অত্যাচার ।
অত্যাচার ।
খুনটা যে অর্কদীপ করেছে এটা আমরা সবাই নিশ্চিতরূপে বলতে পারিনা। আসলে ওর মত শান্ত, সুশীল, প্রাণোচ্ছল, পরোপকারী ছেলের পক্ষে একাজ করা যে সম্ভব,..... মন আমাদের কারোরই সায় দেয় না। মোনালিসা সেন, অর্কদীপের প্রেমিকা। প্রায় বছর খানেকের তাদের সম্পর্ক। গতকাল সন্ধ্যের দিকে কলেজের পশ্চিমদিকে পুকুরে মোনালিসার মৃতদেহ ভাসতে দেখা গেছে। কলেজের অনেকেই তাদের একসঙ্গে ও ধারে যেতে দেখেছে। ওধারটা একটু বেশীই নির্জন। বছর পাঁচেক আগে কলেজের এক ছাত্রী প্রনোয়ঘটিত কারণে ঐ পুকুরের পাশের শিরীষ গাছে গলায় ওড়না জড়িয়ে আত্মহত্যা করে। এনিয়ে জল ঘোলাও কম হয়নি। এর পর থেকে সচরাচর কেউ ওদিকে মাড়াত না। মুখে মুখে প্রচার হয়ে যায় যে কলেজের ওই পশ্চিম দিকটায় নাকি গন্ডগোল আছে। জায়গাটা ভাল নয়। ওদের ওদিকে যাওয়ার কথা নয়। একমাত্র সিনিয়র দাদা দিদিদেরই ওদিকে যাওয়ার অলিখিত একটি অধিকার রয়েছে।
এখন রাত সাড়ে আটটা। অর্কদীপ থানায় বেঞ্চে বসে আছে। অনেকটা ভাবলেশহীন। মাঝে মধ্যে ডুকরে কেঁদেও উঠছে। সে কান্না কি নিতান্তই তার প্রিয়তমা মোনালিসার জন্য না নিজের প্রতি পাঁপবোধের জন্য, বোঝা মুশকিল। এক প্রস্থ জেরা করা হয়ে গেছে ওকে। কলেজের প্রিন্সিপাল হরমোহন বাবু, আমাদের অর্থাৎ অর্কদীপের ক্লাসের বন্ধু বান্ধবদের থেকে খবর নিয়েও খুনের কারণ সম্পর্কে এখনো কোনরূপ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। তবে মোনালিসা সেন আত্মহত্যা করেনি, জল থেকে দেহ তোলার সময় গলায় বসে থাকা আঙুলের চিহ্ন তখনও স্পষ্ট ছিল। যদিও মৃত্যুর প্রকৃত কারণ আগামীকাল দুপুরের পর ময়নাতদন্তের রিপোর্টে পাওয়া যাবে।
ইতিমধ্যে অর্কদীপের বাবা সত্যব্রত সান্যাল গাড়ী নিয়ে থানায় প্রবেশ করলেন। সাথে একজন নামকরা উকিল আর অর্কদীপ যে স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছিল সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ওর মা গত হয়েছে বছর পাঁচেক আগে। বাবাকে দেখে অর্কদীপ কান্নায় ভেঙে পরে। বাবাকেও সেই একই কথা বলে, কিভাবে মোনালিসা মারা গেল সে সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। তবে এটা ও স্বীকার করেছে কলেজের পুকুরঘাটে শেষ ওর সাথে কথা হয়েছে। এর বেশি আর ওর নাকি কিছুই মনে পড়ছে না। এমন হাস্যকর কথা শুনে থানার ওসি কানাই লাল মণ্ডল ভয়ানক চোটে গেলেন। বাজখাই গলায় বলে উঠলেন……
---পেছনে এই মোটা রুলের কয়েক ঘা পড়লেই সব সুড় সুড় করে মনে পরে যাবে।
কথাটা শুনেই অর্কদীপ যেন কেমন হয়ে গেল। একটা অদ্ভুত আক্রোশ চোখে ওসি বাবুর দিকে চেয়ে রইল। এতে আমরাও খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম। এই অর্কদীপ যেন আমাদের অচেনা।
সত্যব্রত বাবু ছেলেকে জাপটে ধরে বসালেন। ও একটু শান্ত হতেই ওসি কানাই বাবুকে কিছু একটা বললেন। তিনি অর্কদীপ বাদে আমাদের নিয়ে তার পাশের চেম্বারে বসলেন। সত্যব্রতবাবু ছেলের সম্পর্কে যে সমস্ত কথা বললেন তা শুনে আমরাও অবাক হয়ে গেলাম।
অর্কদীপের মা ছিলেন মানসিক ভাবে অসুস্থ ভয়ানক কড়া স্বভাবের মহিলা। ছেলের সামান্য ভুলে কঠিন শাস্তি দিতেন। তার চিহ্ন অর্কদীপ আজ শরীর ও মনে বিঁধে নিয়ে বেড়ায়। ওর সমস্ত শৈশব ও কৈশর কেটেছে ভয়ে ভয়ে। মায়ের স্নেহ যে কি ও জানে না। অকথ্য মানসিক ও শারীরিক অত্যাচারের ফলস্বরূপ আজ অর্কদীপ স্প্লিট পার্সোনালিটি বা দৈতচরিত্র রোগের শিকার। মা মারা যাওয়ার দুবছর আগেও তার প্রতি কয়েকবার হিংস্র ভাবে আক্রমণ করেছিল। বাধ্য হয়ে সত্যব্রত বাবু তার অসুস্থ স্ত্রী কে কলকাতার এর বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসেন। তবে লক্ষ্যনীয় বিষয় এই যে, সেই সময়কার কোন কথাই তার মনে থাকে না। তার যে চিকিৎসা চলছে সে সংক্রান্ত কাগজপত্র তিনি ওসি বাবুকে দেখালেন। এছাড়া ওর স্কুলের প্রধান শিক্ষকও দুয়েকটা ঘটনার কথা উল্লেখ করলেন যেখানে ক্লাসের মধ্যে অন্য সহপাঠীকে বকাবকি বা শাস্তি দেওয়ার সময় কখন কখন অর্কদীপ অসুস্থ হয়ে পড়ত বা হিংস্র ভাবে ওই শিক্ষক বা শিক্ষিকার উপর আক্রমণ করে বসত। তবে মা মারা যাওয়ার পর পুরোপুরি না হলেও অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনযাপন করছিল।
সমস্ত ঘটনা শোনার পর ও তার চিকিৎসার কাগজ পত্র দেখার পর ওসি কানাইবাবু মিনিট খানেক চুপ করে বসেছিলেন। এর পর তিনি বললেন, …
-----ছেলে মেয়েদের ঠিক মত মানুষ করা প্রতিটি বাবা মায়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সেই কাজ ঠিকমত না হলে আমাদের ঘরে ঘরে এই রকম অসুস্থ অর্কদীপ তৈরি হবে। যেহেতু এটা খুনের মামলা, আদালতে তো হাজির করতে হবেই। তবে মামলাটি যাতে সহানুভূতির সাথে দেখা হয় সেই চেষ্টা করা হবে। তবে তদন্ত চলবে।
***************************************************************