বিদ্যাসাগর- এক অনন্য জীবন (শারদ সংখ্যা)
বিদ্যাসাগর- এক অনন্য জীবন (শারদ সংখ্যা)
"বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে করুণার সিন্ধু
তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে দীনের বন্ধু।"
এই বিখ্যাত কবিতার স্রষ্টা হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। এই কবিতা আজ থেকে দ্বিশতবর্ষ আগে মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করা সিংহপুরুষের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। সেই সিংহপুরুষই হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইংল্যান্ডে যখন আর্থিক কষ্টে ভোগেন তখন বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁর সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন। এইভাবে যেন মধুসূদন দত্তের পুনর্জন্ম দেন। 1820 সালের 26শে সেপ্টেম্বর বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল দিন। এই দিনে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবির্ভাবে সমগ্র বাংলা এক নতুন আলোর সন্ধান পেল। ছোটবেলা থেকে তাঁর জীবন অতি কষ্টে কেটেছে। কিন্তু লক্ষ্যে অবিচল বিদ্যাসাগর কখনো জীবন যুদ্ধে পরাজিত হননি। ছোট্ট বিদ্যাসাগর তাঁর পিতা গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সাথে কলকাতায় আসেন। বীরসিংহ গ্রাম থেকে কলকাতায় আসার এই পথ তাঁর কাছে এক শিক্ষার তীর্থযাত্রা হয়ে ওঠে। আসার পথে রাস্তায় মাইলস্টোন দেখে ইংরেজি অক্ষর শিখে নেন। এ এক অভিনব শিক্ষাদান পদ্ধতি। এরপর তিনি 1829 সালের 1লা জুন কলকাতা গভর্নমেন্ট সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। এরপর তিনি ব্যাকরণের পাশাপাশি ইংরেজি, অলঙ্কারশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে পড়াশোনা করে বিশেষ জ্ঞানার্জন করেন। তিনি বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। 1839 সালের 22শে এপ্রিল হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। 16ই মে ল কমিটির কাছ থেকে তিনি একটি প্রশংসাপত্র লাভ করেন। যাতে তাঁর নামের সাথে প্রথম 'বিদ্যাসাগর' উপাধিটি ব্যবহৃত হয়। নিম্নে প্রশংসাপত্রটি দেওয়া হল-
HINDOO LAW COMMITTEE OF EXAMINATION
We hereby certify that at an Examination held at the Presidency of Fort William on the 22nd Twenty-second April 1839 by the committee appointed under the provisions of Regulation XI 1826 Issur Chandra Vidyasagar was found and declared to be qualified by his eminent knowledge of the Hindoo Law to hold the office of Hindoo Law officer in any of the Established courts of Judicature.
H.T Prinsep
President
J.W.J Ousely
Member of the Committee of Examination
This certificate has been granted to the the said Issur Chandra Vidyasagar under the seal of the committee. This 16th Sixteenth day of May in the year 1839 corresponding with the 3rd Third Joistha 1761 Shukavda.
J.C.C Sutherland
Secy to the Committee.
এছাড়া 1841খ্রী: ডিসেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজ থেকেও তিনি একটি প্রশংসাপত্র লাভ করেন। সেখানেও কলেজের অধ্যাপকগণ ঈশ্বরচন্দ্রকে 'বিদ্যাসাগর' নামে অভিহিত করেন। নিম্নে প্রশংসাপত্রটি দেওয়া হল-
"অস্মাভি: শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরায়
প্রশংসাপত্রং দিয়তে। অসৌ কলকাতায়াং
শ্রীযুত কোম্পানি সংস্থাপিত বিদ্যামন্দিরে ১২
দ্বাদশ বৎসরান্ ৫
পঞ্চমাসাংশ্চোপস্থায়াধোলিখিত শাস্ত্রাণ্য
ধীতবান্
ব্যাকরণম্....শ্রীগঙ্গাধর শর্ম্মভি:
কাম্যশাস্ত্রম্....শ্রীজয়গোপাল শর্ম্মভি:
অলঙ্কারশাস্ত্রম্....শ্রীপ্রেমচন্দ্র শর্ম্মভি:
বেদান্তশাস্ত্রম্.... শ্রীশম্ভুচন্দ্র শর্ম্মভি:
ন্যায়শাস্ত্রম্.... শ্রীজয়নারায়ণ শর্ম্মভি:
জ্যোতি:শাস্ত্রম্... শ্রীযোগধ্যান শর্ম্মভি:
ধর্মশাস্ত্রম্.... শ্রীশম্ভুচন্দ্র শর্ম্মভি:
সুশীলতয়োপস্থিতস্বৈত স্বৈতেষু শাস্ত্রেষু সমীচীনা ব্যুৎপত্তিরজনিষ্ট।
১৭৬৩ এতচ্ছকাব্দীয় সৌরমার্গশীর্ষস্য বিংশতি দিবসীয়ম্
Rasamoy Dutt. Secretary.
10Decr 1841
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তৎকালীণ সমাজে বহু পন্ডিত ব্যক্তিকে 'বিদ্যাসাগর' উপাধিতে ভূষিত করা হতো। কিন্তু বিদ্যাসাগর বললেই আমাদের মানসপটে কেবল ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামই ভেসে ওঠে। এর কারণ হলো সমাজের প্রতি তাঁর অবদান।
আসুন তাঁর জীবনের অবদানগুলি আমরা পর্যালোচনা করে দেখি।ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর 1851 সালের 22শে জানুয়ারি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এইসময় সংস্কৃত কলেজে বহু সংস্কার সাধন করেন। 1851 সালের 9ই জুলাই থেকে পূর্বতন রীতি বদলে ব্রাহ্মণ বৈদ্যের সাথে কায়স্থদের সংস্কৃত কলেজে অধ্যায়নের সুযোগ করে দেন। তিনি বুঝেছিলেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে জ্ঞানের বিকাশ ঘটলে তবেই বাংলা তথা ভারতবর্ষ এগোতে পারবে। তিনি 26শে জুলাই রবিবারের সাপ্তাহিক ছুটি প্রথার ঘোষণা করেন। আগে সংস্কৃত কলেজে প্রতি অষ্টমী ও প্রতিপদ তিথিতে ছুটি দেওয়া হতো। এরপর ডিসেম্বর মাসে তিনি সকল বর্ণের মানুষের জন্য সংস্কৃত কলেজের দ্বার উন্মুক্ত করেন এবং কলেজে প্রবেশার্থী শিক্ষার্থীদের 2 টাকা দক্ষিণা প্রথা চালু করেন। বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করেছিলেন তৎকালীন অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজকে আলোর দিকে উত্তীর্ণ করতে গেলে মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ আবশ্যক। তিনি অনুভব করেন ইংরেজি ভাষা না জানলে ব্রিটিশ শাসনের কুফল ও সুফল কোনটাই মানুষ বুঝতে পারবে না। তাই বিদ্যাসাগর মহাশয় সংস্কৃত কলেজে মাতৃ ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাকে আবশ্যিক করেন। এর পাশাপাশি তিনি ইংরেজি গণিতকে পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করান। বিদ্যাসাগর মহাশয় চেয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় দর্শনেই পরিদর্শী হতে পারে। তার জন্য তিনি ভারতীয় দর্শনের পাশাপাশি মিলের তর্কশাস্ত্রকেও পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করেন। এ বিষয়ে আমরা বেনারস সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ড. ব্যালেন্টাইন ও বিদ্যাসাগর মহাশয় এর অসাধারণ বাক্যালাপ উল্লেখ করতে পারি। 1853 সালে কলকাতায় এসে ড. ব্যালেন্টাইন বলেন যে- দুই ধরনের দর্শন পাঠ করলে ছাত্রদের বিভ্রান্তি দেখা দেবে এবং তাদের ধারণা হবে যে সত্য দু রকমের। কিন্তু 1853 সালের 7 ই সেপ্টেম্বর বিদ্যাসাগর তার বক্তব্যের উত্তরে বলেন- সত্য যে হিন্দু দর্শন পদ্ধতি সাম্প্রতিক পাশ্চাত্য দর্শনের অগ্রবর্তী ধারণা গুলির সঙ্গে একেবারেই মেলে না। কিন্তু একজন ভালো সংস্কৃত পন্ডিতের হিন্দু দর্শন জানা জরুরী। তিনি যদি একই সঙ্গে আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের পাণ্ডিত্য অর্জন করেন তবে তাঁর পক্ষে প্রাচীন হিন্দু দর্শনের ভুলভ্রান্তি গুলি ধরা অনেক সহজ হবে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, বিদ্যাসাগর মহাশয় বলেননি হিন্দু দর্শন খারাপ আর পাশ্চাত্য দর্শন ভালো। তিনি শুধুমাত্র বাস্তব চিত্রটি তুলে ধরেছেন। আপাতদৃষ্টিতে অনেক সময় মনে হতে পারে বিদ্যাসাগর ভারতীয়ত্ববাদী ছিলেন না। কিন্তু তা সম্পূর্ণ ভুল। তাঁর জীবন ও কথায় ভারতীয় আদর্শই ধ্বনিত হয়েছে। বিদ্যাসাগর শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য প্রচুর বই রচনা করেন। তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হল, সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা, ব্যাকরণ কৌমুদী, বর্ণপরিচয়, কথামালা, নীতিবোধ, চরিতাবলী ও বোধোদয়। তিনি প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন হিন্দি বেতাল পচ্চিসী অবলম্বনে রচিত বেতাল পঞ্চবিংশতি। এতে প্রথম যতি চিহ্নের সফল ব্যবহার করেন তিনি। মেকলে মিনিট এর কুপ্রভাবে দেশজ শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। এই বাস্তব চরিত্র তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। এমনকি 1854 সালে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর এফ. জে. হ্যালিডে তাঁর প্রতিবেদনে বলেছিলেন, শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তক- এর অভাব দেশীয় ভাষা শিক্ষার যথেষ্ট অবনতি ঘটিয়েছে। সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক হিসেবে বিদ্যাসাগর নদীয়া, বর্ধমান, হুগলি ও মেদিনীপুর জেলায় 5টি মডেল স্কুল তৈরি করেন। 1855 সালের জুলাই মাসে তিনি সংস্কৃত কলেজের প্রাঙ্গণে একটি 'নর্ম্যাল' স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, অক্ষয়কুমার দত্ত ও মধুসূদন বাচস্পতিকে এই স্কুলের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেন। বিদ্যাসাগর তৎকালীন সময় থেকে কতখানি এগিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন তাঁর লেখা চিঠি দেখলে বোঝা যাবে। 1859 সালের 29শে সেপ্টেম্বর বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর জে.পি. গ্রান্টকে তিনি চিঠিতে লেখেন যে, এরকম একটি ধারণা এদেশে এবং ইংল্যান্ডে গড়ে তোলা হয়েছে যে, সরকার উচ্চশ্রেণীর মানুষের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য অনেক কিছুই করেছে এবং এখন জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার করা দরকার। কিন্তুু বাস্তব পরিস্থিতি তা নয়। উচ্চ শ্রেণীর মানুষকে শিক্ষিত করার জন্য সরকারের আগে একটি সুপরিকল্পিত কর্মসূচি নেওয়া উচিত। তিনি যথার্থই বলেছেন। কারণ, তৎকালীন সময়ে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের ব্যয় ভার অত্যধিক হওয়ায় উচ্চশ্রেণীর মানুষেরা তা গ্রহণ করতে সক্ষম হলেও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন উচ্চ শ্রেণীর মানুষেরা সঠিকভাবে শিক্ষা গ্রহণ করে সর্বসাধারণের জন্য তারাই শিক্ষা বিস্তারে এগিয়ে আসুক। তখন ব্রিটিশ সরকার অপরিকল্পিতভাবে শিক্ষা বিস্তার করছিল। যার দরুন সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। অশোক সেন তাঁর Vidyasagar and his illusive Milestones গ্রন্থে মন্তব্য করেন- বিদ্যাসাগরের শিক্ষা বিস্তারের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষার সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়া এবং বাংলার ছোট শহর ও গ্রাম গুলির নিম্নবিত্ত ভদ্রশ্রেণীর মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানো।
বিদ্যাসাগর মহাশয় নারীদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন। তিনি বর্তমানকালের তথাকথিত নারীবাদীদের মতো মেকি নারী স্বাধীনতার কথা বলেননি। তিনি প্রকৃত নারী স্বাধীনতার জন্য কাজ করে গেছেন। নারী স্বাধীনতার প্রথম অঙ্গ হিসেবে বেছে নেন নারী শিক্ষার বিস্তারকে। 1849 সালের 7 ই মে শিক্ষা কাউন্সিলের তদানীন্তন সভাপতি জে. ই. ডি. বেথুনের উদ্যোগে 21 জন ছাত্রী নিয়ে হিন্দু নারী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পশ্চাতে বিদ্যাসাগর সর্বতোভাবে সাহায্য করেন। বিদ্যালয় পরিদর্শক থাকাকালীন বিদ্যাসাগর 1857-1858 খ্রী: নাগাদ বর্ধমান, নদীয়া ও হুগলি জেলায় নিজের খরচে 35 টি মেয়েদের স্কুল তৈরি করেন। এই স্কুলগুলিতে 13000 ছাত্রী পড়াশোনা করতেন। তৎকালীন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই উদ্যোগ যথেষ্ট সাহসী ও প্রশংসাসূচক ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিস্তর লেখালেখির পর এই স্কুলগুলি খুলতে যে ব্যয় হয়েছিল সেই ভার বহন করতে সরকার স্বীকৃত হয়, কিন্তু একই সঙ্গে জানিয়ে দেয় যে এই স্কুল গুলির জন্য কোনো নিয়মিত অনুদান সরকার পাঠাবে না। এরপর তিনি বীরসিংহ গ্রামে 1890 সালে ভগবতী বিদ্যালয় স্থাপন করেন। নারী শিক্ষার বিস্তারে তাঁর অবদানকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না।
তৎকালীন সমাজ গোঁড়ামোয় নিমজ্জিত ছিল। ভারতীয় সমাজকে বিভিন্ন কুপ্রথা গ্রাস করেছিল। প্রাচীনকাল থেকে ভারতের নারী স্বাধীনতার যে উচ্চ ঐতিহ্য ছিল তা তৎকালীন সময়ে বিলোপ সাধন ঘটে। নারী স্বাধীনতার দ্বিতীয় অঙ্গ হিসেবে বেছে নেন বিধবা বিবাহ প্রচলন। এর জন্য 1853 সালে বিধবা বিবাহের সমর্থনে প্রবন্ধ লেখেন এবং তিনি যুক্তি দিয়ে দেখান যে বিধবা বিবাহ হিন্দুশাস্ত্র সম্মত। এর জন্য তিনি পাশ্চাত্যের কোন আইন বা গ্রন্থের অবলম্বন করেননি। তিনি ডুব দিলেন ভারতীয় ঐতিহ্য তথা হিন্দু ঐতিহ্যের সুমহান গ্রন্থের সমুদ্রে। 'পরাশর সংহিতা' থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়ে দিলেন বিধবা বিবাহ হিন্দুশাস্ত্র সম্মত। উদ্ধৃতিটি হলো- "নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে, ক্লীবে চ পতিতে পতৌ" অর্থাৎ স্বামী নিখোঁজ হলে বা তার মৃত্যু হলে, নপুংসক আর পতিত হলে তার স্ত্রী আবার বিয়ে করতে পারেন। এবার সমালোচকেরা প্রশ্ন করতে পারেন তিনি কেন ভারতীয় গ্রন্থ অবলম্বন করলেন? কেন তিনি পাশ্চাত্যমুখী হলেন না? কারণ তিনি জানতেন ভারতীয় শাস্ত্র ও ধর্মই হলো সবকিছু সমাধানের উৎস। ভারতবর্ষের প্রাচীনকালের নারী স্বাধীনতার ঐতিহ্যই তা প্রমাণ করে। আর তৎকালীণ গোঁড়া সমাজ তাঁর এই পদক্ষেপে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। বহু গোঁড়া ব্রাহ্মণরা মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন। বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন হিন্দুশাস্ত্র থেকে যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করলে মানুষ তা দ্রুত গ্রহণ করবেন এবং বিভ্রান্তও হবেন না। 