ভাঙ্গা গড়ার খেলা
ভাঙ্গা গড়ার খেলা
অন্ধকার ঘর জুড়ে বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা। খোলা জানলা দিয়ে আকাশের একফালি চাঁদ তার আলো বিস্তার করে অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করছে আপ্রান। কুহু আর রাহুল মুখোমুখি বসে আছে। কারোর মুখে কোন কথা নেই, তবে চোখের ভাষা গভীর এবং স্পষ্ট। দেওয়াল ঘড়িটা ঢং... ঢং... করে বেজে জানান দিচ্ছে প্রকৃতির বুকে রাতের গভীরতা।
পরিবেশের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে রাহুল বলে উঠল, আর একটা সুযোগ কি.... দেওয়া যায় না.... আমাকে!!!!! আমি কথা দিচ্ছি সবকিছু ঠিক করে দেব!!!
কুহু দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠল, সুযোগ! আর কত সুযোগ দেব বলতে পারো! এই আট বছর ধরে তোমাকে, আমাদের সম্পর্কটাকে সুযোগই তো.... দিয়ে আসছি আমি! কিন্তু কোন পরিবর্তন হয়েছে কি? হয় নি! না. তোমার! না. আমাদের সম্পর্কের! আসলে ভুল আমার, আমি আমার পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে, তোমাকে বেছে নিয়েছিলাম কারোর বারন শুনিনি! তোমার হাত ধরে বেড়িয়ে এসেছিলাম, ওটা আমার ভুল!আমাদের সুখে ভরা সংসারের স্বপ্ন দেখে ছিলাম ওটাও আমার ভুল! তোমাকে অন্ধের মত বিশ্বাস করে ছিলাম ওটাও আমারই ভুল! আর ভেবেছিলাম আমার রাহুল আমাকে ছাড়া কোনদিন কারোর কথা ভাবতেই পারেনা! সেটাও আমারই ভুল ছিল, আর বারবার একই ভুল করে চলেছি আমি, সমস্ত কিছু বুঝেও ন. বোঝার ভান করি, চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে চাইনা। আমার ভুল. সবই আমার ভুল। কষ্টে কুহুর গলা রুদ্ধ হয়ে আসে।
রাহুল উঠে কুহুর পাশে বসে কুহুর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, প্লিজ ছেড়ে যেওনা আমায়! আমি কি নিয়ে বাঁচব !আমি মানছি চরম একটি ভুল করে ফেলেছি, যার ক্ষমা হয়না! তবুও ক্ষমা চাইছি, আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি কুহু। ঠিক আছে আমার কথা না... হয় ছেড়ে দাও! আমাদের ছেলে বাবাই এর কথাটা একবার ভেবে, একটা সুযোগ দাও প্লিজ... কুহু!
কুহু ঠোঁটের কোনে তাচ্ছিল্যের হাসি এনে বলল তুমি যখন কাজটা করেছিলে তখন একবারও ভেবে ছিলে বাবাই এর কথা! আমার কথা, না....ভাবনি! ভেবেছিলে নিজের কথা শুধু নিজের কথা, যেখানে আমাদের কোনো অস্তিত্বই ছিলনা!তাহলে এখন আমাকে ভাবতে বলছ.. কেন! সন্তান যখন আমাদের তখন দায়িত্ব, কর্তব্য, ভাবনা, চিন্তা সবকিছু দুজনেরই থাকা উচিত! নাকি আমি মা. বলে সব দায়িত্ব, কর্তব্য, ভাবনা, চিন্তা একা আমার! এটাই বলতে চাইছো...তো রাহুল? আসলে এ ছাড়া কিইবা বলতে পারো তুমি, কোনদিন নিজের স্বার্থের গন্ডীর বাইরে বেড়িয়ে নিজেকে, আমার জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেখো.তাহলে বুঝতে পারবে ক্ষমা করা আদৌ যায় কিনা!
রাহুল বলল না.... আমি সেরকম কিছুই বলতে চাইছিনা কুহু, শুধু বলছি ব্রোকেন ফ্যামিলিতে বেড়ে ওঠা একটা বাচ্ছার জন্য খুব কষ্টের, আমার দোষের শাস্তি বাবাইকে দিওনা! বাবাই এর জন্য আমি বলছি সবকিছু ভুলে আবার নতুন করে শুরু করা যায় না! বাবাই এর কথা ভেবে একটিবার!
