অঙ্কুর ।।। একটি গয়েন্দা কাহিনী
অঙ্কুর ।।। একটি গয়েন্দা কাহিনী
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে, আরাম কেদারায় বসে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছি। ঘাষের পাতার উপর কত সুন্দর বৃষ্টি পড়ছে। পাশের বাড়ির আসমানির চালের উপর বৃষ্টি যেন নিত্য করছে, এ-যেন এক বেহেস্তি আনন্দ। ঘাসের পাতা বৃষ্টির পানিতে সবুজ গাছ গুলো আরো সুন্দর হয়েছে। হটাৎ একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে আমার মোবাইলে ফোন আসল। ফোন রিসিভ করার পরেই অপর প্রান্ত থেকে এক ললনার মিষ্টি কন্ঠ ভেসে আসল। সালাম দিয়ে জানাল তার নাম আফসানা। সে বলল তার ভাই জাহিদকে নাকি আজ তিন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার ফোন ফেসবুক ইনস্ট্রাগ্রাম সব কিছু বন্ধ রয়েছে। থানায় জিডি করেছে কিন্তু তাও কোন খোজ পাচ্ছে না। আফসানার কথা শুনে আমি আতকে উঠলাম কি হলো জাহিদের! জাহিদ আমার বন্ধু। হ্যা তার সাথে অবশ্য আমার কথা হয় না। আমার সম্পাদিত অর্কিড পাণ্ডুলিপি বই থেকে আমার নাম্বার পেয়ে আমাকে ফোন দিয়েছে।
খবর টি পেয়ে আমি সাথে সাথে আমাদের বন্ধু মহলে জানিয়ে দিলাম। বন্ধু মহলের কেউ এই বিষয়ে কেউ জানে না। কিন্তু আসলে কি তাহলে জাহিদের খারাপ কিছু হলো না অন্য কিছু কোন কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। হটাৎ ঘড়ির দিকে চোখ যাওয়ার পরে দেখি দুপুর সাড়ে ১২ বেজে গেছে। দ্রুত গোছল করে মসজিদে চলে গেলাম। মসজিদ থেকে আসার পথে দেখা হলো বন্ধু সালমানের সাথে দেখা হলো। সালমানের সাথে এই বিষয়ে খোলামেলা কথা বলতে চাইলাম। সালমান আমাকে বলল যে, গত মঙ্গলবারে জাহিদের সাথে কথা হয়েছিল, সেখানে সে বলছিল নতুন একটা পরিকল্পনা করেছি। কিন্তু কি পরিকল্পনা করেছে এই বিষয়ে সালমান কিছু জানে না।
আফসানার কথা শুনে আমার কিছুটা সন্দেহ হয়েছিল যে, সে আত্মগোপন করেছে কিন্তু সালমানের কতা শুনে সেটা আরো দৃঢ় হতে থাকে। কিন্তু যাই হোক আমাদের তো সমাধান করতে হবে। জাহিদ কে খুঁজে বের করতে হবে। যাইহোক সালমানের সাথে কথা শেষ করে বাসায় গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে ল্যাপটপ নিয়ে বসলাম। অনলাইনে বসে খুজতেছিলাম কোন ভাবে তার লোকেশন জানা যায় কি না!
