Apurba Kr Chakrabarty

Classics

4.5  

Apurba Kr Chakrabarty

Classics

বাঁশ বনের বিভীষিকা

বাঁশ বনের বিভীষিকা

10 mins
412


সেদিন ছিল কৃষ্ণ প্রতিপদ তিথি, শীতের রাত, মেঘমুক্ত আকাশে পূর্ণিমার পরের দিন, তাই চাঁদের ঝলমলে আলো।রাত তখন দুটো। টেবিল ঘরির টিক টিক করা আওয়াজটা নমিতার কানে আজ বড্ড অসহ্য লাগছে। পাশে ছমাসের শিশু কন্যা সন্তান অকাতরে ঘুমাচ্ছে, স্বামী হরিনাথের ঘুম আরও গভীর। 

গ্রাম থেকে দুকোশ দুরে হরিনাথ সড্ডা ইস্কুলের শিক্ষক। কোন যান তো নেইই, আঁকাবাঁকা আল পথে সাইকেল চলে না, হাঁটা ছাড়া বিকল্প নেই। যাতযাতে চার কোশ মানে আট মাইল কম তো নয়। তাই রাতে অগাদে মরার মত ঘুমুলে দোষের কিছু নেই! তারপর এত রূপবতী সুন্দরী বৌকে নিয়ে প্রথম রাতে একটু দুষ্টমীতে তো কিছু সময় কাটবেই !এত বয়সের দোষ ।


নমিতার হঠাৎই ঘুম ভেঙ্গেছে বেশ কিছুক্ষণ, অম্বল গ্যাসে আজ বড় নাজেহাল সে। হয়ত খাবারে কিছু গোলমাল হয়েছিল। কিন্ত এত পেটকামরানোর যন্ত্রনা যে আর সহ্য হয় না। 

সে যুগে গ্রাম বাংলায় বেশীরভাগ সচ্ছল মানুষের বাড়িতেও বাথরুম টয়লেট থাকত না। মাঠ পুকুরেই ভরসা। নমিতা যৌথ সচ্ছল পরিবারের বৌ। বড় মেজ জা অনেকটাই বড় ,সেজো নমিতাকে তারা ছোট বোন কেন মেয়ের মত ভাবে। জায়েদের সাথে বিকালে মাঠে যায়, শুধু প্রাকৃতিক কর্ম নয়! এ যেন বৌ মেয়েদের আড্ডার স্থল । কত সুখের দুখের গল্প, কেচ্ছা কাহিনী, হৈহুল্লোর, রীতি মত যেন বিনোদনের স্থান। বিকালের নির্জনে বড়াল সাঁতড়ার পাড়ে তাদের এই প্রাকৃতিক কাজ ও আনন্দ বিনোদন সঙ্গে অন্যের আড়ালে তাদের সমালোচনাও সাথে সাথেই চলে। পাড়ার অনেক বৌ মেয়ে জমায়েত হয়। এটাই গ্রাম বাংলার সেসময়ের ছিল রীতি বা কালচার , সে যাইহোক। 

কিন্ত সে তো বহু দুর !এত রাতে একা যাওয়া যায় নাকি!বরং খিরকীর উত্তরে ছোটগড়ের পশ্চিম উত্তর পাড়ে বাঁশ বনে গেলেই হল।দিনেই কেউ ওদিকে তেমন যায় না। নোংরা নজরে পরবে না।পরলেও কে জানবে! বাড়ির এত কাছে এই মহান কীর্ত্তি সেই করেছে!


সনাতন চক্রবর্তীর সেজো বৌমা নমিতা। সেজো ছেলে যেমন বাড়ীর প্রথম গ্রাজুয়েট ,গ্রামে মধ্যেও এ অবধি পাঁচ নম্বর।তেমনই গরীবের মেয়ে নমিতাকে সনাতন সেজো বৌ করে আনলেন, সে যুগে গ্রামের মধ্যে সেরা সুন্দরী বৌ। কিন্ত এ বাড়ী পন্ডিতের বাড়ি। সেযুগের নিয়ম রীতিতে বাড়ির খিরকীর দোর থেকে বড়জোর একশো মিটার দুরে এ অপকর্ম! কিন্ত উপায় কী! পেট কুনোনোর জ্বালা যন্ত্রনা যে এখন অসহ্য হয়ে উঠছে! লন্ঠনের আলো নিয়ে নমিতা তাই একাই গেল , কাছেই তো।

,বাঁশ ঝোঁপের আড়ালে সবে বসে একটু বর্জ্য ত্যাগ করে আরাম অনুভব করছে। হঠাৎই বাঁশ বনের উপর থেকে যেন কেউ ধুলো বালি নমিতার উপর ঢেলে দিল। নমিতা চমকে ওঠে, ভয় পায়। পরক্ষণেই এক বিকট শব্দের ধমক ও সঙ্গে বিভৎস কর্কশ আওয়াজে কটু ভর্ৎসনা, কী বলছে নমিতার বোধগম্য নয় । এক দমকা হওয়ায় লন্ঠনের আলো যেন কেউ নিভিয়ে দিল,প্রতি ঘটনা ঘটছে যেন মুহূর্তেই।


নমিতা সাহসী বলিষ্ঠ মেয়ে ,তবু আজ তার ভয়ে পিলে চমকে ওঠে। কান্ডজ্ঞান হারিয়ে অশৌচ শরীরেই দৌড় লাগাল খিরকীর দিকে।মনে হচ্ছিল কেউ যেন তাকে ধাওয়া করছে। খিরকী দরজা পেরিয়ে তার ধপ ধপ শব্দে দৌড়ানোর আওয়াজ শুনে সনাতন পন্ডিত হাঁক দেন "কে ওখানে!" 

নমিতার মনে হচ্ছিল ভয়ে সে মরেই যাবে। পা আর চলছে না থর থর করে কাঁপছিল বাড়ির উঠানে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে।

সনাতনের শেষ রাতে ঘুম হয় না জেগেই কাটান,ঘুমও খুব পাতলা।  ইতিমধ্যেই লন্ঠনের আলো হাতে তিনি এগিয়ে এলেন, নমিতার একবারে কাছে।

থর থর করে নমিতা ভয়ে কাঁপছে । বিস্মিত হতবাক সনাতন বললেন "এত গভীর রাতে একা তুমি কোথায় গেছিলে ? 

নমিতা কোন উত্তর দিতে পরে না । অজানা এক ভয়ে থর থর করে শুধুই কাঁপছিল। 

সনাতন সব বুঝলেন, তন্ত্র সিদ্ধ পন্ডিত তিনি। স্নেহের সুরে আশ্বাস দিলেন " আমি থাকতে তোমার আর কোন ভয় নেই মা! তুমি আমার কাজকর্ম বিষয়ে নিশ্চয় সব জানো। "

নমিতার জানে শ্বশুর মস্ত তন্ত্র সাধক, ভুত প্রেত যাকে সমীহ ভয় করে। তবুও এক অজানা আশঙ্কায় যেন সে কাঁদছিল।


সনাতন বললেন "চলো মা পুকুরে গিয়ে পরিস্কার হয়ে এসো।"

বাধ্য নম্র সেজো মা নমিতা আজ ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানাল। তীব্র ভয়ে আর আশঙ্কায় পুকুরের জলে  নামতেও সে ভরসা পায় না।

সনাতন আরও স্নেহের সুরে আশ্বাস দিয়ে বললেন   " তুমি তো আমার মেয়ে, আমার মা ,এত অবিশ্বাস কেন! চল মা আমি সঙ্গেই যাব।কেউ তোমার অনিষ্ট করতে পারবে না।"


সনাতন খিরকীর দরজা পেড়িয়ে ছোট গড়ের দক্ষিণ দিকে ঘাটে এসে এমন দাঁড়ালেন ,যেন নমিতাকে বাঁশ বন থেকে আড়াল করে। দুরে বাঁশ বন থেকে সমানে রাগে ক্রোধে কোন মানুষের হুমকী তর্জন গর্জন অবিরাম করে চলেছে । বেশ শোনা যাচ্ছে।


নমিতা কিছুই তার মানে অর্থ বুঝতে পারছিল না । নমিতা শ্বশুরের ভরসায় পুকুর ঘাটে নামল। শৌচ ক্রিয়া সম্পন্ন করে পরিস্কার হলে সনাতন নমিতাকে বললেন "মা পুকুরে তিনটে পূর্ণ ডুব দাও।" বিনা বাক্যে নমিতা এই শীতের গভীর রাতে ডুব দিল তিনটেই । আসলে তার বুদ্ধি আজ কাজ করছে না, সনাতনই তার একমাত্র ভরসা। সনাতন তাকে গার্ড করে ওর ঘর অবধি নিয়ে গেলেন। 

বললেন "মা তুমি ঘরে ঢুকে খিল দাও, তার পর ভিজে কাপড় চোপড় ছেড়ে ঘরের এক কোনে দুরে সড়িয়ে রাখবে, শরীরে যেন একটা সুতোও না থাকে, ঠাকুরের তাবিজ ছাড়া । তার পর শুকনো পোষাক পরবে, মাথা ভালো করে মুছবে, লেপ মুড়ি দিয়ে বসে থাকবে,শোবে না, জেগে থাকবে।আর ভুলেও যেন ঐ ভিজে কাপড় চোপড়ে হাত দেবে না। আমি সকালে যা করার করব।"


এতক্ষণ নমিতা যেন প্রান ফিরে পেলো। ঘরে ঢুকে কপাটে খিল দিয়ে শ্বশুরে নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করল। শ্বশুরের প্রতি যে সম্মান শ্রদ্ধা ভালোবাসা ছিল ,আজ যেন একশগুন বেড়ে গেল। স্বামী এতটাই গভীর ঘুমে ছিল, কিছু জানল না। 

হঠাৎই বাইরে একটা তপ্ত বাক্য বিনিময় নমিতার কানে এল। শ্বশুর মশাই যতই শান্ত বিনয়ের সাথে কথা বলুন অন্য জন ততই উগ্র উত্তেজিত ক্রমশ ক্রোধে যেন ফেটে পড়ছে। নমিতার খুব ভয় হচ্ছিল, তার জন্য যদি শ্বশুরের কোন ক্ষতি হয় । নিজেকে জীবনে সে ক্ষমা করতে পারবে না। কিছুক্ষণ পর সব শান্ত হল। 

শিশু কন্যা ঘুম ভেঙ্গে কাঁদলেও নমিতার এদিন খুব ভয় হচ্ছে, তৎক্ষণাৎ বুকের দুধ শিশুর মুখে ভরে তাড়াতাড়ি চুপ করাল।আজ লন্ঠনের আলো পুরো মাত্রায় জ্বালা ছিল। তার যে সবেতেই আজ ভয ভয় করছে। 

শেষে ঘুমন্ত স্বামীকে তুলেই ছাড়ল। হরিনাথ সব শুনে থ। খুব অনুতাপ আর অপরাধ নিয়ে বলল, "তোমায় ঐ বাঁশ বনের গুপ্ত কথা আগেই বলা দরকার ছিল। তাহলে এ ভুল তুমি করতে না। তোমার কোন জা বা ননদ বা ভাসুরঝিরা বা অন্য কেউ একথা বলে নেই সেটাও হয়ত ভয়ে । তবে আমারই ভুল! আজ যদি আমার জীবনে এত বড় সর্বনাশ হয়ে যেত! "বলতে বলতে নমিতা গভীর ভাবে ধরিয়ে ধরে। ছাড়তে আর চায় না।


নমিতা অভিমানী গলায় বলে" তুমি না হয় নতুন বৌ পেতে ,কচি মেয়েটা তো আর জীবনে মা পেতো না। "

বিষন্ন হরিনাথ বলল "তুমি কী আমাকে এতটাই অধম ভাবো! যদি উল্টো হয় তুমি -- "

নমিতা হরিনাথের মুখ চেপে ধরে,আর কথা বলতে দেয় না। "বলে এসব কুকথা থাক !"

হরিনাথ এবার দিব্যি দেয়, বলে "যতই আমি ঘুমোই জীবনে যেন তুমি রাতে একা ঘরের বাইরে যাবেনা। একটু ঘুম নষ্ট হবে তো কী ! এত দরদ ভালোবাসার তোমার দরকার নেই।" এই ভাবেই কখন শেষ রাত কেটে গেল। 

খুব সকাল সকাল সনাতন উঠে পরেন। এদিন যেন আর একটু সকালে।বাড়ির অন্য কেউ তখনও ওঠেনি। সনাতনের ডাকে হরিনাথ কপাট খুলে বের হল,সঙ্গে নমিতা ।

সনাতন বললেন "মা তুমি বিশ্রাম নাও ,রাতে অনেক ধকল গেছে।" নমিতা ঘরে এলে,দরজার কপাট বাইরে থেকে সনাতন টেনে দিলেন।সনাতনের এটা বড় গর্বের পুত্র, খুব ভালোবাসেন, কিন্তু আজ যেন বেশ কড়া। 


বললেন " বাড়ি বা পূর্ব পুরুষদের কিছু কথা কি স্ত্রীকে বলা যায় না! আমি ঠিক সময়ে ওখানে না পোঁছালে যে কী সর্বনাশ হতো বুঝেছিস! তুই তো দেবীর মত এ বৌকে হারাতিস ,আর দুধের শিশুটা তো চিরকালের মত মা হারাত।"

খানিক থেমে রাগতস্বরে সনাতন বললেন"তুই শিক্ষিত! শিক্ষক! না একটা বাঁদর আজ আমার সন্দেহ হচ্ছে। বাড়ির কলঙ্ক স্ত্রীকে বলা দরকার নেই, কিন্ত তাই বলে ঐ বাঁশ বনের বেল গাছটা যে ব্রম্ভ দৈত্যের বাস। যে আমাদেরই পূর্ব পুরুষ, ভীষন বদ মেজাজী, আবার অপরিস্কার একদমই সহ্য করে না তুই জানিস না?"


অপরাধীর মত হরিনাথ চুপ চাপ বাবার সব অপমান সহ্য করছিল, কোন উত্তর তার ছিল না!

সনাতন আহতস্বরে বললেন "সেজো মায়ের তো কোন দোষ নেই। কিন্তু কী কান্ডটা, না জেনে তোর বৌ করেছে জানিস! হেগে দিয়েছে এই বাঁশ তলায়! ভাবতে পারিস কি অনাচার! পেচ্ছাপ দুরে থাক মানুষ থুথু ফেলতে সাহস পায় না। কুকুর বিড়াল ঐ ত্রিসীমানায় যায় না, বক পেঁচা বাঁশ বনে বসলেও দেখেছিস ছোটগড়ের জলের উপর ঝুঁকেপরা বাঁশে বসে মলমুত্র পুকুর জলে করে,আর না হলে বাঁশ বাগানে মরে পরে থাকে।" পরিস্কার করে দি, না হলে ওর আবার বিরক্তি হয় ,যা বাড়ির অমঙ্গল। 


রীতিমত রেগে সনাতন পন্ডিত বললেন "এসব তুই জানিস না! আর সেখানে কিনা হাগা! কি ঝাড়টাই না ব্রম্ভ দৈত্যি দিল আমাকে, কাল রাতে, বৌমা ঘরে ঢোকার পর কী রকম ঝাড়ল জানিস! রাগ কিছুতেই যায় না , চরম অভিশাপ দেবে বলছিল।শেষে কচি ছ মাস শিশুর মা বলে ওকে ক্ষমা করে বলল, আজ যেন দুপুরের মধ্যেই ঐ বাগান পরিস্কার করে শুদ্ধি যজ্ঞ করি। ব্রম্ভ দৈত্যি ওর উপর তুকতাক ধুলো ভষ্ম ফেলে পাগল করতে চেয়েছিল। তন্ত্র বলে জেনেই, রাতেই ওকে ডুব দেওয়া করিয়ে ওর দোষ কাটিয়েছি, ঘরে যে ওর ভিজে কাপড় রয়েছে হাত দিবি না। বাগানের নোংরা সাথে ওটা নদীতে ভাঁসিয়ে দিতে হবে।"


 কিছু যেন ভাবলেন, তারপর সনাতন পন্ডিত বললেন 

"আর হ্যাঁ ,তুই আজ উপবাস থাকবি , তাই সকালেই তোকে বলতে এলাম। যজ্ঞে তুই আমার সাথে বসবি।তিনটের মধ্যেই যজ্ঞ শেষ হয়ে যাবে, তারপর খাবি, আর হ্যাঁ এসব কথা বৌমাকে বলিস না, ছোট মেয়ে ভয় পাবে। তবে ঐ বাঁশ বনে ত্রিসীমনায় জীবনে যেন না যায় বলে দিবি ।তোর শিবু কাকার কথা নিশ্চয় মনে আছে! ঐ ব্রম্ভ দৈত্যির কোপে কী হাল হয়েছে। "


শিবু ছিল সনাতনের ছোট ভাই ।একটা বয়সে ইশ্বরে ভুত প্রেত ব্রম্ভ দৈত্যে আস্থাছিল না। একদিন দুপুরে নির্জনে একা ঐ বাঁশ বনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঐ বেল তলায় প্রচ্ছাব করে। বলে "কৈ ব্রম্ভ দৈত্যি কী করবে আমায়! " ক্রোধে গর্জন করতে করতে এক দীর্ঘ দেহী ,গৌর বর্ন, মাথা নাড়া, চোখ রাগে লাল, গেরুয়া বসনে বেল গাছ থেকে ব্রম্ভ দৈত্য নেমে আসতে দেখে শিবু "বাবাগো!" বলে চিৎকারে খিরকীর দিকে ছুটতে থাকে।তখন তার কত বয়স হবে! একবছর পৈতা হয়েছে, বছর পনের হবে। গ্রীষ্মের দুপুরে বৈশাখের তীব্র দাবাদহে এক রুক্ষ আবহাওয়া, নির্জন থমথমে পরিবেশ।সনাতন তখন তন্ত্র সাধনায় সিদ্ধ হোন নি।তিনি দৌড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে দেখেন এক ব্রম্ভ দৈত্য । শিবুর উপর তীব্র ক্রোধ বর্ষন করছেন, শিবু অসহায়ের মত ভয়ে থর থর কাঁপছিল। ব্রম্ভ দৈত্য কিছু ধুলো বালি ও ভষ্মের মত শিবুর উপর ছুড়ে দিলেন।ক্রোধে বললেন"তুই ব্রাহ্মণ, আমারই বংশের ছেলে, তাই প্রানে মারলাম না।তবে তোর কি হাল হয় দেখবি! ব্রাহ্মণ কুলের ছেলে হয়ে নাস্তিক!তোদের ঐ কী যেন মাষ্টার এই সব কুবিদ্যা শেখাচ্ছে! ওকে একবার পেলে কী ব্রম্ভ দৈত্যের ক্ষমতা বুঝিয়ে দেবো। "

সনাতন ঘর থেকেই দেখছিল সবে তখন কত বয়স! বছর কুড়ি একুশ ,মাস ছয়ের সবে বিবাহিত, স্ত্রী এর মধ্যেই গর্ভবতী।সে ঘরে ঘুমোচ্ছিল। ব্রম্ভ দৈত্য হঠাৎই অদৃশ্য হলে সনাতন ছুটে ভায়ের কাছে এলেন।শিবুর সারা শরীর ধুলোবালি ভষ্ম, আজ যেটা তন্ত্র সিদ্ধ সনাতন নমিতার শরীরে মাথায় দেখেছিলেন। সেদিন শিবু ভয়ে কাঁপছিল।কেমন উদভ্রান্ত ,চোখমুখ লাল বিড় বিড় করে মুখে এ কী বলছে! গায়েত্রী মন্ত্র এই অসময় ! সনাতন ভয় পেয়ে বাবা মা বাড়ির সবাইকে চিৎকার চেঁচামেচি করে গ্রীষ্মের নির্জন দুপুরে ভাতঘুম থেকে তুললেন। দুচারটে কাক যেন উদ্ভ্রান্ত, কা কা চিৎকারে বাড়ির এচাল ওচাল উড়ে বেরাচ্ছে।ওরাও যেন ভয়ার্ত্ত বিভ্রান্ত, ওরাও কি ব্রম্ভ দৈত্যকে দেখেছ! সনাতনের তাই মনে হয়েছিল। 

বাড়ির সবাই ভাতঘুম থেকে উঠে জমায়েত হল।শিবুর গায়েত্রী মন্ত্র আর থামেই না। শিবুর মা তার গা হাত মাথার ধুলো ঝেড়ে দিলেন, তিনি অজানা আশঙ্কায় কান্নাকাটি শুরু করলেন। কিন্ত শিবুর ভাবান্তর নেই । সে দশম শ্রেণির গ্রামের বিদ্যালয়ে ছাত্র ছিল, ক্লাসে প্রথম হতো। এক উঠতি শিক্ষক তার পৈতার পর থেকেই তার মগোজ ধোলাই শুরু করে। নাস্তিকতার শিক্ষা দেয়।

শিবুর মনে সংশয় হতে থাকে।ব্রাহ্মণ বাড়ি আবার গৃহে প্রতিষ্ঠিত দীর্ঘদিনের শিব ,চামুন্ডার কালীর মন্দির। তাই বাড়িতে এই নাস্তিকতা দেখানোর সাহস পেতো না। সকল সন্ধ্যে গায়েত্রী মন্ত্র জপ করত।

আজ কী মতিভ্রমে বাড়ির সবার অলক্ষ্যে এই অনাচার করল। এ বাড়ীই নয়! এই এলাকার লোক প্রবাদ বাঁশ বনের বেল গাছে ব্রম্ভ দৈত্যের বাস।কেউ কেউ নির্জন গভীর চাঁদনী রাতে ও ঠিক দুপুরে দীর্ঘদেহী গৌর বর্ন মাথা নাড়া গেরুয়া বসনে,ব্রম্ভ দৈত্যকে বেল গাছ থেকে উঠতে বা নামতে দেখেছে। ভয়ে তাই ঐ বাঁশ বনের ত্রিসীমানায় কেউ যায় না। ব্রম্ভ দৈত্য অকারনে কারও অনিষ্ট করে না।

শিবুর এক কাকা বহু আগেই সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগী হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্ত তিনি দর্শন ও তন্ত্র সিদ্ধ হয়ে সংসার বিরাগী হোন ।তখন বয়স পঁচিশ কি ছাব্বিশ। কিন্ত শিবু মেধাবী ছাত্র থাকলে কী হবে দিন দিন কেমন পাগলাটে হচ্ছিল।পড়াশোনা ছেড়ে বাড়িতে না জানিয়েই এগ্রাম ওগ্রাম দেব দেবীর মন্দিরে হাজির হত।বাড়ির মানুষ বুঝিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে আন্তো।হঠাৎই একদিন কোথায় নিখোঁজ হল আর বাড়ি ফেরে নেই।