কুহু বলল না. যায় ন কি করে ভুলে যাবআমার স্বামী আমাকে মিথ্যা কথা বলে দিনের পর দিন নিজের সুখের জন্য অন্য জগত তৈরী করেছে, আমার অধিকার অন্য জনকে দেওয়ার কথা ভেবেছে, আমার নারীত্ব কে অপমান করেছে,আমার পবিত্র ভালো বাসাকে কলঙ্কিত করেছে, কি. করে ভুলে যাব! যখন আমি একটু ভরসার, ভালোবাসার হাত চেয়েছি তোমার কাছ থেকে!পেয়েছি কি... পাইনি! তার বদলে পেয়েছি অবহেলা আর অবহেলা, কি করে ভুলে যাব!!!!! কুহু বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
রাহুল কুহু কে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করতে চাইলে কুহু নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠল.
এখন আমার কারোর প্রয়োজন হয় না..... আমি নিজেকে সামলে নিতে শিখে গেছি। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে, এখন আর নতুন করে কোন কিছুই শুরু হওয়া সম্ভব নয়! তোমার জন্য আমার হৃদয়ে যেটুকু ভালোবাসা ছিল, শ্রদ্ধা ছিল, সেটাও শেষ রাহুল! এখন শুধু আছে ঘৃনা একরাশ ঘৃনা! আর আমি ভীষন রকম ক্লান্ত এই রকম একটা সম্পর্ক বইতে বইতে। রাত তো অনেকটা হলো এখন একটু বিশ্রাম নিতে চাই, আর কথা বলতে ভালো লাগছেনা! তাছাড়া আমাদের মধ্যে আর তো কোনো কথা বাকি নেই! সবকথা আশা করি শেষ হয়ে গেছে! কালকে দশটায় কোর্ট যেতে হবে, আর যেটুকু বাকি আছে ওটা ওখানেই শেষ হয়ে যাবে! আর বাবাই আমার কাছে থাকবে, ও আমার দায়িত্ব, তোমাকে চিন্তা করতে হবেনা! তুমি তোমার নিজের দুনিয়াতে নিজের মতো ভালো থেকো! আর আমাদেরকে আমাদের দুনিয়ায় ভালো থাকতে দিও... এইটুকুই চাইব।
কুহু চোখের
কোনে আসা জলটা মুছতে মুছতে চলে গেল ঘরে। আর রাহুল এক জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল বেশ কিছুক্ষন। দেওয়াল ঘড়িটা আবার ঢং ঢং করে সময়ের জানান দিল। রাহুল ঘর থেকে বেড়িয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল একরাশ কষ্ট নিয়ে, রাত প্রকৃতির বুক থেকে বিদায় নিচ্ছে এবং ধীরে ধীরে একটা নতুন দিনের সূচনা হচ্ছে। রাহুল জলভরা চোখে চেয়ে আছে দূর আকাশের পানে, ঠান্ডা বাতাস ছুয়ে যাচ্ছে রাহুলের শরীরকে, তবে রাহুলের মনকে ছুতে পারছেনা। কারন রাহুলের মনের মধ্যে তিব্র ঝড় উঠেছে যা.... সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। এই নতুন দিন রাহুলের কাছে নতুন কোনো আনন্দের বার্তা বয়ে আনছে না.... বরং শূন্য করে দিয়ে যাচ্ছে ওর গোটা দুনিয়া!!!! তবে এই পরিস্থিতির জন্য শুধুমাত্র ও.... নিজেই দায়ি।
বেশকিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পর গুটিগুটি পায়ে রাহুল ঘরে ঢুকলো,এবং নিজের ঘুমন্ত ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে স্নেহের পরশ এঁকে দিল, এবং কুহুর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল, এবং মনে মনে বলে উঠল সত্যি আমি তোমাকে ভালো রাখতে পারলাম না... কোনদিন, শুধু অবহেলা করে গেলাম, তোমার ভালোবাসার মর্যদা দিতে পারলাম না। তুমি ভালো থেকে কুহু খুব ভালো থেকো, আমি আর বাঁধা হবনা তোমাদের সুখের জীবনে। আমার বাকি জীবনটা না হয় কষ্টেই ভরা থাক আমার ভুলের শাস্তি হিসেবে। রাহুলের চোখের কোন বেয়ে বইতে লাগল শ্রাবনের বারিধারা, এবং নিজেকে নিজেই ধিক্কার জানাতে লাগল।
সত্যি কিছু কিছু ভুলের ক্ষমা হয় না। যা... জীবনকে পুরো লন্ড ভন্ড করে দেয়। আজ রাহুলের ভুলের জন্য ওদের এই সুখের ঘেলাঘর ভেঙ্গে গেল, যা আর জোড়া লাগা সম্ভব নয় কিছুতেই!!!!
"At some point you have
to realise that some people
can stay in your heart
but not in your life"
