ভোরের সূর্য্য প্রব পঁচিশ
ভোরের সূর্য্য প্রব পঁচিশ
পর্ব পঁচিশ
খাবার টেবিলে বসে একনাগাড়ে নিজের কাহিনী শুনিয়ে যাচ্ছে শশাঙ্ক । শ্রোতা তো মাত্র দু'জন । জেলার বিবেকানন্দ কুমার আর তাঁর ধর্মপত্নী মিসেস সঞ্জনা কুমার । জেলার সাহেবের অফিসারটি আজ ডাইনিং রুমের সাজে সাজিয়ে তোলা হয়েছে ।
জেলার সাহেব একবার করে টিপ্পনী কাটেন আর তাঁর স্ত্রী ততই বিরক্ত হয়ে সাহেবকে তিরস্কার করেন ।
জেলার বললেন - সে তুই যা বলছিস বল । ভোর হলেই তো তোকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে । এখন তো গীতা নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছিস । আগে এমনটা মনে হয়নি কেন ?
শশাঙ্ক বলে - স্যার, আমার মানসিকতাকে এমন ভাবে তৈরি করে দিয়েছেন যে মৃত্যুভয় কাকে বলে আমি ভুলে গেছি । এখন যদি বলেন ' পিস্তলটা দিচ্ছি ; নিজেকে নিজেই গুলি করে মেরে ফেল' তো আমি অনায়াসে সেই কাজ করতে পারি । কিন্তু যদি বলেন এই যে আমার গায়ে একটা মশা বসেছে ( মশাটা দেখিয়ে ) আমি ওকে মারতে পারব না । ওর মুখের গ্রাস আমি কেড়ে নিতেও পারব না । দেখছেন তো কখন থেকে রক্ত শুষে খাচ্ছে ; অথচ আমার ওকে বিরত করতে বিবেকে লাগছে । সে ও তো ঈশ্বরসৃষ্ট জীব ।
মিসেস সঞ্জনা কুমার বললেন - অনেক হয়েছে । এবার ওটা না মারবে তো সরিয়ে দাও ।
- কোন লাভ নেই ম্যাডাম । রক্তের নেশায় পেয়েছে ওকে। তাড়িয়ে দেব আবার বসবে আবার রক্ত শুষবে ।
- তাহলে ওকে মেরে ফেল।
- ওই যে বললাম ম্যাডাম ! পারব না । আর কোন পাপকাজ করব না ।
জেলার সাহেব বললেন - এই ভাবনাটা আগে ভাবিসনি কেন ? অপরিণামদর্শী কাজ করে এখন পল গুনছিস ।
মিসেস কুমার ধমকে উঠলেন - তোমার সাহেবীয়ানা এখন রাখ তো । দেখছ না ছেলেটা খাবারগুলো শুধু নাড়াচাড়া করছে, মুখে তুলছে না । আচ্ছা শশাঙ্ক ! তুমি খাচ্ছ না কেন ? আমার কষ্টের রান্না তোমার পছন্দ হয়নি ?
মুখ থেকে লম্বা জিভ বের করে শশাঙ্ক বলল - না না ম্যাডাম । আপনার মত রান্না আর কেউ করতে পারে বলে আমার মনে হয় না । আমি এক একটি দানা খেয়ে নেব । আপনারা আমার কথা শুনতে চাইছেন- আমি বলে যাচ্ছি , সেজন্য খাওয়াতে দেরী হচ্ছে ।
জেলার বললেন - তো বলে যা না বাপ ! এত হেঁয়ালি করছিস কেন ?
তারপর সঞ্জনার চোখ পাকানো দেখে চুপ করে যান । শশাঙ্ক বলতে শুরু করে -
স্যার, আমার বাবা করাত কলে কাজ করত । কাঠ চেরাই করাই ছিল তার কাজ । বড় বড় মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি করাত দিয়ে কেটে পাটা তৈরি করত । শাল, সেগুন, শিরীষ নানা রকমের গাছের গুঁড়ি চেরাই করত । একদিন করাত কলের মালিক বাবাকে বলল - তোর নাম তো সোমনাথ?