সনাতন তন্ত্র সাধনা শিক্ষার সময় জেনেছিলেন, ব্রম্ভ দৈত্যের এই রূপ ক্রোধে ছুড়ে দেওয়া ধুলো ভষ্ম যদি কারও উপর নিক্ষেপ করে।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিন বার জলে ডুবদিয়ে শুদ্ধ হতে হবে,সঙ্গে কিছু তন্ত্র মন্ত্র। তিনি তার পরবর্তী জীবনে তন্ত্রসিদ্ধ হলে এই তন্ত্র মন্ত্রও জেনেছিলেন। ঐ অপয়া সকল বস্ত্রসহ জল থেকে না মুছে ভিজে অবস্থায় ভিজে পোষাকসহ উঠে আসতে হবে।আর ঐ ভিজে পোষাক সম্পূর্ণ শরীর থেকে দুরে ছুড়ে ফেলে সম্পুর্ন নগ্ন হয়ে অন্য বস্ত্র পরিধান করতে হবে। ঐ অভিশপ্ত পোষাক, কোন মানুষ যিনি এ সব পোষাক অপবিত্র অশুদ্ধ জানে না তাকে দিয়ে নদীতে ভাঁসিয়ে দিলেই তবে তার সব বিপদ দুর সম্ভব। 


সনাতন পন্ডিত মুখ ঘুরিয়ে হাঁটা দিতে দিতে বললেন "যাই দেখি হারু ডোমকে ডেকে বাঁশ বন আর বেল গাছ তলাটা পরিস্কার করাই।ওখানেই যজ্ঞি হবে।ভিজে কাপড় এ ঘর থেকে ঐ নিয়ে যাবে।আর যজ্ঞের জিনিস গুলো রবিকে ফদ্দ করে আনতে বলি। "


সনাতন চলে গেলে হরিনাথ ঘরে দরজা ঠেলতেই দেখে নমিতা দরজায় কপাটে কান লাগিয়ে সবকথা শুনেছে। হরিনাথ বলল" এটা তুমি কি ঠিক করলে!  বাবা তো তোমাকে এসব না শোনার জন্য বলেছিলেন। "

রাগত নমিতা বলল" আমি বাচ্চা নয়, আর তুমি তো আর্দ্ধেক কথা বলতেই ভুলে যাও। তাই তোমার বাবার কথাগুলো আমার শোনা খুব দরকার। কি করে যে ছেলেদের পড়াও কে জানে। মাথা তো নয় ঢেঁকি।"

হরিনাথ চুপ করে গেল। নিজে আজ বড় অপরাধী মনে হচ্ছিল। 

নমিতাও যজ্ঞের জন্য উপোস করেছিল, বেলা তখন দশটা সনাতন শুনে বললেন "তোমার কচি বাচ্চা, তাছাড়া কাল রাতে অনেক ঝক্কি গেছে উপোস না করে হালকা খাও। আর উপোস তো হরিনাথ করছে তাতেই হবে।"

নমিতা তাই শিরোধার্ষ করল। যজ্ঞের পর সনাতন কে প্রফুল্ল দেখাচ্ছিল, নমিতাকে ডেকে বললেন "ব্রম্ভ দৈত্যি বলল তোমার কপাল ভালো, পাকাচুলে সিঁদুর নিয়েই তোমার ইহোকাল সাঙ্গ হবে।তার মানে তুমিও যেমন দীর্ঘজীবি হবে তোমার বরও ।" 

তার বরটি যে উনার আদরের সন্তান, তাই পিতার তো আনন্দ হবেই। 

সনাতন ভুত পেত্নীর বিশারদ হলেও অভ্রান্ত ভবিষ্যত দ্রষ্টা ছিলেন না । সনাতন মারা গেছেন ছয়ের দশকে। কিন্ত তাকে বলা ব্রম্ভ দৈত্যের কথা হবাহূ মিলে গেছে। নমিতা উনআশি বছরে সত্যিই ষোলাআনা পাকা চুল নিয়ে সিঁদুর নিয়ে যখন তার শব চিতায় উঠল, তখন তার স্বামী হরিনাথ প্রায় ছিয়াশি বছরে জীবিত ছিলেন। 


(কাহিনীটি আংশিক সত্য, আমার মায়ের কাছে শোনা , ঘটনা কাল উনিশশো পঞ্চাশ বাহান্ন সালের )



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics