গুলাল আবু বকর ‹›

Thriller

3  

গুলাল আবু বকর ‹›

Thriller

ভীষণ এক ভয়!

ভীষণ এক ভয়!

9 mins
556


        ⟨লেখাটি একখানা রহস্যজনক গল্প⟩

সুজান বেসরকারি হাসপাতালের এক নিষ্ঠাবতী নার্স। একজন সেবিকা হিসাবে তার গর্ব করার মতো ঘটনার সংখ্যা অসংখ্য। একারণে প্রায় সকলেই তাকে পছন্দ করে। সে-ও এটা জানে এবং আরও মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজ সম্পন্ন করে থাকে। হাতের কাছে এমন দু'একটি ঘটনা এমন আছে যাতে তার নিষ্ঠা কতখানি গভীর তা বুঝিয়ে দেওয়া যায়। প্রথমতঃ বলি, নন্তু খুড়োর একবার একখানা পা ভেঙেছিল, কিভাবে তা ভাঙলো খুড়োই ভালো জানে, হাঁটুর নিচের দিকের হাড়গুলো টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। অতএব তাকে হাসপাতাল যেতেই হল। সেই হাসপাতালে যেখানে সুজানের হাতের স্পর্শ থাকে। শোনা যায়, তারই সেবাযত্নে খুড়ো অতি সত্বর সেরে গিয়ে বাড়ি চলে আসে। এজন্য সে একটুও বাড়তি পাওনাকড়ি দাবি করে নি। ছোকরা ছেলেরা মজা করার জন্য বলে, "নন্তু খুড়োর বেড়ে কপাল। বাতিল ঠ্যাঙ্ আবার ফিরে এসেছে। ভাগ্যিস সুজান ছিল তাই ! নয়তো ছ’মাস তার হাসপাতালের ভাত কপালে লেখা ছিল।" একথা শুনলে কার না রাগ হয়, কিন্তু খুড়ো শুধু হাসে। রেগে যাওয়া তার ধাতে নেই। খুড়ো মুচকি হেসে বলে, "বেশ তো, হাত-পা ভেঙে একবার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে দেখলেই পারো। বলো তো সে ব্যবস্থাও করে দিই না হয়।" যে কখনো রাগে না তাকে কোনোভাবে রাগানো যায় না। এরপর মাঝেমধ্যে সুজানের সাথে দেখা হলে খুড়ো হেসে বলে, "কি গো মেয়ে এতদিন তো একমনে মানুষের সেবা শুশ্রূষা করলে এবার একটু গুছিয়ে সংসার করলে কেমন হয়? অনেক ভালো পাত্র আমার হাতে আছে...।" লজ্জা পেয়ে খুড়োকে থামিয়ে সুজান বলে ওঠে, "ওসব কথা এখন থাক খুড়ো। যে কাজে আছি সেখানে মন দিয়ে কাজ করে আরও উন্নতি করতে চাই। বয়স তো চলে যায় নি।" এই বলে লজ্জায় লাল হয়ে তাড়াতাড়ি চলে যায়। নন্তু খুড়ো চলে যায় তার নিজের কাজে। 


        আর একটা ঘটনা উল্লেখ করি। একবার আমাদের প্রতিবেশী দেশের এক বিদেশিনী তার সেবাযত্নে এতই মুগ্ধ হলেন যে নিজদেশে ফিরে গিয়ে সুজানের জন্য দু'সেট সুন্দর নার্সের ড্রেস পাঠিয়ে দিলেন। এমন আরও দু'একটি ঘটনা তার নিজের মুখে শুনেছি যা তার স্মৃতিতে বরাবর ঊজ্জ্বল হয়ে আছে।

       একবার মফস্বল শহরের এক বইয়ের দোকান থেকে বের হয়ে ফুটপাথ ধরে হাঁটছিলাম। উদ্দেশ্য কোনো এক ছাপাখানায় যাওয়া। ছুটির দিন, এদিক ওদিক লোকজনের ভিড় ছিলো। তার মধ্যে হঠাৎই একটা পরিচিত মুখ নজরে পড়ল। মেকআপ করা আকর্ষণীয় মুখ। ফুটপাতের ওদিকটায় দাঁড়িয়ে। আমি হাত নেড়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। সে দেখতে পায় নি। খানিক এগিয়ে আমি আবিষ্কার করলাম একজন সুদর্শন যুবক তার সঙ্গে আছে। দু'জনে পরষ্পর কথাবার্তা বলছে। কাছ দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম।প্রথমে সুজানই আমাকে দেখতে পেল। সম্ভাষণ জানিয়ে বললাম, "সব কুশল তো!" সে মাথা নেড়ে বলল, "হ্যাঁ।" পাশের যুবকের সাথে আমার আলাপ করিয়ে দিলো। তারই এক বন্ধু। ভালো চাকুরিজীবী। "জেনে খুশি হলাম", আমি বললাম। আমি জানালাম, "সুজান আমার প্রতিবেশী।"


জানলাম যে এখন সে ছুটিতে আছে। তারা দু'জন ছুটি কাটাতে বাইরে বেরিয়েছে। আমি তাদের 'সুন্দর ছুটি উপভোগ' কামনা করে গন্তব্যস্থলে চলে গেলাম। 


       এখন সেই বিশেষ ঘটনাটা বলতে চলেছি যেটা ঘটেছিল তারা ছুটি থেকে বেড়িয়ে বাড়ি ফেরার দিন দুই পর। তবে তার ছুটি তখনও শেষ হয়নি। ঘটনার দিন বিকালে অন্যান্য কাজকর্ম সেরে হেঁটে পোস্ট অফিসের দিকে যাচ্ছিল সে। কিছু একটা কাজ ছিল তার। সৌভাগ্যক্রমে পথে দেখা হলো আবাল্য পরিচিত এক বান্ধবীর সাথে। দীর্ঘদিন পর দেখা। তাই দীর্ঘক্ষণ স্মৃতিচারণে কেটে গেলো। অতঃপর সুজান বান্ধবীকে বলে, আজ রাতটা তার ফ্ল্যাটে কাটানোর জন্য। অন্য একদিন আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বান্ধবী নিজের কাজে চলে যায়। ততক্ষণে দিগন্তের ওপর থেকে সূর্য যায় যায় করছে। এতক্ষণে পোস্ট অফিস খোলা আছে কিনা কে জানে। মনটা অন্যমনস্ক ছিলো। এত দেরি হয়ে যাবে খেয়াল করেনি। পথের দুপাশে কয়েকটি বাড়ি। ছোট ছোট। সেগুলোর আশেপাশে হাল্কা অন্ধকার তখন ঘুরছে। এ রাস্তায় লোকজনের চলাচল খুব কম।


       মাঝেমধ্যে একটি বা দু'টি লোককে সে অতিক্রম করে যাচ্ছিলো মাত্র। কেউই তার চেনা নয়। অন্ধকার আরও একটু গাঢ় হল। চলতে চলতে এক টুকরো ছোট পাথর জুতোর ডগায় লেগে ঠিকরে শব্দ করে রাস্তার ওপর দিয়ে ছুটে চলে গেল। এইসময় পাঁচিল বিহীন একটি ছোট বাড়ির দোতলার বারান্দায় এক পুরুষের লাল মুখ তার নজরে পড়ল হঠাৎই। গা-টা কেমন ছমছম করে উঠল। সাহস করে আরও একবার তাকালো সেদিকে। দূ...র এই সন্ধ্যাবেলা কিসের ভয়! বুঝতে পেরে সে মনে মনে হেসে ফেলে। লোকটির মুখে ধরা আছে একটা জ্বলন্ত সিগারেট। জোরে টান দিলে অন্ধকারে তা অমন লাল আভা দেখাচ্ছে। ফর্সা মুখে তা প্রতিফলিত হচ্ছে বেশি। কিন্তু তার মনে হল লোকটির স্থির চোখদুটো তার দিকেই নিবন্ধ! আদপে এমনটা কিন্তু নয়, তবু তার এমনটাই মনে হল। একটু কেঁপে গেল বুকটা। মানবমনের যেকোনো আশংকা এমন স্বাভাবিক কারণেও তাকে পেয়ে বসে।

একটু পরে সিগারেটের আরেক টান, আবার দেখা গেল সেই মুখ, এবারও আবছা। মনে হল, তার দিকে একইভাবে তাকিয়ে। পা-টা কেমন ভারী হয়ে এল। সামনে আর এগোতে চাইছে না যেন। এখন পেছন ফিরে জোরে জোরে হাঁটতে শুরু করল। তার মনের জোর বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। হাঁটছে, তবে অনেক কষ্ট করে। শ্বাসপ্রশ্বাস হয়েছে বেশ দ্রুত। রাস্তায় কদাচিৎ যাকে সে অতিক্রম করছিল, চমকে চমকে উঠছিল। মন চাইলেও জোরে হাঁটা যাচ্ছিল না। একটা সন্দেহের বৃত্ত তার মনে ঘুরপাক খেতে লাগল।... বৃত্তটা গোল হয়ে ক্রমশ বড় হতে থাকলো। এক সময় সুজান এসে উপস্থিত হয় তার ফ্লাটের সামনে। আশপাশের জানালা দিয়ে ছুটে আসা আলোর কণাগুলো সেই ফ্লাটের গায়ে পড়ে খানিক আলোকিত করলে নিজেকে কিছুটা হাল্কা মনে হয় তার। ভিতরে ঢুকে দ্রুত ইলেকট্রিক সুইচে হাত দিল। তারপর দরজা এঁটে দিল ভালো করে। চিঠিখানা টেবিলের ওপর ফেলে দিয়ে একখানা বই চাপা দিল। 


   ফ্লাটের মধ্যে জিনিসপত্র আছে শুধু প্রয়োজন মতো। একটা শোবার খাট, চেয়ার, টেবিল, কিছু বইপত্র রাখা জানালায়। এদিকটার কোনায় একটা আলমারি। ওদিকটায় জামাকাপড় রাখার আলনা। লাগোয়া একটি ছোট রান্নাঘর। পোষাক পালটে হাত-মুখ ধোয়ার জন্য পাশের বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে সে থমকে দাঁড়ালো। বামদিকে, ফ্লাটের যে পাশটা অন্ধকার, সেদিকের খোলা জানালার মধ্য দিয়ে দূরে কোথাও আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে। অসাবধানতা হেতু আজ জানালার পাল্লা টেনে দেওয়া হয় নি। সুজানের মনে হল বিন্দুটা জানালার খুব কাছেই। উদ্বেগের সময় প্রকৃত ঘটনা ও মনের ধারণা পরষ্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে না। সিদ্ধান্ত ভুল হয়ে যায়। সুজানের ঠিক তাই হল। মনের মধ্যে ভেসে এল, কে যেন জানালার ঠিক নিচেই দাঁড়িয়ে আছে। এসবই তার মনের ভুল। মনের ভুলের সময় যুক্তি কোনো কাজ করে না। দ্রুত বেরিয়ে আসে সেদিক থেকে। বিছানার ওপর ধপ্ করে বসে পড়ে। বুকের ধুকপুক শব্দ বাইরে থেকে অনুভব করে সে। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে। রাত বেশি তো হয়নি বরং সন্ধ্যা বলা যায়। কিন্তু তার মনের কাছে যেন এটা গভীর রাত। মনে হয়, কেউ তাকে অনুসরণ করছে। কিন্তু কেন? মনোযোগ একাগ্র করে মনে করতে চেষ্টা করে ঠিক কী ঘটছে। লোকটা কে? তার পরিচিত কেউ কি? ভালো করে ভাবতে চেষ্টা করল। হ্যাঁ, হ্যাঁ আবছা আবছা যেন মনে পড়ছে মুখটা। এ তো সে―ই মুখ! সে আজ থেকে বছর তিন আগের ঘটনা।... একদিন চারজন লোক একটা খাট বহন করে হাসপাতালে নিয়ে এল। খাটে একজন শুয়ে আছে। নিশ্চয় খাট যারা বহন করে এনেছিল তারা তার আত্মীয় হবে। দেখে মনে হলো বেশ গরীব। অন্তত পরনের পোষাক দেখে তাই মনে হয়। রোগীর যা অবস্থা, তাতে এখনই চিকিৎসা দরকার। কিন্তু এ চিকিৎসায় মোটা টাকা চাই। কর্তৃপক্ষ তাই চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করল। সংশ্লিষ্ট ডাক্তারবাবু যা বললেন তার মর্মার্থ হল, তিনি কোনো দানছত্র খুলে বসেন নি। এদেশে গরীবেরও অভাব নেই। সবাই যদি বিনা খরচে চিকিৎসা চায় তবে এই প্রতিষ্ঠান চলবে কি করে। সরকারের তৈরি হাসপাতাল তো আছে। সেখানে লোকজন কি যায় না? রোগীর পরিবারের লোকজন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন অন্য গ্রহ থেকে এই স্টাফরা এসেছে। ঘটনাক্রমে সুজান সেখানে উপস্থিত ছিল। রোগী অত্যন্ত করুণ দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালো। খাট বাহকের চারজনের একজন হঠাৎই তার পা ছুঁয়ে ফেলল। বলল, "দিদিমণি বাঁচান। অন্য জায়গায় নিতে নিতে এ রোগী বাঁচবে না। আগে ভর্তি করুন, ঘটি বাটি যাহোক বেচে খরচ দেব।" কিন্তু সুজান কোনো কথায় টলল না। ডাক্তারবাবুকে সে চটাতে রাজি নয়। অগত্যা তারা রোগী নিয়ে ফিরে গেল। দেরী হলে রোগী যে বাঁচবে না সুজানের কাছে সেকথা অজানা নয়।...কিন্তু আজ যে মুখ তার চোখের সামনে ভেসে ভেসে উঠছে তার সঙ্গে সেই রোগীর মুখের আশ্চর্য মিল! এটা কেমন করে হতে পারে? সে ভাবতে থাকে। সেই স্মৃতি বিলীন হতে না হতে আরো একটা ঘটনা মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। আগেই বলেছি, সবাই জানত সে অত্যন্ত ভালো সেবিকা। কিন্তু তার নিজের বিবেককে সে কখনো প্রতারিত করতে পারে না। সে জানে তার সুনামের প্রতি সুবিচার সে সবসময় করতে পারে নি। মনে পড়ে একবার অর্থের লোভে কত নিচে সে নেমেছিল।... রোগীদের জন্য যে সব ওষুধপত্র আসত তার সবটা রোগীর কাছে যথাযথ পৌঁছাতো না। দামী ওষুধগুলো কালোপথে বিক্রি হয়ে যেত। সে এসবের একটা মোটা অংশ আত্মসাৎ করত। একবার এভাবে এক রোগী মারা যায়। ইঞ্জেকশনে ওষুধের বদলে ছিল শুধু পরিশ্রুত জল। ব্যাপারটা খুবই সহজ এবং সবকিছু তখনকার মতো চাপা পড়ে যায়। 