তার ফেসবুক ও ইমেইলে লগইন একটিভিটি আর ফোনের লোকেশন ট্রাক থেকে জানতে পারি যে সে, কুয়াকাটার দিকে যাচ্ছে। বাহঃ বেস ভালো তো। সমুদ্র স্নান করে আসুক আমাদের বন্ধু। কিন্তু বাড়ি থেকে লোকানোর কারণ কি হতে পারে! আমি সাথে সাথে আফসানাকে ফোন দিলাম। বাড়িতে তার কোন ঝামেলা হয়েছে নাকি? আফসানা জানাল বাড়িতে তেমন ঝামেলা হয় নাই তবে তার ( জাহিদের ) গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে হয়ে গিয়েছে আর এটার জন্য চার পাঁচ দিন মন খুব খারাপ ছিল। কারোর সাথে নাকি কথা বলত না ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করত না একা একা ঘরে শুয়ে থাকত। হটাৎ বুধবার বিকালে ঘর থেকে বের হয় বলে যে হাটতে যাচ্ছে কিন্তু এরপর আর তার কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।
আফসানার কথা শুনে রাগে আমার মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছা করছে। গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে হয়ে গিয়েছে সেই রাগে বাবা মা ভাই বোনদের কষ্ট দেওয়ার কারণ কি? অনলাইন রিচার্জ শেষে আমি সালমান ও যুবায়ের গেলাম জাহিদের বাড়িতে। চাচাকে (জাহিদের বাবা) দেখে খুব কষ্ট হলো। ছেলের শোকে একবারে ভেংগে পড়েছেন। একমাত্র ছেলে বলে কথা। জাহিদের বাবা একটি মাদরাসার আরবি প্রভাষক খুব দ্বীনদ্বার মানুষ। চাচার সাথে কথা বলে আমরা চলে আসলাম। আমরা তিনজন মিলে ঠিক করলাম যে ভাবেই হোক জাহিদ কে খুঁজে বের করতে হবে। কুয়াকাটার পরে জাহিদের সিম বন্ধ। এখন সে সেট বন্ধ করে রেখেছে না নতুন সিম কিনেছে না অন্য কোন বিপদে পড়েছে এই প্রশ্নের জবাব লাগবে।
এরকম হাজারো প্রশ্ন মাথায় নিয়ে মাগুরা থেকে আমরা বাসে উঠলাম। নবিন-বরণ পরিবহন সরাসরি কুয়াকাটা পর্যন্ত যায়। সকল কিছু গুছিয়ে রাত ১১ টায় বাসে উঠলাম। বাস তার সুন্দর গতীতে এগিয়ে চলছে। ভাঙ্গার মোড় ভাঙ্গা হাইওয়ে কত সুন্দর লাগছে সে যেন এক নৈস্বর্গিক আনন্দ। মনে হচ্ছে যেন বিদেশে আছি। সত্যি আমাদের দেশ অনেক উন্নত হয়ে গিয়েছে। এসিয়ান হাইওয়ে ও পদ্মা সেতু সড়ক সব মিলিয়ে অনেক সুন্দর লাগছে। সে-যাইহোক কুয়াকাটা পৌঁছাতে ফজরের আযান দিয়ে দিলে। গাড়ি থেকে নেমে হাত-মুখ ধৌত করে ফজরের নামায আদায় করে নিলাম।
কুয়াকাটা রেস্তরা থেকে শুটকি মাছ ভাজি আর তন্দুর রুটি খেয়ে নিলাম আহা কত সুন্দর স্বাদ। কুয়াকাটা গেলে এই খাবারটা আর মিছ হয় না। পরে আর সময় পাবো কি না তাই আগেই খেয়ে নিলাম। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা বের হলাম সাগরের তীরে একজন লোক ডাব বিক্রি করছিল। আমাদের এলাকার থেকে আকারে বড় কিন্তু দাম কম তাই তিনজন তিনটি ডাব খেয়ে নিলাম। ডাব খাওয়ার ফাকে ডাবওয়ালাকে জাহিদের ছবি দেখালাম সে দেখেছে নাকি? সে জানাল গতকাল মাগরিবের সময় নাকি জাহিদ কে দেখেছিল এখানে। যাক আমাদের বুকে পানি এলো। তার মানে জাহিদ এখানে আছে। আমাদের তক্ষে থাকতে হবে। কারণ আমাদের দেখে আবার পালাতে পারে। ডাব ওয়ালাকে ধন্যবাদ দিয়ে আমরা সাগরের পাড়ে হাটতে গেলাম। সাগরের পানির ভিতর হাটতে খুব ভালোই লাগে। সাগরের পাড়ে গিয়ে দেখা হলো আসিফের সাথে। আসিফ আমার বন্ধু। আসিফের সাথে কথা বার্তা বললাম। আসিফ জানাল যে, জাহিদের সাথে নাকি গতকাল রাতে সাগরের পাড়ে বসে অনেক্ষণ কথা বলেছে। সাথে একজন মহিলা মানুষ ছিল কিন্তু তাকে আসিফ চিনে না। আসিফ কে নাকি জানিয়েছে সে হানিমুন করতে এসেছে।
আসিফের কথা শুনে তো আমরা বড় ধাক্কা খেলাম, হানিমুন মানে! কিন্তু বিষয়টি আসিফ কে বুঝতে দিলাম না। আসিফের কথা শেষ করে আমরা সাগরের দিকে এগিয়ে গেলাম। সেখানে অনেকেই বোট ভাড়া নিয়ে সাগরের তীর দিয়ে ঘুরছিল। আমরাও একটা বোট ভাড়া করতে গিয়ে একটা আইডি কার্ড দেখতে পেলাম। কার্ড নিয়ে দেখলাম এটা জাহিদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি কার্ড। যুবায়ের বলল তার মানে অল্প কিছুক্ষণ আগেই এখানে এসেছিল। আমরা বোট ম্যানকে জাহিদের ছবি দেখালাম তিনি বললেন, দুই মিনিট আগেই তো উনি বোট জমা দিয়ে চলে গেলেন। সাথে কোন মেয়ে আছে কি না প্রশ্নের জবাবে বলেন হ্যা একটা মেয়ে ছিল।
তখন সালমান বলে জাহিদের এক্স গার্ল ফ্রেন্ড জাকিয়া এর ফোন ফেসবুক ট্রাক করে দেখতে হবে। আমরা একটা হোটেলে রুম নিব কিছুক্ষন বিশ্রাম নিব। সারা রাত গাড়িতে এসে ক্লান্ত লাগছে। আমরা একটা হোটেলে গেলাম রিসিপসনে যেতেই দেখি সেখান থেকে জাহিদ লিফটের ভিতর প্রবেশ করল সাথে জাকিয়া। জাকিয়াকে দেখে কিছুটা অবাক হলেও মনে মনে খুশি হলাম যাক জাহিদের ঠিকানা তাহলে পাওয়া গিয়েছে। আমরা একটা রুম নিলাম। রুমে গিয়ে বসে জাহিদের বাবাকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলাম যে জাহিদ কে পাওয়া গিয়েছে।
জাহিদের কোন রুম এটা জানতে হবে। এটার জন্য সালমান কে রিসিপসনে পাঠিয়ে দিলাম। সালমান রিসিপসন থেকে ফিরে এসে জানাল তাদের রুম নাম্বার ৪০৬। আর আমাদের ৪১০। আমাদের রুমের দরজা খুলে দেখি ঠিক উলটো পাশের রুম টাই হচ্ছে ৪১০। আমরা ঘরে এসে পরিকল্পনা করতে থাকি কিভাবে তাদের ধরব। যুবায়ের আমাদের বলে যে, আমরা কোন ভাবেই বুঝতে দিব না যে আমরা তাকেই ধরতে এসেছি। এমনি ঘুরতে এসে আচমকা দেখা হয়েছে এমনটি বুঝাতে হবে।
যেমন প্লান তেমন কাজ। আমার সাথে আনা ব্লুটুথ স্পাই ক্যাম আমাদের দরজার এক কোণে লাগিয়ে দিলাম। যাতে কখন সে বের হয় এটা আমরা দেখতে পারি। ল্যাপটপ চালু করে ক্যামেরার সাথে ল্যাপটপ কানেক্ট করে রাখলাম। এরপর একে একে তিনজন গোছল করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। হোটেল বয় এসে দুপুরের খাবার দিয়ে গেলে খাওয়া দাওয়া করে বসে আসি কিন্তু তাদের বের হওয়ার কোন নাম নেই। বিকাল বেলা দেখলাম দরজা খুলল প্রথমে জাকিয়া বের হয়ে আসল সাথে সাথে আমরা দরজা খুলে দরজার সামনে গেলাম। ততক্ষণে জাহিদ বাহিরে চলে এসেছে।
দরজা খুলে জাহিদ কে দেখেই বললাম, “আসসালামু আলাইকুম জাহিদ ভাই কি অবস্থা?” জাহিদ আমাদের দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠল। তার হাত থেকে রুমের চাবি পড়ে গেলো। ভয়ে কাপতেছিল। আমি বললাম আরে বন্ধু এত ভয় পাচ্ছ কেন? আর জাকিয়ার নাকি বিয়ে হয়ে গেছে তাহলে তোমার কাছে কেন? জাহিদ বলল বন্ধু তোমার সাথে অনেক কথা আছে ঘরে চলো।
আমরা ঘরে গিয়ে বসলাম জাকিয়া বলতে শুরু করল, আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল এক বুড়ো লোকের সাথে। বিয়ের আগের রাতে আমি পালিয়ে কুয়াকাটাতে চলে আসি। কিন্তু আসার সময় ভুল ক্রমে মোবাইল ফেলে রেখে আসি। এখানে এসে কিছুই চিনি না জানি না দুই দিন পরে একটা ফোন কিনে ওরে জানালে ও সাথে সাথে চলে আসে। সালমান বলল তা ভালো কিন্তু জাহিদের ফোন বন্ধ কেন? জাকিয়া বলল, আমি বন্ধ করে রাখতে বলেছিলাম। যাতে তোমরা ধরতে না পার। কিন্তু সেই তুমি বের করেই ফেললে। আমি উঠে গিয়ে স্পাই ক্যাম খুলে আনলাম। এটা থেকে জাহিদ বলল বন্ধু এখানেও ক্যামেরা!
আমি বললাম যাই হোক এখন চলো বাড়ি যেতে হবে। তোমার বাবা কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে মৃত্যু প্রায় অবস্থা। তুমি এক মাত্র ছেলে। আর তোমার বোন আফসানা তার ভাই এর শোকে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করতেছে। জাহিদ কেঁদে দিলো। আমি জাহিদের বাবাকে ফোন দিলাম। চাচা আপনার ছেলে কে নিয়ে আসতেছি। সাথে ঘর সাজান। সুন্দর একটা বাসর ঘর বানান। ছেলে ও ছেলের বউকে নিয়ে আসতেছি। চাচা বললেন ছেলের বউ মানে?। চাচা আপনার নয়নের মনি জাকিয়াকে জাহিদ বিয়ে করেছে। আর জাহিদ না আসলে জাকিয়া অনেক বিপদে পড়ত। আপনি রাগ করিয়েন না। সুন্দর করে ঘর সাজান আমরা নিয়ে আসতেছি।
বিকালে আমরা পাঁচজন সাগরের পাড় দিয়ে হেটে বেড়ালাম। রাতের বেলা একটা গাড়ি ভাড়া করে আনলাম। রাত ১০ টায় রওনা দিলাম। আর নড়াইল দিয়ে ঢুকতে বললাম যাতে সময় কম লাগে। ফজরের আগেই আমরা পৌছিয়ে গেলাম। বাবা মা তার ছেলে কে পেয়ে আনন্দে মন ভরে গেলো। এমন সুন্দরী মেধাবী বউ পেয়ে জাহিদের মা বেজায় খুশি। আর আফসানা তো ভাবির জন্য পাগল। অবশেষে দুই রাত একদিনের জার্নী শেষ করে আমরা বাড়ি ফিরলাম। আমরা অনেক খুশি যে আমাদের বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি।