ভালোবাসার অন্যরূপ
ভালোবাসার অন্যরূপ
মানুষের জীবনের সব থেকে সুন্দর সময় - তার ছোটবেলা। অর্থাৎ স্কুল ও কলেজ জীবন। এরপর শুরু হয় জীবনের আসল রূপ দর্শন। উপার্জনের চিন্তা ( সেটা হয়ত সবার থাকে না ) বা নিজের একটা পরিচিতি তৈরী করার ভাবনা, সংসার নিয়ে চিন্তা ইত্যাদি - যাকে বলে সম্পূর্ণ জীবন সংগ্রাম। তখন জীবনটা কেমন করে যেন ক্যারিয়ার - সংসার , এসবের বাইরে বেরোতে পারেনা। অথচ তার কয়েক বছর আগেকার ছাত্রজীবন কত ভালো ছিল - হয়ত শাসনের চাপ ছিল কিন্তু সব কিছু কি ভালো লাগতো। কলেজ জীবনে এসে একটু বড় হবার স্বাদ ও স্বাধীনতা পাওয়া গেল। মনটাও তখন অনেক অনেক সবুজ ও সুন্দর ছিল। মনটা কিরকম একটা কল্পনার জগতে থাকত। এটাই তো ছিল উন্মাদনার, ভালো লাগার, ভালোবাসার সময়। এরকমই একটা সময় কাটিয়ে জীবনযুদ্ধে পদার্পন করতে চলেছে প্রীতি ও অভিনব।
দেখতে দেখতে কলেজের জীবন শেষের পথে, হঠাৎ অভিনব প্রীতিকে বলল, "তোর সাথে আমার একটা জরুরি কথা আছে, দাঁড়া।
“আমি তোকে খুব ভালোবাসি প্রীতি । তোর সাথে সারাজীবন কাটাতে চাই। তোর সব সুখ-দুঃখে আমি তোর পাশে দাঁড়াতে চাই। তুই কি আমার হাতটা ধরে জীবনের বাকি পথটা চলতে পারবি?” কলেজের ফেয়ারওয়েলের দিন অভিনব সবার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে প্রেমের প্রস্তাব দিল প্রীতিকে।
প্রীতি প্রথমে অবাক হয়,তারপর কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর খুব সহজভাবেই বললো, “না রে, এটা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি কোনোদিন বিয়েই যে করবো না।”
প্রীতি আর অভিনবের “কেন?” প্রশ্নটা শোনার জন্যও দাঁড়ায়নি। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে কলেজ থেকে বেড়িয়েই একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। বাড়ি ফিরেই নিজের ঘরে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে প্রীতি।তারপরেই ভেসে ওঠে ওর চোখের সামনে একের পর এক ফেলে আসা অতীতের কালো দিনগুলো।
প্রীতি জন্মের পর থেকেই দেখে এসেছে ওর বাবা-মায়ের মধ্যে সাংসারিক অশান্তি। ওর বাবা-মা সবসময় নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি
করতো। ঝগড়াঝাটি চরমে উঠলে মাঝেমাঝে ওর মা ঘর ছেড়ে চলে যেত, নাহলে ওর বাবা ঘর ছেড়ে চলে যেত। তারপর একসময় শুরু হলো, প্রীতির বাবার অনুপস্থিতিতে বাড়িতে একজন ভদ্রলোকের আসা যাওয়া। সে ছিল প্রীতির মায়ের প্রেমিক। প্রীতির বাবার অনুপস্থিতিতে ভালোই চলছিল প্রীতির মায়ের অবৈধ প্রেম। মায়ের শাসানির জন্য ও বাবাকে কিচ্ছু জানাতে পারেনি।
প্রীতির বয়স যখন প্রায় দশ তখন একদিন একটা ঘটনা ঘটে। রোজকার মত প্রীতির মায়ের প্রেমিক এসেছিল ওদের বাড়িতে। সেই সময় প্রীতি নিজের ঘরে পড়াশোনা করছিল। আর প্রীতির মা রান্নাঘরে কিছু বানাতে ব্যস্ত ছিল। এই সময় ওর মায়ের প্রেমিক ওর ঘরে আসে। “সোনামনা” বলে ওর গায়ে হাত বোলাতে শুরু করে। স্কুলে “ব্যাড টাচ” এর ব্যাপারে শিখিয়েছিল , প্রীতি বুঝে গিয়েছিল যে লোকটা খারাপ উদ্দেশ্যে ওকে স্পর্শ করছে। তাই বেশি বাড়াবাড়ি হতে না দিয়ে প্রীতি ছুটে চলে গিয়েছিল ওর মায়ের কাছে।
“মা, ওই লোকটা ভালোনা। আমাকে ব্যাড টাচ করে।” প্রীতি কাঁদতে কাঁদতে বলোছিল ওর মাকে।
“কি? ব্যাড টাচ?” বলেই প্রীতির মা ওর গালে সপাটে এক চড় মেরেছিলেন।
এই আঘাতে প্রীতি কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গিয়েছিল। বুঝতে পারেনি, এটা কোন মা! একি তার নিজের মা!
