STORYMIRROR

Gopa Ghosh

Classics Inspirational

4  

Gopa Ghosh

Classics Inspirational

ভুবন স্যার

ভুবন স্যার

3 mins
682

প্রতিবারের মতোই এবারেও মেয়ে মুন্নির জন্মদিনটা না করার একটা পরিকল্পনা আগেই করে রেখেছিলাম কিন্তু এবারে আমার মা আর বউয়ের কাছে আমাকে হার মানতে হলো। এবারে মুন্নি সাত বছরে পড়ল। পাঁচ বছরের জন্মদিন টাও বড় করে করার পরিকল্পনা করেছিলাম কিন্তু মায়ের অসুখ এ তা আর শেষ পর্যন্ত করা হয়ে ওঠেনি। এবার দুজনেই এক গোঁ ধরে বসে আছে মুন্নির জন্মদিন এবারে খুব বড় করে করতে হবে। স্কুলে অনেক বন্ধুর জন্মদিনে মুন্নি যায় কিন্তু ওর নিজের জন্মদিনে কাউকে নেমন্তন্ন করেনি কখনো। এবার মুন্নির ইচ্ছা ওর জন্মদিনে অনেক বন্ধু আসবে। মেয়ের আবদার এর কাছে হার মানলাম।

সেদিন বেশ সকালে বউ ঘুম থেকে তুলে দিলো কারণ মুন্নির স্কুলে নিমন্ত্রণ করতে যেতে হবে হেড দিদিমনি কে।

"আমি আবার কেনো, তুমি গেলেই তো পারো"

ঘুম জড়ানো গলায় বললাম

"না না সবার বাবা মা দুজনেই যায়, যাও ফ্রেশ হয়ে এসো, দেরী করে না"

বউয়ের আদেশে বাথরুমে ঢুকলাম ভোরবেলা।

আসলে আমি যে স্কুলে পড়াশুনা করেছিলাম সেটার মর্নিং সেকশানে মুন্নি পড়ে।

স্কুলে ঢোকার সময় একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক কে স্কুলের সামনে শুয়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পরনে শত ছিন্ন একটা নোংরা ধুতি, গালে দীর্ঘদিন না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখ বুজে একপাশ হয়ে শুয়ে আছে বৃদ্ধটি। যতই পাল্টে যাক ভুবন স্যার আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেননি। আমার বাংলার স্যার ভুবন মুখার্জি। ধবধবে সাদা ধুতি সাদা পাঞ্জাবি পরা ভুবন স্যারকে দেখলেই স্কুলের ভিড় কোথায় উবে যেত। যে যার ক্লাসে গিয়ে বসে পড়ত যেনো ওদের মত ভালো ছেলে আর হয় না। আসলে ভুবন স্যারের বাইরেটা খুব রাগী মনে হলেও ভেতরে তিনি ততটাই নরম ছিলেন। ছাত্রদের শাস্তি দেওয়ার প্রথা টাও তার ছিল সবার থেকে আলাদা। একবার অপু সাপ্তাহিক পরীক্ষায় নকল করতে গিয়ে ভূবন স্যারের কাছে ধরা পড়ে যায়। ভুবন স্যার ক্লাসের পরে টিচার্স রুমে অপুকে ডাকে। অপুকে তিরিশ পাতা হাতের লেখা আর দুটো গল্প লিখে আনার নির্দেশ দিলেন। অপু তো কান্নাকাটি শুরু করে দিল

"স্যার হাতের লেখা আমি করে এনে দেবো কিন্তু গল্প লিখতে তো আমি পারিনা"

"তোকে আমি শরৎচন্দ্রের মত লিখতে বলিনি তুই যেমন পারবি একটা গল্প বানিয়ে লিখে আনবি এটাই তোর শাস্তি"

এই হলেন ভুবন স্যার। আমি আরো বুঝেছিলাম আমার বাবার এক্সিডেন্টে মৃত্যুর পর। তখন পড়াশোনার ফিস তো দূরের কথা আমাদের দুবেলা খাওয়াই জুটত না। সেই বছর আমি মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবো। ফিস দেওয়ার সামর্থ্য আমার মায়ের ছিল না। আমি ফিস দেওয়ার ভয়ে দুদিন স্কুলে যাইনি। পরের দিন সকালে ঊঠে দেখি ভুবন স্যার আমাদের বাড়িতে এসেছেন। আমি প্রণাম করতেই উনি বললেন

"জীবনে ভালো ছেলে হও, এমন ভালো যে আরো দশ জনের ভালো করতে পারে"

সত্যিই ভুবন স্যারের এই কথাটা আমি কখনো ভুলতে পারিনি। সেবার আমার মাধ্যমিকের ফিস স্যার মাকে দিয়ে গিয়েছিলেন।

আমাকে স্যারের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্কুলের দারোয়ান ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। ওনার কাছেই আমি জানতে পারলাম ভূবন স্যারের স্ত্রী পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন আর ওনার একমাত্র ছেলে বিদেশে ইঞ্জিনিয়ার। উনি রোজ ই এই বারান্দায় শুয়ে থাকেন। আগে রাত্রি বেলা উঠে বাড়িতে চলে যেতেন কিন্তু এখন শারীরিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে উনি আর উঠতে পারেন না। আগের কথা কিছুই মনে নেই তাই ছেলের ফোন নম্বরও কাউকে বলতে পারেন না। ছেলেও হয়তো সেভাবে আর বাবার খোঁজ নেয় না।

আমি আর স্কুলে ঢুকলাম না। বউকে কিছুটা ভুবন স্যারের কথা বলে অ্যাম্বুলেন্স ফোন করলাম। আমি থাকতে ভুবন স্যারের কোন চিকিৎসা হবে না এটা হতেই পারে না। ভুবন স্যার সব সময় আমাকে বলতেন

"তুই খুব ভালো ছেলে"

এটা শুনে সত্যি আমার আরো ভালো হতে ইচ্ছে করতো। সেই ভুবন স্যারকে আমাকে ভালো করে তুলতেই হবে যেভাবে হোক।

হসপিটালে এডমিট করে বাড়িতে ফিরলাম। ভেবেছিলাম আমার বৌয়ের চিৎকারে হয়তো আমার যেখান থেকে হোক টাকা ধার করেও মুন্নির জন্মদিন টা করতেই হবে। কিন্তু অবাক করে দিয়ে আমার বউ বলল

"মুন্নির জন্মদিন পরের বারে বড় করে করা যাবে, তুমি আগে ভুবন স্যারকে ভালো করে তো লো"

আমি অফিস থেকে ফেরার সময় রোজ ভুবন স্যারকে হাসপাতলে দেখে আসি। রোজই ভাবি ভুবন স্যার চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে হয়তো বলে উঠবে

"তুই খুব ভালো ছেলে"


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics