অ্যান্টেনা
অ্যান্টেনা


ভাঙাচুরা আছে নাকি গো দিদি...? ভাঙাচুরা....
একটি লোক রাস্তা দিয়ে চিৎকার করতে করতে যাচ্ছিলো।
হঠাৎ ঘর থেকে মিনাক্ষী বেড়িয়ে বলে ওঠে,
-হ্যাঁ, আছে দাদা। একবার ভেতরে আসুন।
-বাড়িতে আবার ভাঙাচুরা আছে নাকি বৌমা?
বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন প্রানতোষ বাবু। তিনি অনেকটা অবাক প্রশ্ন হয়েই প্রশ্ন করলেন।
-না বাবা, তেমন কিছু নেই, ওই চিঙ্কুর বই খাতা, কিছু পুরানো খবরের কাগজ, কয়েকটা পুরানো ছাতার ডাটি এইসবই।
-ওহ আচ্ছা,
আবার খবরের কাগজ পড়ায় মন দিলেন প্রাণতোষ বাবু।
মীনাক্ষীও চলে যায় ভেতরে, কিছুক্ষণ পর বাড়ির উঠোনে একগাদা কাগজ পত্র যাবতীয় ভাঙাচুরা জিনিস এনে জমা করে সে।
প্রাণতোষ বাবুও দেখে প্রথমটায় অবাক হয়ে যান, যে আজকালকার মেয়ে হয়েও কোন কিছু ফেলে দেয়নি, সব জমিয়ে রেখেছে।
মনে মনে মীনাক্ষীর প্রশংসা করে ওঠে।
-বাহ, বেশ লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে তো।
আবার খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে নেন।
-আচ্ছা খবরের কাগজ আর বই পত্র মিলে কত হোল?
-এইতো প্রায় দুশো টাকা হবে দিদি।
-আর এই যে ছাতার ডাটি আর সব লোহার টুকরো গুলো।
-এগুলো নিয়ে প্রায় তিনশো টাকা।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
লোকটি মীনাক্ষীকে হিসেব করে টাকা দিতেই,
মীনাক্ষী বলে ওঠে,
-আচ্ছা দাদা, আপনি অ্যালুমিনিয়াম নেন না?
-অ্যালুমিনিয়াম.....? না দিদি
-আরে দেখুন না, কিছু একটা দাম দিয়ে দেবেন।
-অ্যালুমিনিয়ামের কি আছে....?
-দাড়ান আনছি।
বলেই মীনাক্ষী ভেতরে চলে যায়।
আর কিছুক্ষন পর একটি পুরোনো দিনের অ্যান্টেনা হাতে করে নিয়ে আসে।
-দেখুন তো এটার কত দাম হয়।
-না দিদি, আমি আপনাকে এটার বেশী দাম দিতে পারবো না।
-কেনো...? আরে নিন না বাড়িতেই পড়ে আছে খামোখা জঞ্জাল।
-না দিদি,
সেই লোকটির আর মীনাক্ষীর বার্তালাপের মধ্যে অ্যান্টেনা কথাটি প্রাণতোষ বাবুর কান পর্যন্ত পৌছে যায়।
তিনি এবার খবর কাগজ থেকে মুখ তুলে উঠোনের দিকে তাকালেন।
দেখলেন একখানা অ্যান্টেনা মীনাক্ষী জোড় করে সেই ফেরিওয়ালার কাছে গছিয়ে দিতে চাইছেন।
শেষমেশ সেই লোকটি রাজি হয় আর দাম স্বরূপ কুড়ি টাকা দিয়ে যায়।
মীনাক্ষীও বেশ হাসিমুখে টাকা গুলো গুনতে গুনতে ঘরে ঢুকে যায়।
কিন্তু কেন জানি না প্রাণতোষ বাবুর বুক টা হঠাৎ মোচড় দিয়ে ওঠে।
কি যেন তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে বলে তার মনে হতে লাগলো।
প্রাণতোষ বাবু ঠাহর করতে পারলেন,
-হ্যাঁ, এমন অনুভব হওয়ার কারণ তো আছে বটেই। সেই অ্যান্টেনা, ফেরিওয়ালাটা অ্যান্টেনা টা নিয়ে যাওয়ার সময় বোধহয় অ্যান্টেনা টারও এমন অনুভুতি নিশ্চই হয়েছে। কারণ এই অ্যান্টেনার সাথে প্রাণতোষ বাবুর যে এক গভীর সম্পর্ক, স্মৃতি আবেগ সবটাই।
কিন্তু আজ অ্যান্টেনাটা নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি আর একটা কথাও বলতে পারলেন না, কারণ আজ যে সেটা মূল্যহীন অকেজো। তার স্মৃতির এই জিনিসটার সাথে আর কোনদিন দেখা হবে না ভেবেই চোখটা ছলছল করে ওঠে।
-বাবা, এই নিন চা।
প্রাণতোষ বাবু কোন উত্তর করেননা, শুধু সেই তার স্মৃতির জিনিস অ্যান্টেনা টা নিয়ে যাওয়ার সময় ফেরিওয়ালার চলে যাওয়ার পথের দিকেই আনমনে তাকিয়ে আছেন।
-বাবা..?
একটু জোড়েই ডেকে ওঠে মীনাক্ষী।
এবারে সম্বিত ফিরে পান প্রাণতোষ বাবু।
এরই মধ্যে কখন মীনাক্ষী চা করে নিয়ে এসে তার সামনে হাজির হয়েছে বুঝতেই পারেননি।
-কি হয়েছে বাবা...? কি এতো ভাবছেন...?
-না, কিছু না।
-কিছু তো একটা হয়েছে। শরীর খারাপ লাগছে কি?
-না না, আমি ঠিক আছি।
-মিথ্যে কথা, বলুন না বাবা কি হয়েছে।
-আসলে ছোটবেলার একটি স্মৃতির কথা মনে পড়ে গেলো হঠাৎ তাই।
-ছোটবেলার কথা...? বলুন না কি মনে পড়লো।
-তেমন কিছু নয় বৌমা। তখন কার কথা সব....
-আরে বলুনই না, হঠাৎ করে আপনার কি এমন মনে পড়ে গেলো।
প্রাণতোষ বাবু এবারে বলতে বাধ্য হলেন, একরকম মীনাক্ষীর জোড় করাতেই।
-জানো বৌমা, এখনকার দিনে যেমন সবার ঘরে ঘরে টিভি আছে আমাদের সময়ে কিন্তু এমনটা ছিলো না।
আর কখনও এমন দিন আসবে সেটাও কল্পনা করিনি।
আমাদের গাঁয়ে ওই একজনের বাড়িতেই টিভি ছিলো। সব্বাই তখন তাদের বাড়িতে গিয়েই ভিড় জমাতাম। ওই একটাই চ্যানেল তখন সবার সে কি উৎসাহ টিভি দেখার। বাড়ির মহিলারা তাড়াতাড়ি কাজ কর্ম সেড়ে নিতো আমরাও তাড়াতাড়ি বাড়ির পড়াশোনা শেষ করে চলে যেতাম টিভি দেখতে।
আর তখন টিভি দেখার জন্য তো এখনকার মত ডিশ বা কেবল ছিলো না। ওই এক ছিল অ্যান্টেনা। সেটাই ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে একবার বাংলাদেশ আর একবার ইণ্ডিয়া এভাবেই দেখতাম।
আনমনেই হেসে ওঠেন, প্রাণতোষ বাবু।
এসবের মধ্যেও সবথেকে বিরক্তিকর ব্যপার কি ছিলো জানো বৌমা,
-কি ছিলো...?
টিভি দেখতে দেখতে হঠাৎই যদি ওই ঝিরঝির করতো তখন কেউ কে বাইরে পাঠাতো ওই অ্যান্টেনাটা ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে ঠিক করার জন্য।
আর ঘরের মধ্যে টিভি দেখছে এমন সব থেকে ছোট যে থাকবে তাকেই বাইরে পাঠাবে।
-আর নিশ্চই আপনিই সব থেকে ছোট ছিলেন,
বলেই হেসে ওঠে মীনাক্ষী।
-একদম তাই। তাও অনেক সংঘর্ষ করে টিভি দেখতে হোত তখন।
বাবা মায়ের কথা অনুযায়ী এটা কাজ সেটা কাজ সব করতাম টিভি দেখবো বলে।
- হুম এটার সাথে কিন্তু আমিও একটু পরিচিত বটে, তবে তখন আমি খুবই ছোট।
-আর সব থেকে যেটা খারাপ লেগেছিল তখন, যার বাড়িতে টিভি দেখতে যেতাম তারা যখন নানা বাহানা করে টিভি বন্ধ করে দিতো। ওদের খুশি করার জন্য তো আমি ওদের মাঝে মাঝে অনেক কাজও করে দিতাম। কিন্তু তবুও টিভি দেখতে গেলেই ওরা বিরক্ত হোত।
বাবা তখন বুঝতে পারলেন আমাদের কষ্টের কথা।
তখন তিনি বললেন, ঠিক আছে এবারে পরীক্ষায় ভালো ফল করো টিভি কিনে আনবো।সেবার অনেক ভালো করে পড়লাম, সারাদিন রাত খাটলাম পরীক্ষায় ভালো ফল করলাম, বাবা টিভি কিনে আনলেন। ওই সেই সাদা কালো পিকচার টিভি।
-বাব্বা দারুণ তো, তখন নিশ্চই খুব আনন্দ হয়েছিল আপনার...?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন প্রাণতোষ বাবু।
-প্রথমটায় আনন্দ তো হয়েছিল বটে,কিন্তু....
-কিন্তু কি....?
-কিন্তু, অ্যান্টেনা ছাড়া টিভি তো পরিষ্কার দেখা যায় না।
বাবা টিভি কিনে দিলেও অ্যান্টেনা আর কিনতে পারছিলেন না।
আমার মন তো ভার ছিলোই সাথে সাথে আমার বোনেরও মন খারাপ হতে গেলো।
তখন আমার মা কে, গিয়ে বললাম মা এবার পূজোয় আমার নতুন জামা লাগবে না তুমি একটা অ্যান্টেনা কিনে দাও না।
আমার ছোট মুখে ওমন কথা শুনে মা মৃদু হেসেছিল।
পড়ে মা আমাদের জন্য উপহার স্বরূপ অ্যান্টেনা কিনে দিয়েছিল। না, পূজোয় নতুন জামাও দিয়েছিল। শুধু মা আর বাবা সেবার পূজোয় কিচ্ছু নেয়নি।
আর তখন আমাদের ভাই বোন দের মাঝে মাঝেই ঝগড়া হোত, অ্যান্টেনা ঘোড়ানো নিয়ে।
হায় রে... অ্যান্টেনা
-সত্যিই তখন এই অ্যান্টেনার কি মূল্য ছিল।
-হ্যাঁ, আর এই অ্যান্টেনাটাই ছিল আমার মায়ের দেওয়া প্রথম ও শেষ উপহার।
কারণ তার পরের বছরেই মা মারা যান।
-এই অ্যান্টেনা দিয়েই টিভি দেখেছি। একটা সময় কত্ত কদর ছিল এর, তারপর তো ঘরে ঘরে টিভি আর অ্যান্টেনা হয়ে গেলো।
আর এখন তো কলর টিভি, ডিশ, ওয়াল টিভি, কত্ত কি। আর এই অ্যান্টেনার এখন কোন মূল্যই নেই, শুধুই অকেজো বস্তু।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন প্রাণতোষ বাবু।
যাই হোক এই অ্যান্টেনার সাথে আমার মা বাবা বোনের স্মৃতি, শৈশব, আবেগ সব কিছুই। সে এক সত্যি সুন্দর মূহুর্ত ছিল।
তুমি যেখানে তুলসী গাছটা রেখেছো ঠিক সেখানেই ছিলো আমাদের অ্যান্টেনা টা আর তার পাশেই আমাদের ঘর ছিল যেখানে এখন তুমি ফুলের বাগান করেছো।
-ওহ তাই বুঝি, সেটা তবে অনেক দিন আগের কথা।
-হ্যাঁ, চিন্ময়ের পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত ওখানেই ঘর ছিলো। পরে এদিকে নতুন ঘর তুলেছি।
একি বৌমা তোমার আমার সাথে স্মৃতি চারণ করলে হবে। কাজ নেই...?
