Bhattacharya Tuli Indrani

Tragedy

0  

Bhattacharya Tuli Indrani

Tragedy

বিসর্জন

বিসর্জন

3 mins
563


আধিপত্য


 'এবারে এই কুকারটাকে বিসর্জন দাও মা, ২৭-২৮ বছর হল… ' নীতা একটু বিরক্তির সঙ্গেই বলল।

বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে এসেছে সে, প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেল… বিয়েতে পাওয়া প্রেশার কুকারটা বার করা হয়েছিল, বছর তিনেক বাদে। সেই থেকে বিনা বিশ্রামে সার্ভিস দিয়ে চলেছে সে।

'কেন, কুকারটা তোমার কোন্ পাকা ধানে মই দিল শুনি, ভালই তো চলছে অসুবিধা কোথায়?' অত্যধিক অধিকার প্রবণতায় ভোগা শাশুড়ি মা খেঁকিয়ে উঠলেন।

বয়েস হয়েছে, নানারকম রোগে ভোগেন কিন্তু তাঁর বাতিকের ঠেলা সামলাতে নীতার প্রাণ যাওয়ার যোগাড়।

বাড়ি ফিরেই অভ্যর্থনার প্রথম বাক্য শুনতে হয়, 'সারা বাড়ি কিচ কিচ করছে বালিতে, পা দেওয়া যাচ্ছে না... প্রথম প্রথম, সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়ু নিয়ে ঝাঁট দিয়ে দিত নীতা, আজকাল আর পাত্তাই দেয় না। রান্নাঘরের অধিকার তিনি কিছুতেই ছাড়বেন না, যদিও রান্নার যোগাড়ের খুঁটিনাটি সবই হাতের কাছে গুছিয়ে দিতে হয় নীতাকেই। খুন্তি কিন্তু ওঁকে নাড়তেই হবে।

অনেক বলে, বুঝিয়ে এখন কদিন হলো বিশ্রাম দিতে পেরেছে নীতা, তার শাশুড়ি- মা'কে।

'আজ খিচুড়ি করে ফেলছি মা, কী ভাজা খাবে সঙ্গে?'

কালো হয়ে আসা আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘোষণা করে নীতা।

আজকাল কানে কম শুনছেন নলিনী দেবী। টিভি সিরিয়ালের জালে জড়িয়ে আছে মনটা… উত্তর পেল না নীতা।

'অনেকদিন ছোলার ডাল হয়নি, নীতা… আজ কোর তো। তোমার ছোলার ডালটা ভালই হয়।শাশুড়ি- মায়ের স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টাতে নীতার ঠোঁটের কোণা দুটো একটু বেঁকে গেল।

ছোলার ডাল বার করে ভিজিয়ে দিয়ে, দোতলায় গেল নীতা বিছানাপত্র ঠিকঠাক করতে। বড় মেয়ে বেরিয়ে গেছে তার অফিসে, ছোট কলেজে। এসব করার সময় বা ইচ্ছে কোনটাই নেই তাদের। নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ল নীতার, মা'র কঠোর শাসনে গড়ে দেওয়া। ঘুম থেকে উঠে বিছানা পরিষ্কার না করে ঘর থেকে বেরনোর সাহস ছিল না।

মাজা কুকারটা বাসনের তাক থেকে বার করে, ছোলার ডাল চড়িয়ে দিল নীতা। কয়েকটা আলুও ফেলে দিল সঙ্গে, সেদ্ধ হয়ে থাক… কাজে দেবে।বাড়িটা পুরনো হয়েছে। মেঝেগুলো একেবারেই খারাপ হয়ে গিয়েছিল… বাড়ির ছেলে চাকরির পাট চুকিয়ে ফিরেছে মাস দুয়েক… বাড়ির ভোল বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে এসেছে নতুন রেফ্রিজারেটর, চিমনি, গ্যাস বার্নার আর এয়ারকন্ডিশনার।

বাড়ি ছাড়া ছিল বহুদিন, খুব মন দিয়েই কাজগুলো করিয়েছে অতুল।

আরে, কতক্ষণ হয়ে গেল, কুকারে সিটি পড়ল না তো, ঢাকাটা ঠিকঠাক লেগেছে তো? চঞ্চল হলো নীতা।

রান্নাঘরে ঢোকার ঠিক আগেই প্রচণ্ড আওয়াজে কেঁপে উঠল সারা বাড়ি।

নীতার চোখের সামনেই প্রেশারকুকারটা উড়ে গেল... চিমনিতে ধাক্কা খেয়ে, নীচে নেমে এসে ধড়াম করে পড়ল জ্বলন্ত বার্নারের ওপরে।

কুকারের সঙ্গে সঙ্গেই নীচে নেমে এল ভাঙা চিমনির টুকরো... ছড়িয়ে পড়ল রান্নাঘরের সদ্য সারানো মার্বল ফ্লোরে।

বাড়িতে নব্বই বছরের শ্বশুরমশাই, তিরাশির শাশুড়ি- মা… কী কী হতে পারে এর পরে, তাড়াতাড়ি ভেবে নিল, নীতার কম্পিউটার মন।

গ্যাস সিলিন্ডারটা এক্ষুণি বন্ধ করতে না পারলে আগুন লেগে যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা।

গ্যাস বার্নারের দিকে তাকাল নীতা, দুমড়ে মুচড়ে তার যে কী অবস্থা সে আর বলার নয়, নিজে নিজেই নিভে গেছে আগুন… ভাগ্যিস।

সারা রান্নাঘর ডাল আর আলুসেদ্ধতে মাখামাখি…

চিমনি, বার্নার, কুকার, রান্নাঘর… সবকিছুর দিকে তাকিয়ে চোখে জল এল নীতার। কোত্থেকে শুরু করবে, বুঝে উঠতেই পারল না।

খাবার জল নিতে রান্নাঘরে আসছিলেন নলিনী দেবী। 

বাইরে নীতার স্থানু অবস্থায়, তাঁর নজর গেল রান্নাঘরের ভেতরে…

২৭ বছরের পুরনো প্রেশারকুকারের মোহে বিসর্জন হয়ে গেল ঝকঝকে নতুন চিমনি আর গ্যাস বার্নারেরও...

প্রেশারকুকারের সঙ্গে সঙ্গেই।       


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy