অন্য খেলা
অন্য খেলা


"সুদীপ ,প্লিজ আজ আর এরকম দুষ্টুমি কোরোনা।" মিষ্টি কাতর স্বরে বলে ওঠে ।সুদীপ হেসে বলে "আরে না না, কিচ্ছু করবো না। এত ভয় পাও কেন বলতো ?আমি তো আছি।" " না গো, আমার বুকটা না একেবারে ধড়াস ধড়াস করে। আমি সহ্য করতে পারিনা। তুমি জানোতো।"
আসলে সুদীপ ইচ্ছে করে ক্রিকেট কোচিং মাঠের পাশের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় বাইকের হেডলাইটটা হঠাৎ নিভিয়ে দেয় ।সন্ধ্যাবেলায় এই জায়গাটা এমনিতেই প্রায় অন্ধকার থাকে, স্ট্রীট লাইটের বালাই নেই। স্কুল বাড়িতে শুধু একটা টিমটিমে আলো জ্বলে। ক্রিকেট কোচিং মাঠ আর ওপাশের ঘন গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বেশ সুন্দর একটা মায়াবী রাস্তা। এটা খুবই পছন্দ করে সুদীপ,সন্ধ্যার পর হলেও। হেড লাইট নেভাতেই , চারপাশে ঘুটঘুটে ঘন অন্ধকার ওদের ঘিরে ধরে। পিছনে বসে মিষ্টি আর্তনাদ করে ওঠে, সুদীপকে প্রানপনে জড়িয়ে ধরে। কয়েক সেকেন্ড। আবার হেড লাইটটা জ্বেলে দেয় সুদীপ, বাকি রাস্তাটা আলোতে আরামে পেরিয়ে যায়। মিষ্টি তখনও সুদীপকে খামচে ধরে থাকে ।
সুদীপ মিষ্টির প্রেমটা বেশ ক'বছরের পুরোনো। তবুও ওদের দুষ্টুমি, খুনসুটি চলতে থাকে, পুরোনো হতে দেয় না ওদের দুজনের জাগতিক চাওয়া-পাওয়াকে। প্রতিদিনই ওরা যেন নতুন করে কিছু না কিছু আবিষ্কার করে একে অপরের মধ্যে। বিকেলে যেদিন একটু বের হতে দেরী হয়ে যায় ,লেকের ধারে ওদের প্রেমপর্ব সেরে ফিরতেও সেদিন সন্ধ্যা হয়ে যায়। আর বাইকে সুদীপ এই নির্জন রাস্তাটা সেদিন ধরবেই, মিষ্টির শত অনুনয়-বিনয় সত্ত্বেও ।আর একবার হেডলাইটের আলোটাও কয়েক সেকেন্ড নেভাবেই। তখনই অন্ধকারে ভয়ে, মিষ্টি সুদীপকে প্রানপনে জড়িয়ে ধরবেই।এমনটা ওদের মাঝে মাঝেই হয়।
কিন্তু সেদিন যেন মিষ্টি একটু বেশিই কাতর অনুনয় বিনয় করছিল ফেরার সময় ।সন্ধ্যা অনেকক্ষণ হয়ে গেছে ,ক্রিকেট কোচিং মাঠের ধারের সেই রাস্তাটা আজকে কিছুতেই ধরতে দেবে না মিষ্টি ।কিন্তু সুদীপের গোঁ,এটাই ওর খেলা ,এটাই মজা ।এই যে মিষ্টির ভয় পাওয়া আর জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করা এটাই ওর সুখানুভব। তাছাড়া ঘুরে গেলে বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হয়ে যাবে, দু'জনকেই কথা শুনতে হবে।
" প্লিজ, প্লিজ, সুদীপ ,আলো নিভিয়োনা আজ।দোহাই তোমার" মিষ্টির এত অনুরোধ সত্বেও সুদীপ সেদিনও যথারীতি হেডলাইটের সুইচটা বাঁ হাতের আঙুলে টুক করে নিভিয়ে দিল।চারদিকে অমনি নিকষ কালো ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিন্তু সেদিন এ কি হল? সুদীপের এমন অভিজ্ঞতা তো কখনো হয়নি! মিষ্টির চিৎকার নেই, প্রানপনে জড়িয়ে ধরা নেই, কি ব্যাপার? মিষ্টি কি আজ ভয় পায়নি? আলোটা কয়েক সেকেন্ড নেভানো, বাইকটা ঠিক রাস্তায় আস্তেই চলছে ।হঠাৎ সুদীপ অনুভব করল ,অন্ধকারে সাদা মতো একটা কাপড় যেন ওর মাথার উপর দিয়ে উড়ে পেছনে চলে গেল ।ততক্ষণে কিছুটা এগিয়ে এসেছে এবার আলোটা জ্বালতেই হবে, নইলে অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যাবে ।অন্ধকার আর রাস্তার ঠাহর হয় না ।কিন্তু সুইচ দিতেও হেড লাইটের আলো জ্বললো না। পাগলের মত আরও দু-তিন বার সুইচটা মেরেও হেড লাইট না জ্বলায় ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলো সুদীপ। রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। তখনই হেডলাইটটা জ্বলে উঠলো, কিন্তু আলোর জোর এত কম কেন? পিছনে ঘুরে সুদীপ দেখে মিষ্টি নেই ,কেউ কোথাও নেই।অজানা একটা রাতপাখির ডাক আকাশ চিরে অন্ধকারে খান খান হয়ে যায়।
ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে সুদীপের, বুকটা ধড়াস ধড়াস করে। মিষ্টির কি হল? কিন্তু এখন ভয় পেলে চলবে না ,ওকে খুঁজতেই হবে। না হলে সর্বনাশ ।ইস্, এতটা গোঁয়ার্তুমি না করলেই হত। মিষ্টি কত বার বারন করছিল এই পথে যেতে,শুনলেই পারত। বাইকটা ঘুরিয়ে নিতে নিতে এসবই ভাবছিল সুদীপ। মনে একরাশ উৎকণ্ঠা ।একটু পিছনে ফিরে যেতেই হেডলাইটের আলোয় দেখে ,রাস্তার ঠিক মাঝখানে মিষ্টি পড়ে আছে। মনে মনে বলে, প্লিজ ভগবান ওর যেন কিছু না হয় ,আর কোনদিনও এমন ভয়ঙ্কর খেলা খেলব না, আর কখনো ওকে এভাবে ভয় দেখাব না। বাইকটা স্টার্ট অবস্থাতেই স্ট্যান্ড করিয়ে, সুদীপ মিষ্টির হাতটা ধরে টেনে তুলতে চেষ্টা করে ,পারেনা। মিষ্টি অজ্ঞান হয়ে গেছে, কিন্তু এত ভারী কেন ?আর হাতটাই বা বরফের মতো এত ঠান্ডা হল কোত্থেকে? তাছাড়া যে লাল শাড়িটা পরে ও গেছিল, সেটা তো নয়, এটা কি একটা সাদা মতো গাউন পরে আছে মিষ্টি ! বাইকের আলোতে আবছা হলেও বোঝা যাচ্ছে। তাহলে এ কি মিষ্টি নয় ?বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে সুদীপের। শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় ।ভয়ে ছেড়ে দেয় হাতটা। তখনই বাইকের স্টার্টটা বন্ধ হয়ে যায় ,আর হেডলাইটটাও বিশ্বাসঘাতকের মত নিভে যায়। ঘুটঘুটে অন্ধকারে তখন সুদীপের হৃদপিণ্ডটা যেন থেমে যেতে চাইছে।
হঠাৎ উল্টো দিক থেকে একটা জিপের হেডলাইট দেখা যায়। একটা পুলিশের টহলদারী জিপ আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে থাকে। সুদীপ ভাবে যাক বাবা এবার শান্তি। কিন্তু এ কি? জিপটা না থেমে এগিয়ে আসতে থাকে, আসতেই থাকে। জিপের আরোহীরা কি দেখতে পাচ্ছে না? চাপা দিয়ে দেবে তো! রাস্তার মাঝখানেই ওরা রয়েছে! জিপটা না থেমে ওদের পিষে দিতে আসছে!
কিন্তু জিপটা থামেনা। সুদীপ- মিষ্টি-ওদের বাইক সবাইকে ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়, কোথাও বাধা পায় না।
জিপের ভেতর বসে লোকাল থানার ওসি দীপাঞ্জন বাবু এএসআইকে বলতে থাকেন "বুঝলে প্রদীপ, ঠিক এই জায়গাতেই পরশু মেয়েটা বাইক থেকে পড়ে মারা গেছিল। আর কি আশ্চর্য, গতকাল ঠিক এখানেই মেয়েটার বয়ফ্রেন্ডও বাইক নিয়ে গাছে ধাক্কা মেরে অ্যাক্সিডেন্ট করে মারা গেল ।কি অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না? আরো কি জানো, দোমড়ানো মোচড়ানো বাইকটা পর্যন্ত আজ আর থানায় দেখছি না ।চুরি হল তো হলো সেই অপয়া বাইকটাই !"
ঠিক তখনই হঠাৎ ওদের জিপের হেডলাইটটা দপ্ দপ্ করে নিভে যায়।উল্টোদিকে একটু সামনেই একটা বাইকের হেডলাইট এগিয়ে আসতে থাকে।