-হ্যাঁ বাবা যাচ্ছি
পরদিন সকালে,
প্রতিদিনের মত অভ্যাসবশত সকালে স্নান করে তুলসীতলায় প্রণাম করতে গিয়ে প্রাণতোষ বাবু তুলসীগাছের পাশে একটি বাশের নতুন খুটি পোতা দেখে অবাক হয়ে যান,
উপরের দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে যান।
অ্যান্টেনা লাগানো। আর সেটাই যেটা কাল ভাঙাচুরার কাছে মীণাক্ষী বিক্রি করে দিয়েছিল।
-বৌমা....বৌমা
-হ্যাঁ, বাবা, ডাকছেন।
- অ্যান্টেনাটা এভাবে....এখানে....
-এই অ্যান্টেনার সাথে আপনার অনেক আবেগ স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কাল আমি কিছু না ভেবেই বিক্রি করে দিয়েছিলাম।
-ঠিকই তো করেছো, এই অ্যান্টেনার এখন তো কোন মূল্যই নেই।
-না বাবা, ঠিক করিনি।
আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা না করেই অ্যান্টেনাটা বিক্রি করে দিয়ে ঠিক করিনি।
আমি তো আপনাকে আপনার শৈশব ফিরিয়ে দিতে পারবো না আর তা সম্ভবও নয়। কিন্তু আপনাকে যদি একটু আনন্দ দিতে পারি তবেই সেটা আমার কাছে অনেক।
-তাই বলে এভাবে এখনকার দিনে অ্যান্টেনা লাগালে লোকে তো হাসবে।
-হাসুক, সেটাই তো চাই।
এই অ্যান্টেনা দেখলে সবারই আপনার মত পুরোনো স্মৃতি মনে পড়বে। স্মরণীয় আবেগ জড়ানো মূহুর্ত গুলি আবার যদি চোখের সামনে ভেসে ওঠে তবে এর থেকে আনন্দের কি আছে।
-কিন্তু বৌমা তুমি তো এটা....
-হ্যাঁ বিক্রি করে দিয়েছিলাম, কিন্তু কাল রাতেই আবার আপনার ছেলেকে সেই দোকানে গিয়ে আনিয়ে নিয়ে নিয়েছি আর বলেছি ঠিক এখানেই লাগিয়ে দিতে...
-দেখুন তো ঠিক জায়গায় লাগানো হয়েছে কিনা..
প্রাণতোষ বাবুর আবেগে চোখ ছল ছল করে ওঠে,
-বাবা মায়ের যখন বয়স হয়ে যায় কাজে অকেজো হয়ে যায়, তখন কি তাদের আমরা ফেলে দেই....?
তাহলে তাদের স্মৃতির জিনিস আবেগের জিনিস ফেলে দেবো কেনো, সেটাই তো তাদের আনন্দ দেবে তাই না বাবা...?
প্রাণতোষ বাবু কিছু বলতে পারেননা শুধুই চোখটা ছলছল করে ওঠে।
সত্যিই এও এক স্মরণীয় মূহুর্ত কটা বৌমা তার শ্বশুরের আনন্দের, স্মৃতির মূহুর্তের কথা চিন্তা করে।
আজ অকেজো মূল্যহীন পুরোনো অর্ধভগ্ন অ্যান্টেনা টাকে ষাট বছর আগে যেখানে লাগানো ছিল সেখানেই নতুন করে দেখতে পেয়ে সত্যিই মন টা যেন ছুট্টে কোথায় চলে গিয়েছিল প্রাণতোষ বাবুর।
এ যেন সত্যিই এক স্মরণীয় মূহুর্ত।