সিনেমার মতো
সিনেমার মতো
(১)
লিজা জীবনে কখনও এভাবে অপমানিত হয় নি ।এখনও কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে ।ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে ।দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে গলার কাছে দলা পাকানো কান্নাটা আটকানোর বৃথা চেষ্টা করে চলেছে ।গরম ফোঁটা ফোঁটা জল চোখ থেকে ঝরে পড়ছে স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে ।ফোনটা সমানে ভাইব্রেট হচ্ছে ।স্ক্রিনে ফুটে উঠেছে শুভর ফটোটা.. সাথে লেখা.. শুভ ইজ কলিং....
ফোনটা ছুড়ে ফেলে মেঝেতে ।ভেঙে যায় টুকরো টুকরো হয়ে ।নরম বিছানায় আছড়ে পড়ে লিজা ।কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠেছে লিজার শরীরটা ।
(২)
ভোর বেলা ডোরবেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল লিজার ।দরজায় ডাকছে কেউ ।এক রাশ বিরক্তি নিয়ে অনিচ্ছুক শরীরটাকে টেনে নিয়ে গেল লিজা দরজার কাছে ।দরজা খুলতেই চমকে ওঠে লিজা ।শুভ দাঁড়িয়ে সামনে ।মনে হল দরজাটা মুখের উপর বন্ধ করে দিতে ।কিন্তু শুভর চেহারা দেখে পারলো না - একদম ঝড়ো কাক লাগছে শুভকে ।
শুভকে বেডরুমে নিয়ে গিয়ে বসালো ।এই প্রথম তার ফ্ল্যাটের বেডরুমে কোনো পুরুষকে এন্ট্রি দিল লিজা ।
(৩)
তিন মাস আগে কানাডা থেকে কলকাতা এসেছিল লিজা প্রথম বার মা-বাবাকে ছেড়ে ইউনিটের সঙ্গে - ডকুমেন্টরি ফিল্ম করার জন্য ।জন্মের পর থেকেই কানাডায় মানুষ লিজা ।কিন্তু মা বাংলা ভাষা শিখিয়েছে লিজাকে ।মা - বাবা দু'জনই কলকাতার মানুষ ।কলকাতার প্রতি তাদের টানও লিজাকে কলকাতায় আসতে উৎসাহিত করেছিল।কিন্তু শুভকে এভাবে ভালোবেসে ফেলবে - দুঃস্বপ্নেও ভাবে নি লিজা।কি আছে শুভর?! ভালো ছবি আঁকে , একটা অনাথ আশ্রম চালায় শুভ - সেই সূত্রেই আলাপ ।যথেষ্ট বড় লিজার থেকে ।লিজা তো দুমদাম আঙ্কেল আন্টি বলে না কাউকেই - তাই শুভকেও নাম ধরেই ডেকেছে বরাবর ।তিন মাসে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে, কিন্তু কখনোই মাত্রারিক্ত আবেগ দেখায় নি শুভ ।কিন্তু সেদিন শুভর ঘরে ঢুকে লিজা ক্যানভাসে নিজের ছবিটা দেখে ভেবেছিল শুভও বোধহয় লিজাকে ভালোবাসে ।সেই সাহসেই কানাডা ফিরে যাওয়ার আগে গতকাল শুভকে নিজের ভালোবাসার কথা জানাতে গিয়েছিল ।কিন্তু শুভ তাকে অপমান করে ফিরিয়ে দিয়েছে, আর আজ ভোরবেলা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে ।কফি বানাতে বানাতে নিজের মনে এইসব ভাবছিল লিজা ।কিন্তু কোনো ব্যাখ্যা সে পাচ্ছে না ।অগত্যা কফি দুটো নিয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ায় লিজা ।
(৪)
-লিজা, আয়্যাম সরি..
-কেন শুভ?
-আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই নি ।
-বেশ তো, তাহলে বলো.. ভালোবাসো আমায়..
-না...... অসম্ভব ।
-কেন অসম্ভব শুভ???
-কারণ.. তুমি... তুমি....
-কি আমি... বলো...
-না পারবো না....
-পারতে তোমাকে হবেই শুভ..
-কেন ছেলেমানুষী করছো লিজা, কেন কালো অতীতকে টেনে আনতে চাইছো ?!
-বিকজ আই লাভ ইউ শুভ
-জাস্ট স্টপ ইট ননসেন্স... তোমার কালচার হয়ত বুঝবে না.. মানবে না.. কিন্তু লিজা তুমি আমার আত্মজা ।আত্মজা মানে বোঝো তুমি??? আই অ্যায়াম ইয়োর বায়োলজিকাল ফাদার..
-হোয়াট.....?!!
-হ্যাঁ লিজা, তুমি অবিকল তোমার মায়ের মত দেখতে ।পরে তোমার থেকে তোমার মা - বাবার পরিচয় জেনেছি, তোমার জন্মসাল.. কোনো ভুল নেই.... তুমি আমারই সন্তান ।আমিই তোমার দায়িত্ব এড়ানো বাবা ।
(৫)
শুভ চলে গেছে অনেক ক্ষণ ।ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ এখন ঠান্ডা জল ।আজ বিকেলের ফ্লাইটে কানাডা ফিরে যাচ্ছে লিজা ।একটা ঘটনা তাকে অনেক ম্যাচিওর করে দিল - যার জন্য সে আদপেও প্রস্তুত ছিল না ।বরাবর সিনেমার জন্য গল্প খুঁজেছে জীবন থেকে, আজ জীবনটাই সিনেমার মত লাগছে ।তিন মাসের স্মৃতি তিন ঘণ্টার সিনেমার মতো করেই ভুলে যাবে লিজা ।জানে, কানাডায় তার জন্য তার সত্যি বাবা তার জন্য অপেক্ষা করে আছে, থাকবে চিরদিন ।