       আজ ওয়াশ রুমের ওপারে যা দেখেছে বোধ হচ্ছে এটা অবিকল সেই মুখ। মুহূর্তে চমকে ওঠে সে। অন্ধকারের দিকে এখন তাকাতে ভয় হচ্ছে। হৃৎপিণ্ড যেন বুকের মধ্যে অনবরত হাতুড়ি পিটে চলেছে। 

       এতসব অতিক্রম করে অন্য আর একটি ঘটনা তার স্মৃতিতে ফিরে আসে। কিছুতেই সেটাকে আটকানো যায় না। ঘটনার স্থল ছিল সেই একই হাসপাতাল এলাকা। বিশেষ কেউ বিষয়টা জানত না। জানত একমাত্র একজন ডাক্তার ও সুজান। 

       কোনো এক শারীরিক অসুস্থতার জন্য একবার এক মহিলা সেখানে ভর্তি হন। মহিলার স্বাস্থ্য যথেষ্ট ভাল, দেখতে সুন্দরী। মহিলার স্বামী অর্থবান। স্ত্রীর জন্য ভালো কেবিনে রেখে তিনি চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। সুজানের ওপর সেবার দায়িত্ব দেওয়া হল। কিছুদিন চিকিৎসার পর তিনি অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠলেন। দিন দুয়েক পরই ছাড়া পেয়ে যাবেন। স্বামীকে সেকথা জানিয়ে দেওয়া হল। দুদিন পর অপ্রত্যাশিতভাবে সেই মহিলা হঠাৎ মারা গেলেন। একেবারে সুস্থপ্রায় রোগী, হঠাৎ মারা গেল! মহিলার স্বামী হতভম্ব ও ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন। গাফিলতির অভিযোগ তিনি আনলেন। হুমকি দিলেন, আইনের শরণাপন্ন হবেন। কর্তব্যরত ডাক্তার সার্টিফিকেটে লিখলেন "হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু।" কিন্তু আইনের হাত অত লম্বা নয়। কি প্রমাণ আছে ভদ্রলোকের কাছে? মৃতের 'আত্মার শান্তি'র কথা ভেবে তিনি শেষমুহূর্তে পিছিয়ে গেলেন। আর অগ্রসর হতে চাইলেন না। 

    এখন এই ভয়ের মুহূর্তে সুজানের মনে পড়ে যায়, ঠিক কী হয়েছিল সেদিন। সুজানের মনে পড়ে, মহিলার স্বামীর সেই উন্মাদপ্রায় করুণ মুখ। তিনি তার স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালবাসতেন।


       আজকে দেখা ঐ রহস্যময় মুখের সাথে সেই ভদ্রলোকের মুখের গঠনের কোথাও যেন মিল আছে। তবে কি তিনি তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চান? তার জানালার নিচে কি তিনি আছেন? তাই বা হবে কি করে! ভদ্রলোক তো প্রকৃত ঘটনা জানেন না। তবুও সুজান ভয়ে কুঁকড়ে যায়। কিন্তু মহিলার মৃত্যুর জন্য দায়ী তো সেই ডাক্তার, সুজান নয়।...

      সেদিন রাতে মহিলার ঘরে রাতের খাবার পৌঁছে দিতে অন্যদিনের তুলনায় একটু দেরি হয়ে যায়। সম্ভবত ঐ ডাক্তার এ সম্পর্কে জানতেন না। চেক-আপের জন্য দরজার কাছে পৌঁছে সুজান দেখে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। আশ্চর্যের ব্যাপার, ভিতরে ধস্তাধস্তির শব্দ! কারো মুখে কিছু গুঁজে দিলে যেমন আওয়াজ হয়, তেমনই মৃদু গোঙানি। সুজানের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। কাজেই সে বুদ্ধি করে দরজার 'কী-হোলে' চোখ রেখে তাজ্জব বনে যায়। বিশ্বাস করতে পারে না তার চোখকে। স্পষ্ট দেখতে পায় সেই ডাক্তার ঐ মহিলার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যুক্ত আছেন। অবৈধ কাজ শেষে ডাক্তার নিজেকে আলাদা করে নিলেন। মহিলার অবিন্যস্ত পোষাক গুছিয়ে নিতে বাধ্য করলেন। ডাক্তার এবার বের হবেন। সুজান দ্রুত আড়ালে চলে গেল। উত্তেজনায় সে রীতিমত কাঁপছে। ডাক্তার চলে গেলে সে তাড়াতাড়ি মহিলার কামরায় প্রবেশ করে দেখল তার বিদ্ধস্ত করুণ মুখ। মহিলা ব্যর্থ চেষ্টা করলেন সব কিছু ঢাকতে। সুজানের নারী হৃদয়ে তা প্রচণ্ড আঘাত করল। এই পীড়াদায়ক ঘটনার সাক্ষী থেকে তার চিত্ত এত চঞ্চল ছিল যে সে কিছুই ঠিকমত ভাবতে পারছিল না। সেদিন রাতেই মহিলা রহস্যজনকভাবে মারা গেলেন। সেইসাথে সমস্ত প্রমাণ লোপাট হয়ে গেল।

      এমন সব ঘটনা তার স্মৃতি থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসতে থাকে। কখনো সখনো এমন সব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যা হাসপাতাল ছাড়া অন্যত্রও ঘটেছিল। এক সাহায্যপ্রার্থী দরিদ্র মানুষকে তাড়িয়ে দেওয়া... এক বিক্রেতার সাথে বৃথা তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়া... এক আত্মীয়ের সাথে সামান্য কারণে সম্পর্ক ত্যাগ... একের পর এক মুখগুলো ভেসে এসে ভিড় করে। একটা সময়ে সে আর কিছুই ভাবতে পারে না। নার্ভাসনেস কাটাতে অল্প হাঁটাচলার চেষ্টা করে। কে যেন তার দৃষ্টি টেনে নিয়ে যায় জানালার বাইরে। আর অকস্মাৎ চোখ পড়তেই চিৎকার করে বিছানার ওপর পড়ে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। বন্ধ ঘরে তার চিৎকার বাইরের কেউ কখনো শুনতে পায় না।

      পরদিন দুপুর নাগাদ সুজানের ভাবী স্বামী সেই ভদ্রলোক, তার সাথে দেখা করার জন্য এলেন। এখানে তার আসার পূর্ব নির্দিষ্ট সময় ছিল না। সুজানের ঘর ভিতর থেকে বন্ধ দেখে অনেক ডাকাডাকি করেও সাড়া পেলেন না। তখন তিনি প্রতিবেশীকে ডেকে আনলেন। তারপর পুলিসে খবর দিলেন।

       সবাই দেখলেন স্বাভাবিক অবস্থায় সুজান বিছানার ওপর পড়ে আছে। তবে চোখদুটো বিস্ফারিত। দেহে প্রাণ নেই। পুলিশ সব জিনিসপত্র নিরীক্ষণ করল। কোথাও কোনো চিরকুট পেল না। ডাকবাক্সে না-ফেলা সেই চিঠি তারা পেল। সেখানে কোনো ক্লু দেখতে পেল না। তার মৃতদেহের পোষ্ট-মর্টেম করা হল। কিন্তু মৃত্যুর বোধগম্য কারণ খুঁজে পাওয়া গেল না। তার সাথে হারিয়ে গেল তার জীবনের ইতিহাস।

    © দেখা হবে নতুন এক লেখায়। ধন্যবাদ!

             


    


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Thriller