1855 সালের 4 ঠা অক্টোবর বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের সমর্থনে এক হাজার সই সংগ্রহ করেন এবং সরকারের কাছে বিধবা বিবাহ আইন সম্মত করার দাবিতে একটি আবেদনপত্র পেশ করেন। 1856 সালের 16 ই জুলাই কোম্পানির সরকার বিধবা বিবাহ সমর্থনে আইন পাস করেন। ওই বছরের 7 ই ডিসেম্বর কলকাতায় বিদ্যাসাগরের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রথম বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। এই বিবাহ যাতে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয় তার জন্য তিনি প্রচুর কুলীন ব্রাহ্মণকে আমন্ত্রণ জানান। আর সফল করতে 10 হাজার টাকা খরচ করেন। 1856-1867 সাল পর্যন্ত তিনি মোট 60 টি বিধবা বিবাহের আয়োজন করেন এবং এই উপলক্ষে তিনি 82 হাজার টাকা খরচ করেন। তিনি বিধবা বিবাহের জন্য অকৃত্রিমভাবে খরচ করতে থাকেন। এর ফলে তিনি ঋণগ্রস্তও হয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি তাঁর লক্ষ্যে অবিচল থাকেন। সমালোচকরা আবারও বলতে পারেন যে, বিধবা বিবাহ কতটা সফল হয়েছিল? আদৌ সফল হয়েছিল? এর উত্তর অনুসন্ধানের জন্য আমাদেরকে তৎকালীণ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে। তাহলে বোঝা যাবে তিনি তৎকালীণ সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে এক দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন এনেছিলেন।
বিদ্যাসাগর এরপর বহু বিবাহ রোধ করার জন্য সোচ্চার হোন। এই প্রথা সমাজে শক্তিস্বরূপা নারী জাতির কল্যাণের পরিপন্থী। তাই তিনি এর জন্য একটি সামাজিক আইন চেয়েছিলেন। তিনি 'বহু বিবাহ' নামে একটি ইস্তাহার প্রকাশ করেন এবং পরিসংখ্যান দিয়ে দেখান যে, 1865-1871 সালের মধ্যে 120 জন কুলীন ব্রাহ্মণ বহুবিবাহে লিপ্ত হয়েছিলেন। তিনি প্রাচীন শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখালেন বহুবিবাহ শাস্ত্রসম্মত নয়। এরপর তিনি সমাজের আর একটি ব্যাধি বাল্যবিবাহ রোধ করতে অগ্রসর হন। তাঁর প্রয়াসে সরকার 1860 সালের একটি আইন প্রণয়ন করে মেয়েদের বিয়ের বয়স 10 বছর ধার্য করে। এর জন্যেও বিদ্যাসাগরকে সমাজের বিভিন্ন মানুষের রোষের মুখে পড়তে হয়। কিন্তু তিনি তাতে এক বিন্দুও বিচলিত হননি। বিদ্যাসাগরের এই নারীবাদী সত্ত্বা তাঁকে ইতিহাস এক অনন্য স্থান দিয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেও তাঁর অবদান যথেষ্ট। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সকলেই বাংলা সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদানকে স্বীকার করেছেন। প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক সুশীলকুমার দে বিদ্যাসাগরকে বাংলা 'গদ্য-সাহিত্যের প্রকৃত স্রষ্টা' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বিদ্যাসাগরের সুবিন্যস্ত রচনাশৈলী আমাদের মুগ্ধ করে। বিদ্যাসাগরের গদ্য সংস্কৃত নির্ভর সাধু ভাষা এবং বাংলা চলিত ভাষার অন্তর্বর্তী স্তরে বিচরণ করেছিল- আর এখানেই ছিল তাঁর কৃতিত্ব। তাঁর রচনাশৈলীর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল- ভাব প্রকাশের জন্য উৎকৃষ্ট শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে সুললিত ছন্দের প্রয়োগ।
বিদ্যাসাগরকে বহু মানুষ 'দয়ার সাগর' নাম দেন। কারণ, তাঁর কাছে যেই আসতেন তাকেই সাহায্য করতেন। তিনি এখনকার মতো মানুষকে ভিক্ষা দিতে চাইতেন না। মানুষকে প্রকৃত অর্থে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করতেন। একটা ঘটনার অবতারণা করা যেতে পারে। একদিন একটা ছোট্ট ছেলে এসে তার কাছে এক আনা চাইল। তখন তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি যদি দু আনা দেন তাহলে ছেলেটি কি করবে? শুনে ছেলেটি বলল, এক আনা দিয়ে নিজে খাবার কিনবে আর এক আনা মাকে দেবে। এরপর বিদ্যাসাগর এক টাকা দিয়ে চলে গেলেন। এর ঠিক দুবছর পর বিদ্যাসাগরের সাথে ছেলেটির দেখা হতেই ছেলেটি তার দোকানে নিয়ে গেল। ছেলেটি ওই এক টাকা দিয়ে নিজের দোকান করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছিল। এই ভাবে তাদের আর্থিক অনটন দূর করতে বিদ্যাসাগর মহাশয় বিশাল ভূমিকা পালন করেছিলেন। বাংলায় দুর্ভিক্ষের সময় বিদ্যাসাগর নিজের টাকা দিয়ে ত্রাণ ক্যাম্প তৈরি করলেন। এইভাবে নিরন্ন মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিলেন। জীবনের শেষের দিকে তিনি নিজের কর্মভূমি ছেড়ে সাঁওতাল পরগনার কার্মাটারে চলে গেলেন। কিন্তু সেখানেও তিনি চুপচাপ বসে থাকতে পারলেন না। ঝাঁপিয়ে পড়লেন গরিব সাঁওতালদের সাহায্য করার জন্য। তিনি দেখলেন সাঁওতালদের মধ্যে কেউ কেউ ভুট্টা উৎপাদন করেন আবার অনেকে সেটুকু করার সামর্থ্যও নেই। উপলব্ধি করলেন ওখানে ভুট্টা কেনার লোক নেই। তাই তিনি নিজের টাকা দিয়ে ভুট্টা কিনতেন আর যাদের ভুট্টা উৎপাদনের সামর্থ্য নেই সেইসব হতভাগ্য সাঁওতালদের মধ্যে সেই ভুট্টা বিলিয়ে দিতেন। এইভাবে প্রকৃত সর্বহারাদের সাহায্য করেছিলেন। তাঁর অকৃত্রিম সহযোগিতায় বহু মানুষের জীবন বেঁচে গিয়েছিল। বিদ্যাসাগরের আরেকটি সত্ত্বা উল্লেখ না করলে চলে না। সেই সত্ত্বাটি হলো তাঁর চিকিৎসক সত্ত্বা। তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করতেন। এইভাবে বহু দরিদ্র মানুষদের চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তুলতেন।
বিদ্যাসাগরের জীবন ছিল এক সর্বত্যাগীর জীবন। সমগ্র জীবনই আমাদের সমাজ ও দেশের উন্নতির স্বার্থে নিয়োজিত করেন। তিনি স্বার্থশূন্য ভাবে মানুষের উন্নতির জন্য কাজ করে গেছেন। কিন্তু আমরা তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু দিইনি। এছাড়া আমরা তাঁকে বুর্জোয়া, প্রতিক্রিয়াশীল বলে সমালোচনা করেছি। বড়ো বড়ো ডিগ্রী নিয়ে আমরা তাঁর কাজের সমালোচনামূলক লেখা পাতার পর পাতা লিখেছি। আসুন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকীর পূণ্যতিথিতে তাঁর কাজ ও আদর্শকে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে তুলে ধরে নিজেদের পাপস্খালণ করি।