু ঠিক সময় মত খাবার নিয়ে।
একে আমি কোথায় ফেলে আসব!!
"আমি জানি, বাবলু আর চায় না আর আমাকে। তাতে ভুল কিছু নেই। আমার তো কাজ শেষ - - যেতে তো হবেই।" , নির্বিকার ভাবে বলে গেল ওহি।
বিকেলেও বেরিয়েছিলাম একটু - - - ঐ ওহি-কে কোথায় রাখা যায়, সেই খোঁজেই।
বাড়িতে ফিরে দেখি লোকে লোকারণ্য, দাউ দাউ করে জ্বলছে আমার বাড়ি। বাবলু......
বাবলু কোথায়....!!!
চিৎকার করে উঠি....
লোকজনের এতক্ষণে খেয়াল হয় আমাকে।
"বাবলুকে উদ্ধার করা গেছে।আঘাত সামান্যই।" কেউ একজন বলে।
আর ওহি....?!
ওহি-কে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে যায় নি। এগিয়ে যায় বাবলুকে বাঁচাতেও। ওহি-ই নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বাবলুকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে পারে নি।
বাঁচাতে পারে নি, নাকি বাঁচতে চায় নি!!
কে জানে।
ওহি-কে যখন তৈরি করা হয়, তখন ওটাই রোবোটিক্স জেড কোম্পানির সবথেকে এফিসিয়েন্ট রোবট ছিল। ওর মধ্যে হিউম্যান ইমোশনস্ ইনস্টল করা ছিল। আমি এই ফিচার পছন্দ করেছিলাম বাবলুর জন্যই। মায়ের মতো হয়ে উঠতে ওহি খুব কম সময় নিয়েছিল।
সেই ইমোশনের জন্যই ওহি নিশ্চিতভাবেই বাবলুর ব্যবহারে দুঃখ পেয়েছিল। কেন জানি না, আমার খালি মনে হচ্ছে - - ওহি ইচ্ছা করেই নিজেকে বাঁচায় নি আগুনের হাত থেকে।
ওহি-র দলাপাকানো মেটালিক বডিটা দেখে আমার ভীষণ কান্না পেল - - - ঠিক চুমকিকে হারানোর মতই অদ্ভুত এক কষ্ট, অসহায়তা গ্রাস করল আমায়।
এরপর বেশ কিছু বছর কেটে গেছে। বাবলুর অর্ডার করা নতুন রোবট ম্যাকাও আরও বেশি দ্রুত ও নীর্ভুলভাবে যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে। বাবলুর বিয়েও হয়েছে বছর দুয়েক হল, নিজেই পছন্দ করেছে মেয়ে। আমার অবশ্য কিছুতেই কোন আপত্তি করতে ইচ্ছা করে না আর। বাবলুর সাথেও একটা মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে ওহি-র চলে যাওয়ার পর।
গাড়ির আওয়াজে এগিয়ে গেলাম দরজা অবধি। যতই হোক আজ আমার বাবলুর সন্তান ঘরে আসছে - - আজ আর দূরে থাকা যায় না।
ইসস, কি মিষ্টি পুতুলের মত দেখতে হয়েছে। ছোট্ট ছোট্ট হাত পা নেড়ে খিলখিলিয়ে হাসছে বৌমার কোলে ।
আমার কোলে মেয়েকে তুলে দিয়ে বাবলু বলল - - "ওহি"...
চমকে উঠে তাকাই। বাবলু আর বৌমার মুখে সম্মতির হাসি।
ছোট্ট ওহি ততক্ষণে আমার কড়ে আঙুল জড়িয়ে ধরেছে ওর পুচকে হাতে।
অনেক আদরে গালে গাল ছোঁয়াই---চোখের জল আজ আর বাঁধ মানে না।