ভোরের সূর্য্য
ভোরের সূর্য্য
পর্ব নয়
বিপাশা পাগল নয় ; অবসাদগ্রস্ত । রাঁচিতে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন । ডক্টর জেমস অক্টারলোনী তাকে পরীক্ষা করে একথাই বললেন ।
শুরু হল কাউন্সেলিং । সঙ্গে ওষুধ পথ্য । কিছুদিনের মধ্যেই বিপাশা চিটিৎসায় সাড়া দিতে লাগল । কিন্তু অবাক কথা একদিন সে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গেল । রাঁচি -হাওড়া ইন্টারসিটি ধরে নেমে পড়ল হাওড়ায় ।
এতটা পথ বিনা বাধায় এসেছে । এক ভদ্রলোক তাকে সীটে বসতে না দেখে প্রশ্ন করেন - মা ! তুমি কি কলকাতা যাবে ? এতটা পথ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আসছ - কষ্ট হচ্ছে না ?
বিপাশা প্রথমে তাকে কিছু বলতে চায়নি । ভদ্রলোকের পীড়াপীড়িতে তাঁর পাশের সীটে গিয়ে বসল । টি টি এসে টিকিট চাইতেই বলল - টিকিট নেই।
ভদ্রলোক বুঝতে পেরেছিলেন । বললেন - আমি ওর ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি ।
বিপাশা ভদ্রলোকের মুখের দিকে চেয়ে রইল । হয়তো চেনার চেষ্টা করছিল ।
- আপনি কি আমায় কখনো কোথাও দেখেছেন ?
কি সুন্দর শান্ত মনে কথাগুলো বলল বিপাশা ।
ভদ্রলোক বললেন - আমার নাম ডক্টর জেমস অক্টারলোনী। আমি তোমার চিকিৎসা করছিলাম । হসপিটাল থেকে পালিয়ে যাচ্ছ দেখেও আমি তোমাকে আটকাইনি । ফলো করছিলাম । ট্রেনে উঠতে দেখে আমিও উঠে পড়লাম । আসলে আমার উদ্দেশ্য ছিল তুমি কতটা সুস্থ হয়েছ তা' দেখার । আচ্ছা মা ! তুমি কি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছ ?
- না স্যার, বাড়িতেই ফিরে যাচ্ছি । কিন্তু আমার কাছে তো টাকাকড়ি নেই । তাই ভাবলাম ট্রেন ধরে যতটা পথ যাওয়া যায়।
ভদ্রলোক আলাপ জমালেন ।
- তোমার কি হয়েছিল বল তো মা ! হাসপাতালে ভর্তি হতে হল কেন ?
বিপাশা আপাদমস্তক দেখে নিয়ে কিছুটা স্বস্তি পেল যেন ।এই লোকটা গাজীর কোন চর হতে পারে না । ডাক্তার মানুষ। নিশ্চয় কোন কুমতলব নেই ।
বিপাশা তার পূর্বেকার ঘটনা বলে দিল । ডক্টর অক্টারলোনী বললেন - আমি কলকাতার পার্ক স্ট্রীটে থাকি । আসলে নামটা সাহেবী হলেও আমি কিন্তু আদ্যোপান্ত বাঙালি । আমার মা ছিলেন বেঙ্গলি আর বাবা এঙলো- ইণ্ডিয়ান । ব্রিটিশ আমল থেকে আমার পূর্বপুরুষেরা কলকাতার বাসিন্দা ।
বিপাশার সে সব শোনার মন নেই । তার মন পড়ে আছে শশাঙ্কর কাছে । না জানি সে বেঁচে আছে না মরেছে ! ইস্ ডাক্তারবাবু যদি ওর খবরটা দিতেন !
বিপাশার মনে পড়ছে গাজী ও তার দলবলের অত্যাচারের কথা । শশাঙ্ককে ভয় দেখিয়ে নগ্ন দেহে তার উপর বসিয়ে দেওয়ার কথা । সর্বোপরি কানে কানে যে কথাগুলো শশাঙ্ক ওকে বলেছিল বিশেষ করে সেগুলো তার খুবই মনে পড়ছে ।
ডাক্তারবাবু হয়তো অন্তর্য্যামী । ফট করে বলে বসলেন - পুরানো কথা তোমার কিছু মনে পড়ছে না ।
- এ টু জেড মনে পড়ছে স্যার ।
- তা'হলে নির্ভয়ে বলে যাও কথাগুলো। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি তোমাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করব ।
এতবড় আশ্বাসের কথা শুনে বিপাশা তার অতীতের কথা এবং শশাঙ্কর কথা পাড়ল ।
ডাক্তারবাবু বললেন - শশাঙ্ক নামটা খবরে পড়েছিলাম বটে । আচ্ছা, ও কোথায় থাকে ? কি করে ?
- কোথায় থাকে জানি না স্যার । তবে ও যে দুর্বৃত্তগিরি করে তাতে কোন সন্দেহ নেই । কারণ ওই গাজী তাকে সমাজে মিশতে দিলে তো !
- ঠিক আছে। তুমি আমার সঙ্গে চল আমার বাড়িতে। ওখান থেকে আমরা সব খবর জোগাড় করে নেব ।
বিপাশা ফের ডাক্তারের মুখের দিকে চাইল । গায়ের রং ফর্সা ধবধবে । চুলগুলো কিন্তু সাহেবদের মত তামাটে নয় । এক মাথা ঘন চুল, দুটো জুলপিতে পাক ধরেছে । গোঁফও তাই । দাড়ি নেই ।
বিপাশা তাঁর বয়সটা আন্দাজ করে নিল ।
- আপনি বিবাহিত নিশ্চয় ?
ডাক্তার বাবু মুচকি হেসে বললেন - কোই শখ ? সন্দেহ হচ্ছে তোমার ? আচ্ছা, বাড়ি চল দেখতে পাবে ।
তারপর হাওড়া স্টেশন অবধি আর কোন কথা হয়নি। শুধু বর্ধমান পেরিয়ে প্যান্ট্রি কারের লোকজন এসে খাবার দিতে আসার সময় বলেছিলেন - ভেজ খাবে না নন-ভেজ ?
বিপাশা বলল - আগে খাবারে কি কি দেওয়া হচ্ছে জেনে নিই ।
হাওড়ায় নেমে ডাক্তারবাবুর গাড়ি করে যখন তাঁর বাড়িতে পৌঁছাল তখন রাত দশটা বেজে গেছে ।
ডাক্তারবাবুর মেয়ে জ্যাকলিন বিপাশার সমবয়সী । তাই সখ্যতা হতে সময় নিল না । দুই বন্ধু মিলে একটা সোফায় গিয়ে বসল ।
বিপাশা তার কথা বলতে লাগল । বাসে কলেজ যাবার সময় শশাঙ্কর সঙ্গে তার কথা, গাজীর কথা সব বলল ।
জ্যাকলিন বলল - ভেবো না । আমার বাবার কাছে এসেছ যখন তোমার প্রব্লেম সলভ হয়ে যাবে ।
( চলবে )
