বাবা
বাবা
বুবলুর জন্য আজ একটু চিকেন নিয়ে গেলে হত। মাসের শেষ হতে চলল প্রায়, হাতে সামান্য ক'টা টাকা পড়ে আছে। কি করবে দোনোমনো করছে অসিত। নাহ, তিনশো মত চিকেন নিলেই হবে - - কাল পরশু নাহয় অফিসে টিফিন না নিলেই ম্যানেজ হয়ে যাবে খানিকটা। ছেলেটার জন্য বড্ড কষ্ট হয়, কত ছটফটে দুরন্ত ছিল - - আর এখন সারাদিন ওই হুইলচেয়ারে বসেই কাটাতে হয়। একদম চুপচাপ থাকে --সবকিছু থেকে কেমন উদাসীন হয়ে গেছে। এই বয়সে এমন একটা আঘাত সহ্য করা, সহজ তো নয়। অসিত কখনও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। এখন আর নিজের কাছেই সব ব্যাখ্যাহীন লাগে। সেদিন কি অসিতই একটু বেশি জোরে চালিয়েছিল বাইকটা, স্পিড কম থাকলেও কি স্কিড করতো ওভাবেই?! কে জানে! এখন সেদিনের কথা ভাবলে আর কিছুই মনে করতে পারে না, শুধু চোখের সামনে ভাসে রক্ত আর রক্ত, কানে আসে বুবলুর আর্তনাদ।
"দাদা আপনার মুরগি...."
টাকাটা দিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরে অসিত। বাড়ি ফিরতে ভালো লাগে না আজকাল। মীরা কেমন অদ্ভুত ব্যবহার করে ওর সাথে। অসিত রাস্তায় বাইকসহ পড়ে সামান্য চোট পেয়েছিল, কিন্তু বুবলু ছিটকে পড়েছিল ডানদিকে। আর বাসটা.........
বুবলুর দুটো পা-ই বাদ গেছে হাঁটুর নীচে থেকে। মীরা বোধহয় বিশ্বাস করতে পারে না আর অসিতকে।
মীরাকে অসিত ভালোবেসে বিয়ে করেছিল, বুবলুর তখন বছর দুয়েক বয়স। ওর জন্মের আগেই ওর বাবা মারা যান। অসিত কিন্তু বুবলুকে কখনও নিজের সন্তান ছাড়া আর কিছু মনে করে নি, বুবলুর সব স্বপ্ন পূরণ করাই ওর লক্ষ্য ছিল। এই ফুটবল কোচিং এ ভর্তি করেছিল বুবলুকে, সে তো কষ্ট করেই। তবুও করেছিল। ছেলেটার ফুটবল খেলায় ন্যাক ছিল। অথচ মীরা এখন ভাবে, অসিত বোধহয় সেদিন ইচ্ছা করেই বুবলুকে....।
উফফ, কেনো যে সেদিন..... কোনোদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না অসিত।
বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বসল বুবলুর কাছেই। এক কাপ চা নামিয়ে দিয়ে গেছে মীরা। ছেলেটা ছবি আঁকছে একমনে।
"বুবলুর স্কুলে একবার কথা বলতে হবে--পরীক্ষা দিতে দেবে কি এবছর?", বুবলুকে খাওয়াতে খাওয়াতে কথা ক'টা ছুঁড়ে দিল মীরা অসিতের উদ্দেশ্যে।
"পারবে এবছর?"
"হ্যাঁ, পারব বাবা।"--বুবলুই উত্তর দিল এবার।
পরের দিনই স্কুলে গিয়ে হেডস্যারের সাথে দেখা করেছিল অসিত। ওরা বুবলুকে পরীক্ষা দিতে দেবে বলেছে।
মীরা বুবলুকে পরীক্ষা দেওয়াতে নিয়ে গেছে স্কুলে। অসিতের শরীরটা ভালো নেই একদম। বাড়িতেই আছে। বুবলুর ফুটবল, স্পোর্টস সু সব পড়ে আছে ঘরের একপাশে। অসিতের কান্না পেয়ে যায় দেখে। তখনই বেলটা বাজলো। কিছুটা বিরক্ত হয়েই দরজা খুলতে গেল অসিত।
"আরে বিপুল। কতদিন পর। আয় আয়।"
খানিক গল্পগুজব করে চলে গেছে বিপুল। কে জানে, সত্যি কি যা বলল, তা হবে?! কে জানে।
বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে। এর মাঝে বিপুলকে দুবার ফোনও করেছিল। সেরকম কোনো ভালো খবর দিতে পারে নি। অসিত আশা ছেড়ে দিয়েছে এখন।
সেদিন ফোনটা এল, সত্যি চমকে গেছিল অসিত। নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না।
অনেক কষ্টে মীরাকে রাজি করাতে পেরেছে। মীরা তো বাড়ি থেকেই বেরোয় না আজকাল - - তাও আবার অসিতের সাথে।
অডিটোরিয়ামে বুবলুর নাম ঘোষণা করতেই চমকে গেছে মীরা আর বুবলু। অসিত ওদের কাউকেই বলে নি, সারপ্রাইজ দেবে বলে। সেদিন বিপুল এমনিই এসেছিল অসিতের কাছে। বুবলুর অ্যাক্সিডেন্টের কথা জেনেছিল তখনই। কথায় কথায় টেবিল থেকে তুলে নিয়েছিল বুবলর আঁকা কয়েকটা ছবি, আর সেসব ছবি মুগ্ধ করেছিল ওকে। ওই তখন প্রস্তাব দিয়েছিল অসিতকে-কয়েকটা ছবি নিয়ে এসেছিল, কি যেন এক কম্পিটিশনে দেবে বলে।
সেই ছবি প্রথম স্থান অধিকার করেছে।
বুবলুকে স্টেজে নিয়ে গেছে বিপুল। ও পুরস্কার নিচ্ছে। অডিটোরিয়াম ভরে উঠেছে হাততালিতে। অন্ধকারেও অসিতের চোখের জল নজর এড়ায় নি মীরার। মীরা শক্ত করে চেপে ধরেছে অসিতের হাত--অনেক অনেক দিন পর।।