অনুভূতি
অনুভূতি
অনুভব
4 / 05 /2024
কলমে - কৃষ্ণ ব্যানার্জী
হয়তো অনেক পাঠকের আমার লেখা পছন্দ হয়না , কারণ আমার লেখাতে লাল ,নীল , সবুজ , হলুদ এতগুলো রং থাকেনা । আমার গল্পের রং হয় সাদা নয় ধূসর । আমি তাদের নিয়েই লিখতে ভালবাসি যারা দিনের পর দিন শুধুমাত্র বেঁচে থাকার লড়াই করে চলেছে । একটু এলোমেলো করে লিখি বলতে পারেন এটাই আমার প্যাশন। যাদের আমি আমার চলার পথের পাথেয় করে নিয়েছি তাদের জীবনটাই এলোমেলো । আমিও এলোমেলো জীবন যাত্রা থেকেই উঠে এসেছি —---- হ্যাঁ আরো একটা কথা বলে নেওয়া ভালো গল্প আমি সখে লিখি , এটাকে প্রফেশনের করতে পারলামনা , তাই বারংবার পড়ে কারেকশন করা সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠেনা , আমারও একটা পরিবার রয়েছে তাদের সকলের পেট রয়েছে শুধু গল্প লিখলেইতো আর পেট ভরবেনা বলুন । যাইহোক আজ যে গল্পটা বলতে যাচ্ছি সেটা সম্পূর্ন বাস্তব ঘটনা , আমার জীবনের একটা ছোট অথচ বেশ গভীর প্রেক্ষাপট ।
আমার পরিবার বলতে আমি , আমার স্ত্রী , আমার ছেলে আমার মা এবং আমার স্ত্রীর পিতা , মনে আমার শশুর মশাই । আমার পিতা গত হয়েছেন প্রায় আট বছর হয়ে গেল , আমার শাশুরি মা গত হয়েছেন এই বছর চারেকের কাছাকাছি । আজকের সময়ে দাড়িয়ে মোটের উপর কেটে যাচ্ছে সবকিছু । মোটের উপর বলবার কারণ ওই দিন আননা দিন খাওয়া মানুষ কিনা । তাই জীবন বলতে নো ওয়ার্ক নো পে। প্রফেসন টা উল্লেখ না করায় ভালো । আমরা বেশ চলছি , শুধু আমরা বলবো কেনো হয়তো সকলেই চলছে কেউ আমাদের থেকে বেশ ভালো আবার কেউ হয়তো একটু খারাপ ।
আজ থেকে সাত বছর আগে আমাদের সাথে একটা পরিবারের আলাপ হয় । আলাপের প্রেক্ষাপট ক্ষুদ্র লোন প্রকল্প । কিছু কিছু ছোট ছোট ব্যাংক গজিয়ে ওঠে , সুদখোরদের সমান সুদে অল্প বিস্তর লোন মহিলাদের দিতে শুরু করে । তেমনই একটা সংস্থা থেকে আমরাও লোনের আবেদন করে বোসি, যদিও এই আবেদন নিরুপায় হয়েই করা । লোন দেওয়ার সিস্টেম কামসে কম দশ জন গ্রাহক একত্রিত করতে হবে । লোনের গ্রুপটা বসে আমাদের বাড়িতেই । সেখানেই তারা প্রতি সপ্তায় লোন পরিশোধ করতে আসেন । যে মহিলার কথা বলতে চলেছি বা যে পরিবারের কথা বলতে চলেছি তাদের আসল নামগুলো বলছিনা কারণ তাদের আপত্তি থাকতে পারে । আমাদের বাড়িতে সেই ভদ্রমহিলা এলেন, ছিমছাম দেহের গড়ন , গায়ের রং একটু চাপা তবে কালো নয় । চোখ গুলো বড্ড ইনোসেন্ট তবে প্রচণ্ড সৎ । দু - একদিন তাকে খেয়াল করে বুঝতে পারলাম তারমধ্যে কোথাও যেনো একটা ভয় কাজ করে , মান সম্মানের ভয় , কিছু হারিয়ে ফেলার ভয় । প্রথম দু - এক সপ্তাহ তার সাথে আমার কোনো কথাই হয় না । আমার স্ত্রীর সাথে বেশ ভালই একটা সম্পর্ক তার সাথে হয়েছে । তৃতীয় সপ্তাহে কোন একটা বিষয়ে তারসাথে আলাপ হয় আমার । আলাপের প্রেক্ষাপট বলার প্রয়োজন তেমন একটা না থাকায় বলছিনা । বয়সে আমার থেকে ছোট হলেও দিদি বলেই সম্বোধন করেছিলাম তাকে , আজও তাই বলেই ডাকি ।
তাদের পরিবারে মোট লোক সংখ্যা চার । দুই মেয়ে , বাবা আর মা , মানে আমার পাতানো দিদি । সেই সময় বড় মেয়ে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে আর চটজন পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে । আশেপাশে বেশ কিছু আত্মীয় পরিজন রয়েছে বটে , তবে যে যার মতো। প্রত্যেকটা মানুষকেই নিজের লড়াইটা নিজেকেই লড়তে হয় । তাই দিদিও লড়েছলেছে তার সংসারের যুদ্ধ। দাদা মনে ওনার হাজবেন্ড আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে M.S.C পাস করেন , তারপর রাজনীতি আর সমাজ সেবা করতে গিয়ে নিজের ক্যারিয়ারটা শেষ করে ফেলেছেন । আমাদের সাথে যখন প্রথম ওদের আলাপ হয় তখন তিনি একটি সরকারি স্কুলের কেরানি , খুব সামান্যই বেতন । ওই বেতনে সংসার চালিয়ে দুই মেয়েকে মানুষ করা তার সাথে রোগ বালাই তো লেগেই থাকে আজকাল আর সেখানে খরচ নেহাতই কম হয় না । তাহলে সংসার চলে কি ভাবে ?
এবার যে কথাটা বলবো সেটা আপনারা হয়তো কল্পনা করতেও পারবেন না । আমার পাতানো দিদি টা একাই বয়ে বেড়ায় এই বিশাল সংসারের অর্ধেকের বেশি দায়িত্ব । একটা মানুষ তার সংসারের জন্য চোদ্দ ঘণ্টা খাটতে পারে এটাতো আমার জীবনে চিন্তার অতীত ছিলো । কিন্তু নিজের চোখকে মিথ্যা মানতে পারলাম না । হয়তো সংসারের অভাব সে মিটিয়ে ফেলতে পেরেছিলো প্রতি মুহূর্তে । তার অনুভূতি হয়তো কোন একটা জায়গা থেকে সঠিক ছিলো। আজকের যুগে দাঁড়িয়ে টাকা ছাড়া কিছুই হয়না কিন্তু টাকার বাইরেও একটা পৃথিবী আছে , মানুষের মনের ইন্ধন যোগানোর জন্যে কিছু মুহূর্ত লাগে , যেটা এই সাত বছরে আমি উপলব্ধি করিনি । সাত বছরে সাতদিন বিশ্রাম করেছে কিনা সেটাই সন্দেহ । এবার বলুন দুটো বাচ্চা মেয়ে , ছোট বেলা থেকে চার দেয়ালে বন্দী । স্কুল , বাড়ি আর প্রাইভেট এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাদের জীবন । একটা কথাতো সকলেই জানেন বাধা গরু একবার ছাড়া পেলে তার কি অবস্থা হতে পারে ? এটাতো হবারই ছিলো । কি হয়েছিলো সেটা বলা বাঞ্ছনীয় নয় ।
ওদের সাথে আলাপ হবার পড় থেকে ওদের সাথে আমাদের একটা পারিবারিক সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিলো, তাই দিদি আর দাদা কাজে থাকা কালীন কোন অসুবিধা হলেই , আমাকে ছুটে যেতে হতো ওদের বাড়িতে । ছোট ছোট মেয়ে দুটো কতখানি অসহায় । ওরা যেনো কোন একটা অবলম্বন খুঁজে চলেছে সারাক্ষণ । আমি ওদের আঙ্কেল কিন্তু বড় মেয়েটি কেমন যেনো আমার খুব আবদারী হয়ে উঠলো। ছোট ছোট ছেলে মানুষি , ছোট আবদার আমাকে একটা মায়ার জালে অবাধ করে ফেলতে থাকলো । আমার অনুভূতিটা ঠিক কি ছিলো আমি আজও বলতে পারবোনা। ধীরে ধীরে মেয়েটি কেমন যেনো আমার বন্ধুর মোতো হয়ে উঠলো। ওদের দুই বোন যেনো আমাকে সামনে পেলে একটা আশ্বাস পেতো , যদিও ওরা দুজনই আমার ছেলের থেকে ছোট কিন্তু আমার কেমন যেনো মনে হয়েছিল বন্ধুত্বের কোন বয়স হয়না ।
ওদের আবদার গুলো আমার বেশ ভালো লাগতো , খুব ছোট ছোট আবদার । বড় হবার সাথে সাথে ছোট মেয়ের আবদার কমতে থাকলো কিন্তু যে আবদার করে অভ্যস্থ সে হয়তো অভ্যাসটা সম্পূর্ণ ছাড়তে পারেনি ।
কলেজে ভর্তি হবার পড় ওর মধ্যে বেশ কিছুটা পরিবর্তন ঘটে গেলো । এটা অস্বাভাবিক নয় । বন্ধু আর বয়ফ্রেন্ড দুজনের মধ্যে কিছুতো পার্থক্য থেকেই যায় । বন্ধু কর্তব্য পালন করতে পিছুপাও হয়না কখনও , বন্ধুর সকল বিপদে বন্ধুই পাশে দাঁড়ায় । কিন্তু বয়ফ্রেন্ড একটা মেয়েকে বিয়ের আগেই তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করে । কখনও কখনও ভালোবাসার মানুষের মন রাখতে বন্ধুদেরও দূরে সরিয়ে দিতে হয়। আমার ছেলের কাছে আমি আর আমার স্ত্রী যেমন বন্ধুর মোতো, ঠিক ওর কাছেও আমি বন্ধুর মতোই , এই সম্পর্কের অনুভূতিকে পৃথিবীর যে মানুষ যেভাবেই দেখুকনা কেনো । সন্তান বড় হলে পিতা - মাতা তাদের বন্ধু হয়ে যায় । হয়তো আমি ওদের পিতা নোই কিন্তু ও যখন বন্ধু হিসাবে ওর সকল কথা আমার সাথে অকপটে শেয়ার করতে ভয় পায়না , ঠিক সেখানে দাড়িয়েই যখনি কোন বিপদে পরে ও আমাকে একটিবার ডাকবে , আমি চেষ্টা করবো ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াবার । হয়তো এটাকেই বলে অনুভব ? কিন্তু এই অনুভুতির সঠিক নামকরণ আজও আমি করতে পারিনি । কারণ একটা সময়ের ব্যবধান তো রয়েই গিয়েছে । আমাদের সময় স্কুলে শিখেছিলাম পকৃত বন্ধু সে , যে বন্ধুর বিপদে সব সময় তার পাশে থাকে , কোন অবস্থাতে তাকে ছেড়ে চলে যায়না । যুগ পাল্টেছে , পাল্টেছে সমীকরণ । তাই বর্তমানে বন্ধুত্বের সমীকরণটা ঠিক কোন জায়গাতে রয়েছে সেটা আমার জানা নেই । আমি আমার সমীকরণ ধরেই চলবো , বর্তমান বর্তমানের সমীকরণে হাঁটবে। হয়তো আজকের বন্ধুত্ব স্বার্থ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ । আমার প্রিয় গায়ক নচিকেতার কোথায় “ অনুভূতি তনুভূতি মিথ্যা “ হয়তো এটাই আজকের সময়ের সঠিক সমীকরণ । যখন তোমাকে দরকার তখন তোমার চাইতে আপন কেউ নেই , দরকার মিটলে দেখবে নতুন সেলফির ফ্রেমে তুমিই নেই ।
সমাপ্ত