প্রীতি ভয় পেয়েছিল, কিন্তু তাও দমে যায়নি। সেদিন আর কোনো ভয় না পেয়ে বাবাকে অফিস থেকে আসার পরে সবটা জানিয়ে ছিল। ফলাফল?
প্রীতির মা আর বাবার মধ্যে তুমুল ঝামেলা বেঁধেছিল। প্রীতির মা ওকে অনেক মারধোরও করেছিল ওর বাবাকে সব বলে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সেদিন ওর ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওর বাবা।
এই ঘটনার পর প্রীতির বাবা নিজের স্ত্রী আর তার প্রেমিকের নামে পুলিশে মামলা দায়ের করেছিল। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। সেই সময়ই সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল যে দুজনে প্রাপ্তবয়স্ক নর নারীর মধ্যেকার পরকীয়া আইনসিদ্ধ, তাই কারোও শাস্তি হবে না।ফলে সেই মামলাও খারিজ হয়ে গিয়েছিল।
অগত্যা, স্ত্রীয়ের চরিত্রহীনতা প্রমাণ করে প্রীতির বাবা ওর মাকে ডিভোর্স দিয়েছিল। তার সাথে মায়ের চরিত্র খারাপ হওয়ায় প্রীতির কাস্টডি পেয়েছিল ওর বাবা। প্রথম প্রথম প্রীতির খুব মন খারাপ করতো ওর মায়ের জন্য। কিন্তু মায়ের প্রতি রাগে, প্রীতি দেখাও করতে চাইতো না কখনো।
প্রীতির বয়স যখন তেরো, তখন ওর বাবা ঠিক করলো যে, সে আবার বিয়ে করবে। একা একা পুরুষ মানুষের পক্ষে নাকি মেয়েকে মানুষ করা কষ্টকর হচ্ছে।
কিছুদিন পরে প্রীতির অমতেই তার বাবার বিয়ে হল এবং বাড়িতে সৎ মা এল। তাকে অবশ্য কখনোই প্রীতি “মা” বলে ডাকেনি। সেই সৎ মা ছিল আরেক জিনিস। তেরো বছরের কিশোরী মেয়েটাকে দিয়েই ওর বাবার অনুপস্থিতিতে সব কাজ করাত । আর যখন প্রীতির বাবা থাকতো সামনে, তখন সে কি আদর!
আসতে আসতে প্রীতির জীবনটা দুর্বিসহ হয়ে উঠছিল। তারপর একদিন, সবকিছু অতিরিক্ত হয়ে যায়। প্রীতির সৎ মামা নিজের দিদির অনুমতিতেই প্রীতিকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল।
কোনোমতে নিজেকে বাঁচিয়ে প্রীতি বাড়ি ছেড়ে সেদিন বেড়িয়ে গিয়েছিল। নাহ! ওইবার প্রীতি আর যায়নি ওর বাবার কাছে ব্যাপারটা জানাতে। কারণ ও জানত যে, এর ফলাফলে গালে চড়ই পড়বে।তাই ভাঙা মন নিয়ে জীবনটা ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল রাস্তায় নিজের ভাগ্যকে খুঁজতে।
ভবঘুরের মতো ঘুরতে ঘুরতে প্রীতি গিয়ে পড়েছিল কয়েকজন কিন্নরের হাতে। তারাই ওকে নিয়ে গিয়ে নিজেদের যথাসাধ্য দিয়ে ওকে মানুষ করেছে। আজও প্রীতি তাদের কাছেই থাকে।
বাবা-মায়ের বৈবাহিক সম্পর্কের অবনতি এবং তাদের ভুল সিদ্ধান্তে প্রীতির যে ক্ষতিটা হয়েছে, তা কোনোদিন ভরাট হবেনা। কিন্তু যারা বৈবাহিক সম্পর্কের ধারেকাছেও ঘেষতে পারেনা, আজ তাদের কাছেই প্রীতি সুখী। তারাই আজ ওর একমাত্র ভরসার স্থল ও ভালোবাসার জায়গা। তাই ও জানতো অভিনবকে নিয়ে ঘর বাঁধার চেষ্টা আবার হয়ত ওর স্বপ্নভঙ্গ করবে ওর অসুস্থ শৈশব । সেজন্য প্রথম থেকেই স্বপ্নটাকে জন্ম না দেওয়াই ভালো। আর ভালোবাসাটুকু সে যতটাই হোক, ওর নিজের একান্ত গোপন সম্পদ হয়ে থাক - এতে সবাই ওরা ভালো থাকবে।