বাবা বলল - হ্যাঁ।
- তা সোমনাথ মানে জান?
বাবা তো নিরক্ষর ছিল । ও সব মানেটানে নিয়ে তার কি কাজ ! তবু বলেছিল মা বলেছেন ( আমার ঠাকুমা ) সোমনাথ হল শিবের আর এক নাম ।
মালিক বলল - শিবের তো আরও অনেক নাম আছে; তো বেছে বেছে এই সোমনাথ নামটাই কেন তোর মা চয়েস করল? সে কি জানত না সোমনাথ নামের লোকেরা বেশীদিন বাঁচে না?
রাগ হয়েছিল বাবার । তার মা বাবা তার কি নাম রেখেছে তা নিয়ে তোর এত মাথাব্যথা কিসের রে শালা ?
মালিক বলল - রাগিস কেন ? এই দেখ না আমার বিধবা মা ; আমার ছোটছেলের নাম সোমনাথই রেখেছিল। কি হল ? পাঁচ বছর পেরোতে না পেরোতেই ওলাওঠায় মরল । তাই তোকে একথাটা বললাম ।
রাগে বাবার মাথাটাই ঘুরে গিয়েছিল । পড়ে গিয়েছিল করাতকলের মাঝে । ভাগ্যিস আরও যারা ছিল চট করে কলটা বন্ধ করে দেয় । সে যাত্রা বাবা বেঁচে গিয়েছিল । কিন্তু কল লক আউট হতেই কয়েক মাসের মধ্যেই মারা গেল । আচ্ছা ম্যাডাম ! বলুন তো নামে কি এসে যায়? বাবার নাম যদি চিরঞ্জিবী হত তবে কি বাবা চিরকাল বেঁচে থাকত ?
এই যে আমার নাম শশাঙ্ক । এর মানে তো চাঁদ। শশ অর্থাৎ খরগোশ অঙ্ক অর্থাৎ কোল । মানে যার কোলে খরগোশ থাকে তাকে শশাঙ্ক বলে । কোন মানে হয়?
যাক সে কথায়। এবার নিজের কথা বলি । একদিন গোপনে আমি আমার বোনের বাড়ি যাই। তখন সে বিধবা হয়ে গেছে । তথন দুপুর বেলা । শীতলা ষষ্ঠীর পূজো। পৌষমাস। আড়াল থেকে দেখি বোনটা আমার সাদা থান পরে উঠোনে চেয়ার টেবিল বের করে মজা সে পান্তা খাচ্ছে । মাছের মাথা দেওয়া বাঁধা কপি। মাছের চর্বি দিয়ে শীষ পালং এর তরকারি । বড় মাছের টক ।
বিধবা হয়েও বৈধব্য জীবন যাপনের কোন প্রশ্নই নেই । ইচ্ছে করেছিল বলি থান শাড়িটা খুলে দিয়ে রাঙা শাড়ি পর না ! বলিনি, আড়াল থেকে দেখে চলে গেছলাম । পথে গ্রামের একজন জানাল - তোমার বোনের তো এখন পায়াভারী হে ! শহরে দোকান দিয়েছে। শুনে খুব আনন্দ হল স্যার । কিন্তু পরের কথাটা শুনে আমার মাথায় রক্ত চেপে গিয়েছিল ।
ম্যডাম বললেন - কেন ?
- শুনবেন ম্যাডাম ! শ্যামলের উপার্জিত টাকাকড়ি নিয়ে শহরে একটা গণিকালয় খুলেছিল । ভাবা যায় ? আমি না হয় দশচক্রে ভগবান ভুত হয়ে আছি । তাই বলে এত এত টাকা নিয়ে কোন ভাল দোকান না দিয়ে কি না গণিকালয় খুলে বসেছে !
মিসেস কুমার বললেন - তারপর ?
( চলবে )
