Ajoy Kumar Basu

Classics

2  

Ajoy Kumar Basu

Classics

বধূবরণ

বধূবরণ

6 mins
802


উৎসবের মানে বোঝো ?

ফিল্মোৎসব ,দুর্গোৎসব , ইলেক্শনে জিতে বিজয়োৎসব আরো কত কি। এইগুলোর মধ্যে তুমি কে ? কেবল মাত্র দর্শক,   বুঝলে ? একটু দূর থেকে দেখছো ,শুনছো আর ভুলে যাচ্ছো ।

যারা আয়োজন করছে ভাবছো তারা নিশ্চই উৎসবের অঙ্গ। ভুল,এক্কেবারে ভুল। তারা আয়োজক মাত্র ,চাঁদা তোলা থেকে শুরু করে বিসর্জন অব্দি খেটেই চলেছে। এইবার নিশ্চই ভাবছো বুড়োটার মাথাটা গ্যাছে। বলতে ইচ্ছে করছে '

‘আর দেরী নয় ,ধর গো তোরা ,বুড়োটাকে খাটে তোল গো; ‘

 নাম দিয়েছো ,আর বুঝছো না, কার উৎসব ? কেন্দ্র বিন্দু - ফিল্ম ,দুগ্গাঠাকুর, ইলেকশন।

একবার ভাবতো তুমিই উৎসবের কেন্দ্র ,কর্তা ,কর্ম ,করণ ,সম্প্রদান ,অপাদান আর অধিকরণ সব কিছু। কেমন হবে ?

এর ওপর হাজার লাখ তুমি-উৎসব যদি এক জায়গায় জড়ো হও তাহলে সেটা হবে উৎসবের উৎসব।

এই উৎসব দেখা সকালের ভাগ্যে নেই। আমার ভাগ্যে একবারই লেখা ছিল। তাই তো তোমাদের মতো নিরুৎসব অভাগাদের জন্যে লিখে রেখে যাচ্ছি যাতে বড়ো বড়ো চোখ মেললে তুমিও দেখতে পাবে।

কারণ ছিল অতি সাধারণ। নতুন বৌ বিশ্ব সংসারে আসছে ,বরণ করতে হবে না ?

যেমন তেমন বৌ নাকি। সঙ্গে আছে তিরিশ কোটি ছেলে মেয়ে। এটা তো তাদেরও উৎসব।

সেই উৎসবের গপ্পো শোনো। আমাদের মতো আশীর ওপরে কজনই বা আছি ; আমাদের কাছেই শুনে রাখো সেই উৎসবের উৎসব-এর একটু একটু টুকরো। 

সালটা ১৯৪৭, জুলাই মাসের মাঝামাঝি। কোলকাতাতে হটাৎ গেল বদলে। দশ মাস ধরে শহরটা ভুগছে। কারুর মনে আশা নেই ,শুধু রাগ ,হিংসে আর সব ছাপিয়ে ভয়। আমিই তো তখন দশ বছরের ,ৰুঝি কতটুকু ;সেই আমিও ভয়টা বুঝতে শিখে গেছি। একদম ভালো লাগতো না। সামনে না দেখে ,এদিক -ওদিক -পেছন দেখে চলতে চলতে চলার আনন্দটা প্রায় হারিয়ে গেছিলো। বড়োদের তো আরো বেশী। মাকে দেখতাম সব সময়ে ভাবনা ,কাল বাজার বসবে তো ? সিল্কের শাড়ির নীচে একটু চাল আর ডাল চাপা ,বাচ্ছাগুলো যাতে না খেয়ে থাকে। বাবা গম্ভীর মানুষ ,কিন্তু তাও কেমন অন্য রকম হয়ে গেছিল ,একটু গোমড়া। একটা বাড়ীতে থাকতাম ছত্রিশটা মানুষ। আমাদের মাপেরই তো এক ডজন। খেলতাম ,ঝগড়া করতাম ,তবু মনে হতো আমরা আমাদের মধ্যে নেই।

এরই মাঝে হাজির হলেন একজন অদ্ভুত লোক। অন্যদের মতো আমরাও গান্ধীবাবা বলতে শুরু করলাম। শুনলাম এই গান্ধীবাবা খুব দুঃখ পেয়েছেন আমাদের মতো ছোটদের জন্যে। তাই খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। আমি মিশনারী ইস্কুলে পড়তাম ,তাই যিশু কৃষ্ণের গল্প জানতাম , তাঁকে যারা মারছিলো তাদের জন্যেই ভগবানের কাছে পুজো করতেন। আর আমাদের গান্ধীবাবা আমাদের আনন্দের কমতি দেখে উপোষ করে থাকলেন ? যেন আমাদের প্রত্যেকের দাদু।

কেন হলো ,কী হোলো জানিনা।সেদিন বাবা ফিরলো অফিস থেকে একটু আগে আগে ,কাকারা আগেই এসেছে। বাবা একগাল হেসে খবরটা দিলেন ,গান্ধীজি অনশন ভেঙেছেন আর সকলের সে কি আনন্দ ! বুঝ লাম না এত আনন্দ কিসের। বাবা আরো জানালেন ,সব দল প্রতিজ্ঞা কোরেছে আর মারামারি ঝগড়া করবে না। শুধু কি তাই ,ঠিক হয়েছে কি ১৫ আগস্ট ইংরেজ রাজত্ব শেষ হবে।

আমাদের মতো ছোটরা সব কিছু বুঝি নি , কিন্তু স্বীকার করতেই হবে যে সকলের খুশি মুখ দেখে আমরাও খুব খুশি হলাম ,কেমন যেন একটা বন্ধ ঘর থেকে বেড়িয়ে খোলা বাতাস শরীর মন জুড়িয়ে দিলো।

 আমার মা পাড়ার সব ছোটদের বন্ধুর মতো। পরদিন পাড়ার সব বন্ধুরা মিলে মায়ের কাছে হাজির।

 মা তখন বোঝালো ঘটনাটা কী। গত প্রায় দুশো বছর ইংরেজদের রাজা কিংবা রাণী অনেক অনেক দেশেরও রাজা কিংবা রাণী হতেন। আমরা,মানে আমাদের মতো লোকেদের এতে কিছু বলবার নিয়ম ছিলোনা।তাই ইংল্যান্ডের রাজার লোকেরা যা বলতো আমরা তাই করতাম। গান্ধীবাবা রাজি হয়েছেন যে ১৫ আগস্ট থেকে আমরাই ঠিক করবো আমাদের রাজা-রাণী কে হবে। এটাকে বলে স্বাধীনতা।

মা দেখায় থামলো না। বললো: এখন থেকে তোমাদের ভালো করে পড়াশুনা করতে হবে ,অনেক খাটতে হবে ,নিজেদের ব্যাপারে নিজেদের ঠিক করতে হবে ,দেশটাকে দারুণ সুন্দর করতে হবে।

 আমাদের সবাইকার মনে কেমন যেন লাগছিলো ,এর আগে এমন কথা শুনিনি।

 কখন যে কাকামনি আমাদের সব কথা শুনছিলো জানিনা ,আমাদের ভীষণ ভালো সবাইকার কাকামনি , সেই কাকামনি একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলো ,

'শোন ,এই যে ১৫ই আগস্ট ,এ টা আর কোনোদিন পাবি না ;ওই দিন থেকে তোরা সবাই পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা মানুষ হোবি। নিজেদের মতে,নিজেদের পথে ,নিজেদের চেষ্টায় এগোতে হবে; মনে রাখিস অনেক লোকে প্রাণটাকেও দিয়েছে তোদের এই দিনটার জন্যে। এ টা তোদের প্রত্যেকের নিজের উৎসব। ভুলিস না যে তোরাই তো দেশ। '

সেই থেকে শুরু হলো তোড়জোড়। ভাবছো গ্রাম থেকে লোকজন এনে পয়সা দিয়ে কাজ ?অরে ,এক্কেবারে নয়। পাবে কোথায় লোকজন ,সবাই তো নিজের উৎসব নিয়ে ব্যস্ত ! আমরা ছোটরা শুরু করলাম প্যারেড ,ব্যান্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ;কত গান শিখলাম। ফ্ল্যাগ লাগানো দড়ির শেকল তৈরী হলো মাইলের পর মাইল। সব বাড়ীর বামুনদিদি ময়দা জ্বাল দিয়ে ছোট টিন ভর্তি আঠা supply করতো ,মা -কাকিরা একটুও আপত্তি করতো না। তারাও তো ব্যস্ত -উৎসবের আগেই বাড়ী ঘর দোর ঝকঝকে করতে হবে তো ! অনেক প্রদীপ লাগবে ,সলতে আর তেল চাই ; সবাইকার জন্যে একটা করে শাঁখ আছে তো ? শাঁখ বাজানো সহজ নয় ,প্রাকটিস কর ,প্রাকটিস। বাবাদের দল অফিস নিয়ে ব্যস্ত ,নতুন করে সাজাতে হচ্ছে। সব দোকানে চুনকাম চলছে ,রঙিন কাগজের ফুল ঝুলছে। কেউ নেই যে উৎসবে কাজ করছে না।

১৪ই আগস্ট। ভাবতেও পারবেনা পরিষ্কার কাকে বলে। আমাদের সরু গলিতে শোয়া যায় এমনি ঝকঝকে। কজন বা জমাদার ,বাড়ীর কর্তারা নেমে পড়েছে পরিষ্কারের কাজে ,আর কি কোথাও জঞ্জাল থাকতে পারে। সকালের প্যারেড ,কালকের জন্যে Dress Rehearsal ,খাঁকি হাফ প্যান্ট ,সাদা শার্টে আমরা সবাই। কোনো ভুল করা চলবে না কেউ বলছে না -আমরা প্রত্যেকে জানি। প্যারেড শেষে ছোলা ভিজানো -আদার সঙ্গে পেলাম এক টুকরো আখের গুড় -পাড়ার মিষ্টির দোকানের হারুকাকু খাওয়ালো ,ওরও তো উৎসব। বসে গেলাম রাস্তায় ;শেকলগুলোকে টাঙিয়ে রাস্তার ছাদ তৈরী করার কাজে। সবাই হাত লাগালো। কলকাতার কোনো গলি থাকবে না ছাদ ছাড়া। দুপুরে খেলাম না খেলাম না ,কোথায় খেলাম মনে নেই। এইটুকু মনে আছে যে কোনো বাড়ীতেই ভাত -ডাল -তরকারি যার ইচ্ছে খেয়েছিলো ,সব বাড়ীর উৎসব তো।

 বিকেলের মধ্যেই উৎসবের স্টেজ তৈরী। বড়ো রাস্তায় একটা উঁচু যজ্ঞের বেদী ,সুন্দর করে লাল -হলদে ফুলে সাজানো। বেদীকে ঘিরে একটু দূরে কটা চেয়ার আর টুল ;প্রতিটাতে রাখা মাটির ভাঁড় -রাত্রে জল আর সরবতের জন্যে - যার যেমন ইচ্ছে খাওয়াবে - কেউ দেখবে না কার হাতের সরবত ,কিসের সরবত -যে খাওয়াচ্ছে আর যে খাচ্ছে দুজনেরই উৎসব।

রাত হলো ,সবাই চুপচাপ। আমাদের বাড়ীতে একটা বাকসোর মতো রেডিও ছিল। সেটাকে সবচেয়ে বড়ো শোবার ঘরে বসানো হয়েছে। তার এক্কেবারে কাছে কটা চেয়ার ,বুঝলাম কানে -কম -শোনা দাদুদের জন্যে। তাদের পেছনে কটা বেঞ্চি ,বাবা -কাকাদের ,তার পেছনে শোবার খাট -বালিশ নেই ,একটা রঙিন ফুলওয়ালা চাদরে ঢাকা। সেটা সব মা -কাকী -জেঠিদের। পাড়ার সবাই আসবে ,সব বাড়ীতে তো রেডিও নেই !

রাতের খাবার খিচুড়ি ;তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করতে হোলো। বামুনদিকে ছাড়তে হবে -আজ তারও উৎসব

রাত সাড়ে এগারোটা। রেডিওর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি HOUSE FULL ,কি করে এতজন বসলো জানিনা। মা ফিসফিস করে বললো বাইরে যেতে আর সকালের মধ্যে ফিরে আসতে। বাড়ীর বাইরে রাত কাটানোর প্রথম স্বাধীনতা।

কলকাতা হটাৎ এক্কেবারে নিঝুম হয়ে গেল। আমরা বন্ধুরা রাস্তায় ,কারুর মুখে কোনো শব্দ নেই। সব গাড়ী থেমে গেছে  , সবাই অপেক্ষা করছে।

রাত ১২টা। কোথায় একটা তোপের আওয়াজ। তারপর কলকাতা পাগল হয়ে গেল। প্রতিটি বাড়ীথেকে শাঁখ আর উলু ,প্রতিটা জাহাজ আর গাড়ী ভেঁপু দিচ্ছে ,চার দিক থেকে গান ভেসে আসছে নানা সুরে ,নানা ভাষায় ;রাস্তার যজ্ঞ বেদী থেকে শুনছি উপনিষদের সংস্কৃত মন্ত্র ,পাশের মজদির সবাইকে ডাকছে। আমি দেখি আমার পা মাটিতে নেই। এ কোল থেকে ওকোলে আমি ভাসছি। সবাই বিজয়ার কোলাকুলি করছে ,আদর করছে। আজ আর কেউই পর নয় ,সবাই উৎসব।

লক্ষ শঙ্খ ধ্বনি , লক্ষ লক্ষ উলু ,হাজার হাজার গাড়ী আর জাহাজের হর্ন ,যজ্ঞ বেদীর শিখা ,আকাশ ভরা ফানুস নানা রঙে ,রাস্তায় সবাই সবাইকে বুকে জাপটে ধরছে - ত্রিশ কোটি মানুষের উৎসব এক সমুদ্র তৈরী`করেছে , আর সকালের আনন্দ তাকে দুধে -আলতার রং দিয়েছে।

নতুন বৌ বিশ্ব সংসারে পা ফেলছে ,তাকে বরণ করে আমরা তুলছি।

হাজার বছরের ইতিহাসে এই প্রথম : সার্বভৌম - স্বাধীন -গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics